বাংলাদেশ ব্যাংকের চট্টগ্রাম কেন্দ্রে থাকা শিল্পগ্রুপ এস আলমের কয়েকটি ড্রয়ারের ‘রহস্য’ উদঘাটিত হয়েছে। এই ড্রয়ারগুলোয় থাকত ব্যাংক ঋণের গুরুত্বপূর্ণ সব নথি। এসব নথিতে ছিল ব্যাংক খাতে মাফিয়া হয়ে ওঠা এস আলম গ্রুপের ছয় ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতির সব প্রমাণ।
এখানকার ছোট্ট কয়েকটি ড্রয়ারে এগুলো ফেলে রাখা হতো বছরের পর বছর, যাতে এ বিষয়ে কেউ ঘুণাক্ষরেও জানতে না পারে। তবে ৫ আগস্টে পটপরিবর্তনের পর এসব জট খুলতে শুরু করেছে। সে সঙ্গে উঠে এসেছে এসব কাজে জড়িত ব্যক্তিদের নামও।
অনুসন্ধানে জানা যায়, এস আলমের মালিকানায় থাকা ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক ও কমার্স ব্যাংক তদারকির জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের চট্টগ্রাম কেন্দ্রে ২০১৭ সালে পরিদর্শন বিভাগ-৪ নামে একটি বিভাগ খোলা হয়।
কেন্দ্রে এ ধরনের আরও তিনটি বিভাগ রয়েছে। খোলার সময় বলা হয়, তফসিলি ব্যাংকগুলোর অনিয়ম-দুর্নীতি রোধে পরিদর্শন বিভাগগুলো কাজ করবে। আর বিভাগ-৪, ইসলামী শরিয়াভিত্তিক ব্যাংকগুলো নিয়ন্ত্রণের জন্য যাত্রা শুরু করেছিল। কিন্তু পরে এ বিভাগটিই যেন হয়ে ওঠে এস আলমের সব ব্যাংকের ‘মুশকিল আসান’ বিভাগ। বিভাগটি এস আলমের ব্যাংকের অনিয়ম-দুর্নীতি অনুসন্ধানের দায়িত্বে থাকলেও মাঝেমধ্যে বাছাই করা কর্মকর্তা দিয়ে মনমতো পরিদর্শন কাজ করিয়ে নিতেন এস আলমের ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তারা।
এর উদ্দেশ্য থাকত, দুর্নীতির তথ্য যাতে প্রকাশ না পায়। যদি পরিদর্শন প্রতিবেদন বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যন্ত চলেও যায়, তাহলেও এসবের জায়গা হতো এস আলমের ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তাদের ড্রয়ারে। সম্প্রতি এমন কয়েকটি ড্রয়ারের সন্ধান এবং সেগুলোতে এস আলমের ঋণ জালিয়াতির প্রমাণ মিলেছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
সূত্র জানায়, হদিসবিহীন ঋণের খোঁজে ২০২২ সালের ১৩ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংক চট্টগ্রাম কেন্দ্রের অতিরিক্ত পরিচালক মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের হালিশহর, জুবিলী রোড ও আগ্রাবাদ শাখার পরিদর্শনের লিখিত নির্দেশনা দেন। এরই অংশ হিসেবে দুজনের একটি পরিদর্শনকারী দল গঠন করা হয়। দলটির প্রধান ছিলেন যুগ্ম পরিচালক আহসান উল্লাহ রাসেল ও সদস্য ছিলেন উপপরিচালক মো. জোনায়েদ হোসেন ভুঁইয়া।
কয়েকটি নথি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক থেকে এসএমই ঋণ-মোবাইল মনিটরিং-সংক্রান্ত সেপ্টেম্বর-২০২২ ও অক্টোবর-২০২২-এর মাসিক বিবরণী বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠানো হয়। ওই তিনটি শাখার চার প্রতিষ্ঠানকে বিতরণ করা ঋণ ও বকেয়া ঋণের স্থিতি দেখে অবাক হন সংশ্লিষ্টরা। বিতরণ করা ঋণ ও বকেয়া ঋণের স্থিতির মধ্যে আকাশ-পাতাল ফারাক ছিল।
পরিদর্শনকারী দলের প্রতিবেদনে বলা হয়, হালিশহর শাখা আছাদগঞ্জের মেসার্স স্টার কেয়ার ট্রেডিং নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে বিতরণ করা ঋণের তুলনায় বকেয়া ঋণের স্থিতি ৩৯৯ শতাংশ। জুবিলী রোড শাখা থেকে নগরীর চকবাজার এলাকার মেসার্স আইডিয়াল প্রিন্টিং হাউস নামে একটি ছাপাখানাকে বিতরণ করা ঋণের তুলনায় বকেয়া ঋণের স্থিতি ৬১৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ এবং একই প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া শাখার আরেকটি ঋণের তুলনায় বকেয়া স্থিতি তিন হাজার ৮৯৯ দশমিক ১২ শতাংশ।
