মাছের তেলে মাছ ভাজা ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ দখলে এ প্রবাদটির মতোই কৌশল নিয়েছিল কুখ্যাত ঋণ জালিয়াত চট্টগ্রামভিত্তিক এস আলম গ্রুপ। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে ইসলামী ব্যাংক থেকে ১ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার ঋণ নিয়ে ওই টাকা দিয়েই বেনামে ইসলামী ব্যাংকের প্রায় ৯ শতাংশ শেয়ার কিনেছিল গ্রুপটি। ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা করেনি ব্যাংকটির তৎকালীন পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ। ব্যাংকটির বিনিয়োগ ও আইন বিভাগের মতামত উপেক্ষা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনাপত্তি ছাড়াই ঋণ দেওয়া হয়। নেওয়া হয়নি পর্যাপ্ত জামানতও। আমলে নেওয়া হয়নি ব্যাংকটিতে নিয়োজিত বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষকের পরামর্শ। একক গ্রাহকের সীমা লঙ্ঘিত হওয়ায় এই ছলচাতুরির আশ্রয় নেওয়া হয়। এমনকি একজন বিদেশি পরিচালককে ওই সভায় অনুপস্থিত রাখতে রাজধানীর একটি হোটেলে গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তাদের দিয়ে আটকে রাখা হয়েছিল। আনুষ্ঠানিকভাবে ব্যাংকটির নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পরও নামে-বেনামে ঋণের নামে লুটপাট অব্যাহত রাখে গ্রুপটি এবং লুটপাটের টাকায়ও বিভিন্ন সময় ব্যাংকটির শেয়ার কেনা হয়। আমাদের সময়ের অনুসন্ধানে ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা ও গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন থেকে এসব ঘটনার সত্যতা মিলেছে। এ ঘটনা ব্যাংক খাতে নজিরবিহীন বলে উল্লেখ করেছেন অর্থনীতিবিদরা।
২০০২ সাল থেকে ইসলামী ব্যাংকের চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ শাখার গ্রাহক এস আলম গ্রুপ। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের বিশেষ আনুকূল্যে গ্রুপটি ইসলামী ব্যাংকসহ একে একে সাতটি ব্যাংক দখলে নিতে সক্ষম হয়। এসবসহ বিভিন্ন ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে লক্ষাধিক কোটি টাকার বেশি হাতিয়ে গ্রুপটির কর্তা-ব্যক্তিরা বিদেশে পালিয়ে গেছেন। সরকার বদলের পর ব্যাংকগুলোর পর্ষদ ভেঙে এস আলমমুক্ত করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সেই সঙ্গে ব্যাংকগুলোর সম্পদের মান যাচাইয়ে বিশেষ নিরীক্ষার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএফআইইউ থেকেও পৃথক তদন্ত হচ্ছে।
ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী, একক ব্যক্তি, পরিবার বা স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান কোনো ব্যাংকের ১০ শতাংশের বেশি শেয়ার ধারণ করতে পারে না। আওয়ামী লীগ সরকারের বিশেষ আনুকুল্যে ইসলামী ব্যাংকের মুষ্টিমেয় শেয়ার কিনে এসব শেয়ারের বিপরীতে প্রতিনিধি পরিচালক নিযুক্ত করে পুরো ব্যাংকের কর্তৃত্ব কব্জায় নিতে সক্ষম হয় এস আলম গ্রুপ। