Image description
জমি থেকে তোলা ফুলকপি নিয়ে এসেছেন কৃষক। বুধবার সকালে নওগাঁ সদরের আঞ্চলিক মহাসড়কের ডাক্তারের মোড় এলাকায়। ছবি: সমকাল

  নওগাঁ সদরের চাষি আব্দুল কাদের চলতি মৌসুমে ফুলকপি চাষ করেছেন এক বিঘা জমিতে। গতকাল বুধবার সকালে ভ্যানে করে ডাক্তারের মোড়ে নিয়ে আসেন বিক্রির জন্য। বাজারের পরিস্থিতি দেখে মাথায় হাত তাঁর। বাজারে প্রতি ফুলকপির দাম আকারভেদে কোনোটা ৫০ পয়সা, কোনোটা এক টাকা। ভাগ্যবান চাষিরা বিক্রি করতে পারছেন দেড় টাকা-দুটাকা দরে। 

এ অবস্থা দেখে ক্ষোভে ফেটে পড়েন সদর উপজেলার কীর্তিপুরের বাসিন্দা কাদের। তাঁর জমিতে প্রতিটি ফুলকপি গাছের পেছনেই খরচ হয়েছে ৬ থেকে ৮ টাকার মতো। এখন দর যদি নেমে আসে ৫০ পয়সায় তবে এমন অনুভূতিই স্বাভাবিক। আক্ষেপ-ক্ষোভের সুরে কাদের বলেন, ‘কপি বিক্রি করে ভ্যান খরচের টাকাই উঠবে না। এমন বাজার দেখে কলিজা ফেটে যাচ্ছে। মন চাইছে, এখনও জমিতে যে ফুলকপি আছে সেগুলো গরু দিয়ে খাওয়াই।’

 

ডাক্তারের মোড় পড়েছে নওগাঁ সদর উপজেলার নওগাঁ-রাজশাহী আঞ্চলিক মহাসড়কে। প্রতিদিন ভোরে আশপাশের কৃষকরা জমি থেকে ফুলকপি নিয়ে আসেন বিক্রির জন্য। বুধবার সকালে দেখা যায়, বিক্রির জন্য ফুলকপি নিয়ে আসা কৃষকের দুর্ভোগ। শুরুতে সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে তাদের অনেকে কথা বলতে রাজি হননি। ফুলকপির দরপতনের জন্য তারা সাংবাদিক পরিচয়ধারী কিছু ব্যক্তির নেতিবাচক প্রতিবেদনকে দায়ী করেন। এ সময় ক্ষোভে ফেটেও পড়েন, অনেকে মুখ ঘুরিয়ে চলে যান। আশপাশের জমিতে গিয়েও কোনো কৃষকের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। 

 

সাইফুল ইসলাম নামের এক কৃষক ডাক্তারের মোড়ে এসেছিলেন বুধবার সকালে। তাঁর বাড়ি সদরের বাচারি গ্রামে। মৌসুমের শুরুতে ১০ কাঠা জমিতে ফুলকপি চাষ করে ভালোই লাভ হয়েছিল। পরে দ্বিতীয় দফায় ২০ কাঠা জমিতে চাষ করেন। এতে খরচ হয় ১৭-১৮ হাজার টাকার মতো। সাইফুলের ভাষ্য, ‘এখনই ফুলকপি ১-২ টাকা দরে বিক্রি করতে হচ্ছে। তাও কেনার মানুষ নেই। এক বিঘা জমির কপি আড়াই থেকে তিন হাজার টাকাও বিক্রি হচ্ছে না। তাহলে আমরা কী করে চলব।’ তাঁর মতো ধার-দেনা করে অনেকেই ফুলকপি চাষ করেছেন। সেই টাকা পরিশোধ নিয়েও দুশ্চিন্তায় রয়েছেন তারা। 