একইভাবে আগ্রাবাদ শাখা কর্তৃক নগরীর বালুছড়া এলাকার বায়েজিদ ড্রেসেস নামে একটি গার্মেন্টসকে বিতরণ করা ঋণের বিপরীতে বকেয়া ঋণস্থিতি ছিল ৬২৪ দশমিক ৪৭ শতাংশ। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের মাসিক বিবরণীতে ঋণ বিতরণের চেয়ে বকেয়া ঋণের স্থিতিকে অস্বাভাবিক, সন্দেহজনক ও অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে উল্লেখ করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের যুগ্ম পরিচালক মাহফুজুল হক।
মাহফুজুল হক উল্লিখিত শাখাগুলোতে সরেজমিনে পরিদর্শনের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করে ২০২২ সালের ১২ ডিসেম্বর এক চিঠি ইস্যু করেন। এরপরই মূলত শাখাগুলো পরিদর্শনে দিনক্ষণ ও উল্লিখিত কর্মকর্তাদের দায়িত্ব বণ্টন করে দেন বাংলাদেশ ব্যাংক চট্টগ্রাম কেন্দ্রের অতিরিক্ত পরিচালক মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন।
এদিকে শিডিউল অনুযায়ী, ২০২২ সালের ১৯ ডিসেম্বর যুগ্ম পরিচালক আহসান উল্লাহ রাসেলের নেতৃত্বে পরিদর্শক দল হালিশহর শাখায় যায়। সংশ্লিষ্টরা জানান, ব্যাংক ম্যানেজার তথ্য দিতে গড়িমসি করলেও কোনোরকমে পরিদর্শনকাজ সারে দলটি। এরই মধ্যে তোলপাড় শুরু হয় বাংলাদেশ ব্যাংকে। কেন এস আলমের ব্যাংক পরিদর্শনে গেল দলটি- এ জন্য এস আলমের ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তারা পরিদর্শক দলকে রীতিমতো নাজেহাল করেন। এরপর থেকে পরিদর্শনকাজ পরিচালনা থেকে তাদের সরিয়ে দেওয়া হয়।
শুধু তা-ই নয়, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের হালিশহর ও আগ্রাবাদ শাখা পরিদর্শনের পর বাংলাদেশ ব্যাংক চট্টগ্রাম কেন্দ্র কর্তৃপক্ষের কাছে দাখিল করা সেই প্রতিবেদন দুটিও আর আলোর মুখ দেখেনি। স্থান পায় সেখানকার এস আলম ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তাদের ড্রয়ারে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আহসান উল্লাহ রাসেল বলেন, ‘ব্যাংকের পক্ষ থেকে উল্লিখিত তিন শাখা পরিদর্শনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। দুই শাখা পরিদর্শনের সুযোগ পেলেও বাকিটা পরিদর্শনের সুযোগ হয়নি। শাখাগুলো থেকে উল্লিখিত প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেওয়া ঋণ অস্বাভাবিক ও অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ উল্লেখ করে আমরা বিস্তারিত প্রতিবেদন জমা দিয়েছি। এর বাইরে আর কিছু বলা বোধ হয় ঠিক হবে না।’
অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের অতিরিক্ত পরিচালক মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন স্বাক্ষরিত এক নথিতে দেখা যায়, ‘হালিশহর ও আগ্রাবাদ শাখা পরিদর্শন করা হয় এবং জুবিলী রোড শাখা পরিদর্শন না করার জন্য তৎকালীন নির্বাহী পরিচালক মৌখিক নির্দেশনা দেন।
এ কারণে ওই শাখা পরিদর্শন করা সম্ভব হয়নি।’ এ বিষয়ে তৎকালীন পরিচালক (পরিদর্শন) মোহাম্মদ সেলিম অবহিত আছেন বলেও নথিতে উল্লেখ করা হয়। এতে আরও উল্লেখ করা হয়, পরিদর্শন করা দুই শাখার প্রতিবেদন উপস্থাপনের জন্য নির্বাহী পরিচালকের কাছে পাঠানো হলেও তা অনুমোদিত হয়নি। বিষয়টি তৎকালীন পরিচালক নুরুল আলম অবহিত আছেন বলেও নথিতে উল্লেখ করা হয়।
এ বিষয়ে মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন বলেন, নিয়মিত পরিদর্শনের অংশ হিসেবে আমরা বিভিন্ন ব্যাংকের শাখা পরিদর্শন করার ব্যবস্থা করি। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের উল্লিখিত শাখাগুলো পরিদর্শনে সিদ্ধান্ত হয়। এর পরের প্রক্রিয়াগুলো সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে বিস্তারিত অবহিত করেছি।
এ ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক অ্যাডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী বলেন, ‘যেভাবে ব্যাংকে লুটপাট হয়েছে, তা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের মতো বিশেষায়িত জায়গায়ও মাফিয়াদের বাসা বাঁধার বিষয়টি একেবারে অগ্রহণযোগ্য।’