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৫ সালের শেষ দিকে নিয়ম লঙ্ঘন করে এস আলম ভেজিটেবল অয়েল এবং এর সহযোগী প্রতিষ্ঠান সোনালী ট্রেডার্স, এস আলম রিফাইনড ভেজিটেবল অয়েল এবং এস আলম সুপার এডিবল অয়েলÑ এই তিন কোম্পানির নামে ১ হাজার ৭৫০ টাকা ঋণ বের করা হয় ইসলামী ব্যাংক থেকে। পরে অন্য তিনটি বেনামি প্রতিষ্ঠানের নামে ইসলামী ব্যাংকের প্রায় ৯ শতাংশ শেয়ার কেনে এস আলম গ্রুপ। এর মধ্যে এস আলম ভেজিটেবল অয়েল এবং এর সহযোগী সোনালী ট্রেডার্সকে ইসলামী ব্যাংক ঋণ দেয় ৫০০ কোটি টাকা। সোনালী ট্রেডার্স থেকে অর্থ নিয়ে এবিসি ভেঞ্চারস লিমিটেডের নামে ইসলামী ব্যাংকের ২.০১ শতাংশ শেয়ার কেনা হয়। এস আলম সুপার এডিবল অয়েলের নামে ঋণ দেওয়া হয় ৮৫০ কোটি টাকা। এই টাকা দিয়ে প্যারাডাইস ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের নামে ইসলামী ব্যাংকের ২.০১ শতাংশ শেয়ার কেনা হয়। এস আলম ভেজিটেবল অয়েল লিমিটেডের নামে ৪০০ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়। এই টাকা দিয়ে ইউনিগ্লোব বিজনেস রিসোর্সেসের নামে ইসলামী ব্যাংকের ৪.৬৭ শতাংশ শেয়ার কেনা হয়। এ ছাড়া ২০১৬ সালের মধ্যে আরমাডা স্পিনিং মিলস, জেএমসি বিল্ডারস, এক্সেল ডাইং অ্যান্ড প্রিন্টিং, গ্রান্ড বিজনেস লিমিটেড ও ব্লু ইন্টারন্যাশনালের নামেও বেনামি শেয়ার কেনা হয়।
তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি আনুষ্ঠিকভাবে ব্যাংকটি দখলের পর বেনামি এই শেয়ারধারী প্রতিষ্ঠানগুলো থেকেই ব্যাংকটিতে পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়। এর মধ্যে এবিসি ভেঞ্চারসের প্রতিনিধিত্বকারী জয়নাল আবেদীন ও প্যারাডাইস ইন্টারন্যাশনালের প্রতিনিধিত্বকারী মে. জে. (অব.) আব্দুল মতিনকে পরিচালক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। আর এক্সেল ডাইং অ্যান্ড প্রিন্টিং থেকে অধ্যাপক ডা. সিরাজুল ইসলাম, গ্র্যান্ড বিজনেস লিমিটেড থেকে মিজানুর রহমান এবং এক্সেলশিয়র ইমপেক্স কোম্পানি লিমিটেড থেকে সৈয়দ আবু আসাদকে পরিচালক পদে বসানো হয়। এ ছাড়া আরমাডা স্পিনিং মিলের প্রতিনিধিত্বকারী হিসেবে সাবেক আমলা আরাস্তু খানকে ব্যাংকের চেয়ারম্যান এবং জেএমসি বিল্ডারসের পক্ষে মো. শাহাবুদ্দিনকে ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ করা হয়। পরবর্তীতে ইউনিগ্লোব বিজনেস রিসোর্সেস থেকে জামাল মোস্তফা চৌধুরীকে পরিচালক নিয়োগ করা হয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী, ঋণপ্রস্তাবে স্পষ্টভাবে থাকতে হবেÑ কী উদ্দেশ্যে ব্যবহার হবে এবং সেই উদ্দেশ্যেই ঋণ ব্যবহার করতে হবে। অন্য কোনো কাজে ব্যবহারের সুযোগ নেই। ফলে এখানে ঋণের অপব্যবহার হয়েছে। সূত্র মতে, এস আলম গ্রুপকে ব্যাংক লুটপাট ও শেয়ার কেলেঙ্কারিতে সহায়তা করেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক তিন গভর্নর ও বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ। আর ব্যাংকটি আনুষ্ঠানিক দখলে নেওয়ায় সহযোগিতা করেছিল তৎকালীন প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) কর্মকর্তারা।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র হোসনে আরা শিখা মন্তব্য করতে রাজি হননি। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমেদ চৌধুরী আমাদের সময়কে বলেন, এ ধরনের কার্যক্রম ব্যাংক দখলের নতুন মডেল বলে মনে হচ্ছে। আগে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ঋণের টাকায় বেসরকারি ব্যাংকে মূলধন জোগানোর নজির দেখতে পেয়েছি। কিন্তু কখনও বেসরকারি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ওই ব্যাংকেরই শেয়ার কেনার নজির দেখিনি। এগুলো একেবারেই নিয়মের পরিপন্থি কাজ। কারণ, এক উদ্দেশ্যের ঋণ আরেক উদ্দেশ্যে ব্যবহার হয়েছে। এর মানে ব্যাংকের ভেতরের লোকজনও জড়িত ছিল। নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়দায়িত্ব ছিল। এগুলোর পুনরাবৃত্তি রোধে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
যত বেনামি শেয়ার : ব্যাংকটির মোট শেয়ারের ৭৪.৩৩ শতাংশই প্রতিষ্ঠানিক, ১৭.৮৯ শতাংশ বিদেশি, ৭.৬০ শতাংশ পাবলিক এবং দশমিক ১৮ শতাংশ ডিরেক্টর শেয়ার। এ বিষয়ে বিএফআইইউর প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রাতিষ্ঠানিক শেয়ারের ৩০.৫৫ শতাংশ বেনামি। এর মধ্যে এবিসি ভেঞ্চারস লিমিটেডের নামে ২.০১ শতাংশ, এক্সেল ডাইং অ্যান্ড প্রিন্টিংয়ের নামে ৩.৪০ শতাংশ, প্লাটিনাম এনডেভার্স লিমিটেডের নামে ২.০১ শতাংশ, এক্সেলশিয়র ইমপেক্স কোম্পানির নামে ৩.৪০ শতাংশ, গ্র্যান্ড বিজনেস লিমিটেডের নামে ২.০২ শতাংশ, লায়ন হেড বিজনেস রিসোর্সেস লিমিটেডের নামে ২ শতাংশ, প্যারাডাইস ইন্টারন্যাশনালের নামে ২.০১ শতাংশ, আরমাডা স্পিনিং মিলসের নামে ২.০১ শতাংশ, ব্লু ইন্টারন্যাশনালের নামে ২.০১ শতাংশ, কিংসওয়ে এনডেভার্স লিমিটেডের নামে ৪.৪০ শতাংশ, ইউনিগ্লোভ বিজনেস রিসোর্সেসের ৪.৬৭ শতাংশ এবং জেএমজি বিল্ডার্সের নামে ২.০১ শতাংশ শেয়ার ধারণ করা হয়। অন্যদিকে সাবেক ১৩ জন নমিনেটেড পরিচালকের মধ্যে ১২ জনকে বেনামি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে ব্যাংকটির পর্ষদে বসানো হয়েছিল। বাকি একজন ছিলেন বিদেশি শেয়ারহোল্ডার।
বাণিজ্যিক ব্যাংকের পরিচালক নিয়োগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যে বিভাগের অনাপত্তির প্রয়োজন হয়, সেই বিভাগের একজন কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, বিভিন্ন শেল কোম্পানির নামে শেয়ার ধারণ করে ইসলামীসহ একাধিক ব্যাংক দখল করেছিল এস আলম। এসব কোম্পানিতে যাকে সুবিধাজনক মনে করেছিল, তাকে নমিনেটেড করেছে। পরে তাদের মধ্য থেকেই ব্যাংকটির পরিচালক হয়েছেন অনেকে। এসব কাজে সহায়তাকারী হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পাশাপাশি বিএসইসিরও দায় রয়েছে। আগামীতে এমন ঘটনা ঠেকাতে কোনো ব্যাংকে ২ শতাংশের বেশি শেয়ারধারকের প্রকৃত সুবিধাভোগী মালিক বা আলটিমেট বেনিফিশিয়াল ওনার্সের (ইউবিও) ডেটাবেইস করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ জন্য একটি নীতিমালা করা হয়েছে। এ নীতিমালা জারির উদ্দেশ্যই হলো এ ধরনের ফাঁকফোকর বন্ধ করা। এ বিষয়ে বক্তব্যের জন্য বিএসইসির বর্তমান চেয়ারম্যান রাশেদ মাকসুদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
