Image description

কুরবানির ঈদের মৌসুম ঘিরে চামড়ার বাজার জমজমাট হলেও এর পেছনের পুরো শিল্পটি এখনো নানা চ্যালেঞ্জের মুখে। গরুর চামড়া দিয়ে তৈরি হচ্ছে হ্যান্ডব্যাগ, মানিব্যাগ, বেল্ট, জ্যাকেট, জুতা এমনকি ফার্নিচারের মতো নানান পণ্য। দেশে এসব চামড়াজাত ‘সকাল পণ্যের চাহিদা যেমন বাড়ছে, তেমনি বিশ্ববাজারেও বাংলাদেশের অবস্থান শক্ত করার সুযোগ তৈরি হচ্ছে। তবে মান, দাম, সংরক্ষণ ও পরিবেশ ইস্যু নিয়ে এই সম্ভাবনাময় শিল্প বারবার মুখ থুবড়ে পড়ছে।

চামড়ার মূল মৌসুম কুরবানির ঈদ ঘিরেই। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবার ঢাকায় প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত গরুর চামড়ার দাম নির্ধারণ করেছে ৬০-৬৫ টাকা, যা গত বছরের তুলনায় ৫ টাকা বেশি। ঢাকার বাইরে তা নির্ধারিত হয়েছে ৫৫-৬০ টাকা। পাশাপাশি, একটি গরুর চামড়ার সর্বনিম্ন দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১ হাজার ৩৫০ টাকা।

তবে বাজারে বাস্তবতা ভিন্ন। ঢাকার আড়তে গরুর চামড়া ৬০০-৯০০ টাকায় বিক্রি হলেও চট্টগ্রাম, রাজশাহী বা বরিশালের মতো অঞ্চলে দাম আরও কম। অনেক সময় বড় আকারের গরুর চামড়াও ৪৫০-৫৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে অনেক কম। ট্যানারি মালিক ও আড়তদারদের অভিযোগ, অতিরিক্ত সরবরাহ ও সংরক্ষণ সংকটের কারণে অনেক সময় কম দামে কিনতে হয়, আবার অনেকে দাম ঠিকমতো দিচ্ছেন না বলেও অভিযোগ রয়েছে।

সকাল পণ্যের জগতে চামড়ার রূপান্তর

গরুর চামড়া থেকে তৈরি হচ্ছে নানান ধরনের ‘সকাল পণ্য’ অফিস ব্যাগ, লেডিস পার্স, বেল্ট, জুতা, মানিব্যাগ, সোফা কাভার এমনকি গৃহসজ্জার পণ্য। বিশেষ করে full-grain ও top-grain cowhide leather দিয়ে তৈরি পণ্যের চাহিদা আন্তর্জাতিক বাজারে দিন দিন বাড়ছে।

বাংলাদেশে গড়ে ওঠা কয়েকটি নামকরা লেদার ব্র্যান্ড ইতোমধ্যেই বিদেশি বাজারে প্রবেশ করেছে। ইউরোপ ও আমেরিকায় ক্রেতারা বাংলাদেশের তৈরি হ্যান্ডক্রাফটেড লেদার ব্যাগ বা প্যাশনেবল জ্যাকেটকে পছন্দ করছেন। আবার দেশীয় বাজারেও এমন ব্র্যান্ডের তৈরি পণ্যের প্রতি তরুণ প্রজন্মের আগ্রহ বাড়ছে।

রপ্তানিতে থেমে থাকা গতি

চামড়াজাত পণ্যের বৈশ্বিক বাজার দ্রুত বেড়ে চলেছে। ২০২৫ সালে এ খাতের আকার দাঁড়াবে প্রায় ২.৮ ট্রিলিয়ন ডলার, যা ২০৩৩ সালের মধ্যে ৫.৫ ট্রিলিয়ন ছাড়াবে বলে ধারণা। অথচ বাংলাদেশ এখনো বছরে গড়ে ১০০-১২২ কোটি ডলারের মধ্যে আটকে আছে। ভিয়েতনাম, ভারত এমনকি পাকিস্তানও রপ্তানিতে বাংলাদেশকে ছাড়িয়ে গেছে।

বিশ্লেষকদের মতে, এর পেছনে রয়েছে গুণগত মানের অভাব, পরিবেশবান্ধব উৎপাদন না থাকা এবং ব্র্যান্ডিং ও ডিজাইনিংয়ে দুর্বলতা। যদিও সরকার রপ্তানি উৎসে কর কমিয়ে ১ শতাংশ থেকে ০.৫ শতাংশ করেছে এবং ট্যানারি উন্নয়নে নতুন কর্তৃপক্ষ গঠনের চিন্তা করছে, তবুও কাঙ্ক্ষিত গতি ফেরেনি।

চামড়া সংরক্ষণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় প্রতি বছর হাজার হাজার চামড়া নষ্ট হয়। অতিরিক্ত লবণ ব্যবহার একদিকে পরিবেশ দূষণ বাড়ায়, অন্যদিকে মানও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। হেমায়েতপুরের ট্যানারিগুলো এখনো আন্তর্জাতিক পরিবেশ মানদণ্ডে পৌঁছাতে পারেনি, যা বিদেশি ক্রেতাদের কাছে বাংলাদেশের সুনামহানির অন্যতম কারণ।

পরিবেশবান্ধব ‘সাসটেইনেবল ট্যানিং’ এখন সময়ের দাবি হলেও অনেক ট্যানারি মালিক এ ক্ষেত্রে আগ্রহ দেখান না। প্রযুক্তির অভাব, প্রশিক্ষণহীন কর্মী এবং মনিটরিং দুর্বলতা বিষয়টিকে আরও জটিল করে তুলেছে।

পথ খুঁজছে সম্ভাবনার শিল্প

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গরুর চামড়াকে কাঁচা অবস্থায় কম দামে বিক্রি না করে যদি প্রক্রিয়াজাত করে পণ্য হিসেবে তৈরি করা যায়, তাহলে রপ্তানি আয় অনেক গুণ বাড়ানো সম্ভব। বিদেশে ১০ ডলারের একটি চামড়া দিয়ে তৈরি ব্যাগ ১০০ ডলারে বিক্রি হয়, অর্থাৎ ১০ গুণ মূল্য সংযোজন হয়। কিন্তু বাংলাদেশে এখনো মূলত কাঁচা চামড়া রপ্তানির প্রবণতা দেখা যায়।

পণ্যের বহুমুখিতা, ডিজাইন উদ্ভাবন, আন্তর্জাতিক মান রক্ষা এবং ব্র্যান্ডিং জোরদার করলেই বাংলাদেশ এই খাতে আবারও জাগরণ ঘটাতে পারে।

গরুর চামড়া শুধু একটি কুরবানির মৌসুমি পণ্য নয়, বরং তা হতে পারে বাংলাদেশের অন্যতম বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত। প্রয়োজন শুধু সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি, বাজার মনিটরিং, পরিবেশবান্ধব উৎপাদন ও উদ্যোক্তা মনোভাব। ‘সকাল পণ্য’ হিসেবে পরিচিত এসব চামড়াজাত সামগ্রী হতে পারে দেশের উন্নয়নের নতুন অনুষঙ্গ-যদি আমরা সম্ভাবনাকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারি।