Image description

দেশের ইস্পাত শিল্পের কাঁচামালের অন্যতম জোগানদাতা ‘জাহাজ ভাঙা শিল্প’ বা ‘শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড’। এখান থেকে লাখ লাখ টন কাঁচামাল যায় ইস্পাত শিল্পে। কিন্তু ‘গ্রিন শিপইয়ার্ড’ বাস্তবায়ন প্রকল্পের অনিশ্চয়তার কারণে চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে জাহাজ ভাঙা শিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
জানা যায়, পরিবেশ দূষণ, কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় শ্রমিকদের মৃত্যু এবং শোভন কর্মপরিবেশ সৃষ্টিতে ব্যর্থসহ নানা কারণে এ খাতের দুর্নাম রয়েছে। এসব বিবেচনায় নিয়ে হংকং কনভেনশন অনুযায়ী দেশের শিপ ইয়ার্ডগুলোকে বাধ্যতামূলক গ্রিন ইয়ার্ডে রূপান্তরের নির্দেশনা দেওয়া হয়। তাই দেশের জাহাজ ভাঙার ইয়ার্ডগুলো চলতি বছরের জুনের মধ্যে গ্রিন শিপ রিসাইক্লিং স্ট্যান্ডার্ডে রূপান্তর করা না হলে আর কোনো স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি করতে পারবে না। এমন শর্তে এ শিল্পে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। বাংলাদেশ শিপ রিসাইক্লিং বোর্ডের (বিএসবিআরএ) তথ্যানুসারে, এ পর্যন্ত গ্রিন শিপইয়ার্ডে রূপান্তর হয়েছে সাতটি ইয়ার্ড। এগুলো হলো পিএইচপি শিপ রিসাইক্লিং, এসএন করপোরেশন, কবির স্টিল লিমিটেড, কেআর শিপ রিসাইক্লিং, ম্যাক করপোরেশন, জনতা শিপ ব্রেকিং এবং এইচএম শিপিং। শিল্প মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, এখন পর্যন্ত এ খাতের ৮৫টি প্রতিষ্ঠান গ্রিন ইয়ার্ড বাস্তবায়নে শিপ রিসাইক্লিং ফ্যাসিলিটি প্ল্যান (এসআরএফপি) শিল্প মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান গ্রিন ইয়ার্ড প্রকল্পের কাজ শুরুর অনুমোদন পেয়েছে। তবে চলতি বছরের ২৬ জুনের মধ্যে যেসব প্রতিষ্ঠান গ্রিন ইয়ার্ডে রূপান্তর করবে না, তারা স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি করতে পারবেন না। ফলে শর্ত পূরণ করতে না পারা অধিকাংশ ইয়ার্ডকে প্রয়োজনীয় সনদের জন্য অপেক্ষা করতে হবে, যা এ শিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা বাড়াচ্ছে। তবে গ্রিন শিপইয়ার্ডে রূপান্তরের কাজ চলমান থাকায় জুনের মধ্যে আরও ২০-২২টি ইয়ার্ড অনুমোদন পেলে পরিস্থিতি কিছুটা সামাল দেওয়া যাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, ডলার ঘাটতি, এলসি নিষেধাজ্ঞা, আমদানি জটিলতা এবং স্থানীয়ভাবে স্টিলের চাহিদা কমে যাওয়ায় স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি কমে গেছে। এরই মধ্যে অনেক ইয়ার্ড বন্ধ হয়ে গেছে, ছাঁটাই হয়েছে হাজারো শ্রমিক ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন উদ্যোক্তারা। একই সময়ে ভারত গ্রিন ইয়ার্ড খাতে ব্যাপক অগ্রগতি অর্জন করেছে। তবে পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। এমন পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশটি এ খাতে নেতৃত্ব দিতে কাজ শুরু করেছে।
বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স অ্যান্ড রিসাইক্লার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসবিআরএ) তথ্যমতে, দেশে গত এক দশকে (২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত) বিদেশ থেকে ১ হাজার ৯৮৩টি স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি করা হয়েছে, যার সম্মিলিত ওজন ছিল প্রায় ২ কোটি ৮ লাখ ৫৫ হাজার টন। এর মধ্যে ২০১৬ সালে ২৫২টি জাহাজে রেকর্ড ৩৪ লাখ টন স্ক্র্যাপ আমদানি করা হয়।
দ্য শিপ ব্রেকিং অ্যান্ড রিসাইক্লিং রুলস ২০১১, আন্তর্জাতিক আইন এবং ২০০৯ সালে চীনে অনুষ্ঠিত হংকং কনভেনশন রুলস অনুযায়ী, শিপইয়ার্ডগুলোকে ঢেলে সাজানো হচ্ছে। বাংলাদেশ এ শর্তে চুক্তি করায় চলতি বছরের ২৬জুনের মধ্যে হংকং কনভেনশন সার্টিফিকেশন রুলস অনুযায়ী গ্রিন শিপইয়ার্ডে রূপান্তরের বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