একক গ্রাহকের সীমা লঙ্ঘন : ব্যাংক কেম্পানি আইন অনুযায়ী, কোনো ব্যাংক তার মূলধনের ২৫ শতাংশের বেশি ঋণ একক ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা গ্রুপকে দিতে পারবে না। এর মধ্যে ফান্ডেড ঋণ ১৫ শতাংশ ও নন-ফান্ডেড ১০ শতাংশ। তবে যখন গ্রুপটিকে এই ঋণ দেওয়া হয়, তখন একক গ্রাহকের সর্বোচ্চ ঋণসীমা ছিল মূলধনের ৩৫ শতাংশ। অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা প্রতিবেদনের তথ্য মতে, ২০১৫ সালের ৩১ আগস্ট পর্যন্ত এস আলম গ্রুপের আটটি প্রতিষ্ঠানের নামে ইসলামী ব্যাংকের ঋণ ছিল ১ হাজার ৯৬৮ কোটি টাকা। ওই সময় ঋণের অনুমোদিত সীমার পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা। অর্থাৎ, ২০১৫ সালেই অনুমোদিত সীমা লঙ্গন করে ৫১৮ কোটি টাকা বেশি ঋণ দেওয়া হয়। আগেই সীমা লঙ্ঘনের মতো গুরুতর অনিয়ম থাকলেও নতুন করে বিশেষ সীমায় আরও ১ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়। এর ফলে ২০১৫ সালেই গ্রুপটির মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩ হাজার ৭১৮ কোটি টাকা। তেল, চিনি ও গম আমদানিতে অর্থায়নের জন্য এই ঋণগুলো দেওয়া হয়।
আইন বিভাগের মতামত উপেক্ষা, নেওয়া হয়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনাপত্তি : আইন বিভাগের মতামত পাশ কাটিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনাপত্তি ছাড়াই ২০১৫ সালের ১০ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত বোর্ড সভায় এসব ঋণ অনুমোদন করা হয়। একই গ্রুপের হলেও আলাদা আলাদা প্রতিষ্ঠান দেখিয়ে তিনটি পৃথক বোর্ড মেমো উপস্থাপন করা হয়। প্রধান কার্যালয়ের নির্দেশে শাখা ও জোনাল অফিস থেকে ওই তিনটি ঋণ প্রস্তাব বিনিয়োগ বিভাগে পাঠানো হয়। এরপর করপোরেট বিনিয়োগ বিভাগ ১৯টি সুনির্দিষ্ট আপত্তি জানিয়ে মতামতের জন্য আইন বিভাগে পাঠায়। একই গ্রুপের প্রতিষ্ঠানকে পৃথক প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখানোয় আপত্তি জানায় আইন বিভাগ। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনাপত্তি নেওয়ার বিষয়ে পরামর্শ দেয়। এ ছাড়া বিনিয়োগ বিভাগ থেকেও ঋণসীমা লঙ্ঘন, অপর্যাপ্ত জামানত ও ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবসা ইত্যাদি বিষয় উল্লেখ করে ঋণ না দিতে সুপারিশ করা হয়। কিন্তু সব মতামত ও সুপারিশ পাশ কাটিয়ে ব্যাংকটির তৎকালীন ব্যবস্থাপনা কমিটি তড়িঘড়ি করে ঋণপ্রস্তাবগুলো বোর্ডে পাঠায় এবং ওই দিনই তা অনুমোদন করে পরিচালনা পর্ষদ।