কয়েকজন কৃষক বলেন, গত বছর ফুলকপির ভালো দাম পেয়েছেন তারা। সে বিষয়টি চলতি মৌসুমে আবাদ বাড়াতে সাহায্য করে। এখন দাম যা দাঁড়িয়েছে, তাতে লাভ তো দূরে থাক আসলও উঠে আসছে না। মৌসুমের শুরুতে আগাম জাতের ফুলকপির উৎপাদন কম ছিল, তখন দাম ছিল বেশ চড়া। এখন উৎপাদন বাড়তে থাকায় বাজারে ধস নেমেছে বলে মনে করছেন তারা।

পাইকারি ব্যবসায়ী আবদুল মালেকের কথায়ও কিছুটা আঁচ পাওয়া যায় বাজারের এমন দশার। তিনি বলেন, নওগাঁ শহরে পাইকারি দরেই ফুলকপি বিক্রি হচ্ছে ৩-৪ টাকায়। এর সঙ্গে যাতায়াত খরচ ও নিজের শ্রম আছে। তাই কেনার সময় কৃষককে ১-২ টাকার বেশি দাম দিতে পারেন না।

জেলা কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, এবার নওগাঁয় শীতকালীন সবজি আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯ হাজার ৫৯৫ হেক্টর জমি। চাষ হয়েছে ৯ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে ৬০০ হেক্টর জমিতে ফুলকপির আবাদ হয়েছে। এখান থেকে প্রায় ৬ হাজার ২০০ টন ফুলকপি উৎপাদিত হতে পারে। এ ছাড়া আলু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২১ হাজার ২৭০ হেক্টর জমিতে। চাষ হয়েছে ২৫ হাজার ২৪০ হেক্টর জমিতে।

বাজারদরের বিষয়ে বুধবার কথা হয় নওগাঁ জেলা কৃষি বিপণন কর্মকর্তা সোহাগ সরকারের সঙ্গে। তাঁর ভাষ্য, আগাম ও মধ্যমেয়াদি সবজি একসঙ্গে বাজারে ওঠায় দাম কমে গেছে। আগাম মেয়াদি সবজিতে কৃষক বেশি দাম পাওয়ায় প্রয়োজনের তুলনায় অধিক সংখ্যক কৃষক সবজি চাষে ঝুঁকে পড়েন। এটিও ফুলকপিসহ সব ধরনের সবজির দাম কমার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে। 

সোহাগ সরকারের মতে, ‘এক্ষেত্রে কৃষি বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের উচিত ছিল, কখন কোন ফসল করা উচিত– এ বিষয়ে কৃষকদের বোঝানো। আমরা তো আর উৎপাদনে জড়িত নই।’ তাঁর বিভাগের কাজের বিষয়ে বলেন, ‘নওগাঁ থেকে সবজি কেনার জন্য আমরা স্বপ্নসহ বিভিন্ন জেলার ক্রেতার সঙ্গে যোগাযোগ করছি। এ ছাড়া জেলা থেকে তেমন কিছু করার নেই। সরকার চাইলে কেন্দ্রীয়ভাবে কৃষকের কাছ থেকে ভর্তুকি মূল্যে এসব সবজি কিনতে পারে।’

জেলা বিপণন কর্মকর্তার অভিযোগের বিষয়ে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘তিনি নতুন মানুষ। নতুন চাকরি। এ বিষয়ে তাঁর ধারণা কম, তাই এসব উল্টোপাল্টা কথা বলেছেন। কৃষি বিভাগের কাজ হচ্ছে ফসলের উৎপাদন বাড়ানো। কোন ফসলের কী দাম হবে এসব দেখা আমাদের কাজ নয়।’ আবুল কালাম আজাদও মনে করেন, শীতের শুরুর দিকে সব ধরনের সবজির দাম বেশি পেয়ে কৃষক সবজি চাষে ঝুঁকে পড়েন। এ কারণেই মূলত এখন সবজির দাম কমে গেছে।