হংকং কনভেনশন অনুযায়ী, ভারতে বর্তমানে গ্রিন ইয়ার্ডের সংখ্যা শতাধিক। এ শিল্প খাতকে পরিবেশবান্ধব করতে দেশটির সরকার আরও ২০ কিলোমিটার এলাকা জাহাজ ভাঙা শিল্পের জন্য বরাদ্দ করতে যাচ্ছে। সেখানে ভারত সরকার নিজস্ব অর্থায়নে উন্নয়নমূলক ও অবকাঠামো নির্মাণ করে ব্যবসায়ীদের কাছে লিজ দেবে। বিএসবিআরএর নির্বাহী কমিটির সদস্য হোসাইনুন আরেফিন দৈনিক জনকণ্ঠকে বলেন, কোভিড-পরবর্তী সময়ে ডলার সংকট ও মূল্যবৃদ্ধি এবং এলসি জটিলতার কারণে ব্যবসায়ীরা স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি করতে পারেননি। এছাড়া ব্যাংক ঋণের সুদ বেড়ে যাওয়ায় অনেকে এ ব্যবসা থেকে সরে গেছেন। আমরা এ খাতের জায়ান্ট থাকলেও বর্তমানে ভারতের কাছে ব্যবসা হারাচ্ছি। দেশটির সরকার যেভাবে তাদের ব্যবসায়ীদের সহায়তা করছে, আমরা সেভাবে সহায়তা পাচ্ছি না।
পিএইচপি শিল্প গ্রুপ ভাটিয়ারিতে গড়ে তুলেছে দেশের প্রথম গ্রিন শিপইয়ার্ড, যা জাহাজ ভাঙা শিল্প নিয়ে মানুষদের ধারণা বদলে দিয়েছে। পরবর্তীতে আরও সাতটি গ্রিন শিপইয়ার্ড গড়ে তোলা হয়েছে। ‘পিএইচপি শিপব্রেকিং অ্যান্ড রিসাইক্লিং ইন্ডাস্ট্রিজ’-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম রিংকু জানান, পিএইচপি ফ্যামিলির মালিকানাধীন এই শিপইয়ার্ড ২০১৭ সালের মাঝামাঝিতে ইতালি থেকে আন্তর্জাতিক গ্রিন সার্টিফিকেট পায়। ইতালিভিত্তিক আন্তর্জাতিক ক্ল্যাসিফিকেশন সোসাইটি (রিনা) নিরাপদ ও ভারসাম্যপূর্ণ পরিবেশে জাহাজ কাটার জন্য এই সার্টিফিকেট দেয়। স্থানভেদে একটি গ্রিন ইয়ার্ড স্থাপনে  ৫০-১০০ কোটি টাকা ব্যয় হয় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা নিজস্ব উদ্যোগে এ অর্থায়ন করে থাকেন। কিন্তু সবার পক্ষে তা সম্ভব হয় না। গ্রিন শিপইয়ার্ডের এই স্বীকৃতি কিন্তু এমনিতেই আসেনি। এ জন্য ঢেলে সাজাতে হয়েছে পুরো ইয়ার্ডকেই। দীর্ঘদিন ধরে চলে এই কর্মযজ্ঞ। এর পেছনে খরচ করতে হয়েছে প্রায় ৭০ কোটি টাকা। এ কারণে ২০১৯ সালে শিল্প মন্ত্রণালয়ে পরিকল্পনা জমা দিয়েও মাত্র ৭টি ইয়ার্ড গ্রিন ইয়ার্ড করতে পেরেছে। অধিকাংশ ব্যবসায়ী এখনো কাজ শুরু করতে পারেননি।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ইয়ং পাওয়ার ইন সোশ্যাল অ্যাকশনের (ইপসা) সমন্বয়ক মোহাম্মদ আলী শাহিন দৈনিক জনকণ্ঠকে বলেন, আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী বাংলাদেশ গ্রিন শিপইয়ার্ডের জন্য রেটিফাই করেছে। এ কারণে জুলাই থেকে গ্রিন সার্টিফায়েড ইয়ার্ড ছাড়া স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি করা যাবে না। অন্যদিকে ভারতে বর্তমানে গ্রিন ইয়ার্ডের সংখ্যা বেশি থাকায় তারা সুযোগটি গ্রহণ করবে। তিনি বলেন, আগামী ১০-১৫ বছরে অন্তত ১৫ হাজার জাহাজ স্ক্র্যাপ হিসেবে বিক্রি হবে। তাই বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের এখন গ্রিন ইয়ার্ডের মনোযোগ দিতে হবে। নয়তো এত বড় বাজার আমাদের হাতছাড়া হয়ে যাবে।
বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স অ্যান্ড রিসাইক্লার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসবিআরএ) উপদেষ্টা কামাল আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, হংকং কনভেনশন সার্টিফিকেশন রুলস অনুযায়ী শিপইয়ার্ডগুলোকে গ্রিন ইয়ার্ডে রূপান্তর করতে শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সেই নির্দেশনা অনুযায়ী, দেশের বেশ কিছু শিপইয়ার্ড আধুনিকায়ন এবং শোভন কর্মপরিবেশ  তৈরি করছে এবং আরও কিছু কাজ চলামন রয়েছে। এক্ষেত্রে আমাদের সরকারের প্রণোদনা দেওয়া উচিত। কারণ ডলার সংকটে আমাদের ব্যবসা আগের মতো নেই।