তখন ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার মোস্তাফা আনোয়ার, পরিচালক ছিলেন আবদুস সালাম এফসিএ, যিনি পুনর্গঠিত বোর্ডের বর্তমান পরিচালক এবং অডিট কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন মোহাম্মদ আব্দুল মান্নান (ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের বর্তমান চেয়ারম্যান)। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন জেনারেল ম্যানেজার ইস্কান্দার মিয়া পর্যবেক্ষক হিসেবে বোর্ড সভায় উপস্থিত ছিলেন। অন্যদিকে ১১ সদস্যবিশিষ্ট ম্যানেজমেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন এমডি মোহাম্মদ আব্দুল মান্নান, সদস্যদের মধ্যে ছিলেন মাহবুব উল আলম (পরে এমডি ও এসআইবিএল ব্যাংকের চেয়ারম্যান), শফিকুর রহমান (হজ্জ ফাইন্যান্সের বর্তমান এমডি), তৎকালীন কোম্পানি সচিব আবু রেজা মো. ইয়াহিয়া (বর্তমানে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের এএমডি), মো. শামসুজ্জামান (পরে ডিএমডি এবং এএমডি হিসেবে পদোন্নতি পান), আব্দুস সাদেক ভূঁইয়া (ব্যাংক দখলের পর পদত্যাগে বাধ্য হন) প্রমুখ।
ব্যাংকটির তৎকালীন এমডি মোহাম্মদ আব্দুল মান্নান আমাদের সময়কে বলেন, বিষয়টি ভালো করে মনে নেই। এতটুকু বলতে পারি, সে সময় আমরা অনিয়ম করে কিছু করিনি। কিন্তু ব্যাংকের বোর্ড মিটিংয়ের মেমোতে সীমা অতিক্রম করে ঋণ অনুমোদনের বিষয়টি এসেছে এবং ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ তদন্তেও তৎকালীন ম্যানেজমেন্টকে দায়ী করা হয়েছেÑ এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বোর্ডের মেমোতে কী আছে বা তদন্তে কী এসেছে, আমি জ্ঞাত নই। আমি যখন দায়িত্বে ছিলাম, তখন নিয়ম মেনেই সবকিছু করেছি। এ ছাড়া ঋণ অনুমোদনের বিষয়টি পর্ষদের ব্যাপার। ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ কি ১০০ কোটি টাকার ঋণ দেওয়ার ক্ষমতা রাখে?
এ বিষয়ে তৎকালীন পরিচালনা পর্ষদের পরিচালক আবদুস সালাম এফসিএ আমাদের সময়কে বলেন, আমরা যখন ছিলাম, তখন অনিয়ম হওয়ারই সুযোগ ছিল না। অনিয়মের কথা অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা প্রতিবেদনে এসেছেÑ এ প্রশ্নে তিনি বলেন, এখন এস আলমের ব্যাংক দখলের পরে সব ঋণের বিষয়ে নিরীক্ষা চলছে। আপনি যেটার কথা বলছেন, সেটা আরও আগের ঘটনা। বিষয়টি আমার ভালো করে মনে নেই। তখন এ ধরনের ঘটনা ঘটলে সেটিও দেখা হবে।
জামানতে ব্যাপক ঘাটতি : নতুন করে ১ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা বিশেষ ঋণসীমা অনুমোদনের ফলে গ্রুপটির অনুমোদিত ঋণসীমা বেড়ে হয় ৩ হাজার ২০০ কোটি টাকা। এসব ঋণের বিপরীতে জামানত রাখা ছিল মাত্র ৩৬৩ কোটি ৭০ লাখ টাকা। অথচ জামানত নেওয়ার প্রয়োজন ছিল ৮৮২ কোটি ৮০ লাখ টাকা। ফলে জামানতের ঘাটতি ছিল ৫১৯ কোটি ১০ লাখ টাকা বা ৫৭.৮৫ শতাংশ।
ঋণ অনুমোদনের আগে হট্টগোল : ২০১৫ সালের ১০ সেপ্টেম্বর বিকাল ৩টায় অনুষ্ঠিত পরিচালনা পর্ষদের সভায় পৃথক তিনটি বোর্ড মেমোতে ঋণপ্রস্তাব উপস্থাপন করে তার অনুমোদন দেওয়া হয়। সূত্র বলছে, গ্রুপটির অনুকূলে আগেই সীমার বেশি ঋণ থাকার পরও আবার বিশেষ সীমা বাড়ানো নিয়ে পর্ষদ সভায় ব্যাপক হট্টগোল হয়। শুধু তাই নয়, সভায় অনুপস্থিত রাখতে তৎকালীন ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যান (বিদেশি শেয়ারহোল্ডার) ইউসুফ আব্দুল্লাহ আল-রাজিকে রাজধানীর একটি হোটেলে গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তাদের মাধ্যমে আটকে রাখা হয়। তিনি ছাড়া পেয়ে সন্ধ্যার দিকে ব্যাংকে এলে আবার হট্টগোল বাধে।
জেনেও নিশ্চুপ বাংলাদেশ ব্যাংক : সূত্র মতে, আইন ভেঙে সীমাতিরিক্ত এই ঋণ অনুমোদনের বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি নির্ধারক পর্যায়ের কর্মকর্তারা জানার পরও নিশ্চুপ ছিলেন। গুরুতর অনিয়মের বিষয়টি জেনেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। পর্ষদ সভায় উপস্থিত ছিলেন ইসলামী ব্যাংকে নিয়োগকৃত বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষক ইস্কানদার মিয়া। পর্ষদ সভায় এ বিষয়ে তার মতামত জানতে চাওয়া হলে তিনি এ ধরনের অনৈতিক ঋণপ্রস্তাব বোর্ডে উপস্থাপনই ঠিক হয়নি বলে মন্তব্য করেন এবং বিষয়টি তার পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনের মাধ্যমে তুলে ধরার কথা বলেন। এই ঋণের বিষয়ে অনাপত্তি চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি লেখারও পরামর্শ দেন। কিন্তু তার পরামর্শ আমলে না নিয়ে উল্টো বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর ড. আতিউর রহমানের কাছে নালিশ করেন ব্যাংকটির তৎকালীন পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা। এরপর ওই বছর ডিসেম্বরে ইসলামী ব্যাংকের পর্যবেক্ষকের দায়িত্ব থেকে ইস্কানদার মিয়াকে সরিয়ে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের পর্যবেক্ষকের দায়িত্ব দেওয়া হয় এবং কৃষি ব্যাংকে পর্যবেক্ষকের দায়িত্ব পালন করে আসা তৎকালীন আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগের মহাব্যবস্থাপক মো. শাহ আলমকে ইসলামী ব্যাংকের পর্যবেক্ষকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এ বিষয়ে ইস্কানদার মিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি মন্তব্য করতে রাজি হননি। বক্তব্যের জন্য সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমানের মোবাইলে কল করা হলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়।
এস আলম গ্রুপের ব্যাংক কেলেঙ্কারি পদ্ধতিগতভাবে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ও আলোচিত ব্যাংক লুটের ঘটনা বলে সম্প্রতি মন্তব্য করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। গত ২৮ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংকে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, এস আলম ইতিহাসের প্রথম ব্যক্তি যিনি সুপরিকল্পিতভাবে ব্যাংক লুট করেছেন। এমন সুপরিকল্পিতভাবে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে পৃথিবীতে কেউ ব্যাংক ডাকাতি করেছে কিনা, তা জানা নেই। এটা এমন এক মডেল, যা সব সময় এড়িয়ে যেতে হবে।