
অবশেষে ঋণের কিস্তি ছাড় করছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফ। তবে এ জন্য মার্কিন ডলারের বিনিময় হারে ছাড় দিতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। কারণ আইএমএফ চেয়েছিল বাংলাদেশ বাজারভিত্তিক বিনিময় হার চালু করুক। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক তাতে সায় না দেয়ায় একপর্যায়ে ঋণের কিস্তি ছাড় পেতে অনেকটা অনিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল। অবশেষে বাংলাদেশ কিছুটা নমনীয় হওয়ায় আন্তর্জাতিক সংস্থাটি তার চলমান ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ কর্মসূচির আওতায় বাংলাদেশকে দুই কিস্তির অর্থ ছাড় করতে যাচ্ছে। সংস্থাটি দুই কিস্তিতে বাংলাদেশকে ১৩০ কোটি ডলার দেবে। আগামী মাসে অর্থাৎ জুনের মধ্যেই মিলতে পারে এই অর্থ। এ বিষয়ে আজ বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংক এক সংবাদ সম্মেলন ডেকেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান জানান, ঋণের কিস্তি ছাড়ের বিষয় আইএমএফ ইতিবাচক। সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে বিস্তারিত জানানো হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক এ সংস্থাটি বাংলাদেশকে ঋণের কিস্তি ছাড় দেয়ার জন্য শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তা শর্ত বাস্তবায়নের বিষয়ে অনড় ছিল। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকও ছাড় দিতে নারাজ ছিল। সর্বশেষ গত ৭ মে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাথে আইএমএফের দুই দিনের উচ্চপর্যায়ের বৈঠক শেষ হয়। ওই বৈঠক শেষেও সংস্থাটি ঋণের কিস্তি ছাড়ের বিষয়ে পরিষ্কার কিছু জানাচ্ছিল না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক বরাবরই ডলারের বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে নারাজ ছিল। এ বিষয়ে যুক্তি হলো, এমনিতেই জিনিসপত্রের দাম বেশি। নানাভাবে চেষ্টা করে পণ্য মূল্য কমিয়ে আনা হচ্ছে। ডলারের দাম বেড়ে গেলে পণ্যের দাম বিশেষ করে শিল্পের কাঁচামাল আমদানি ব্যয় বেড়ে যাবে। এতে বেড়ে যাবে পণ্যের দাম। এর সামগ্রিক প্রভাব পড়বে মূল্যস্ফীতিতে। এ ছাড়া রেমিট্যান্সের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আসছে। বৈদেশিক দায়ও পরিশোধ করা হচ্ছে। বিশেষ করে জ্বালানি তেলের বকেয়া দায় প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। এ কারণে এ মুহূর্তে আইএমএফের শর্ত মেনে ঋণ নিলে মূল্যস্ফীতি আরো বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হয়। এ জন্য আইএমএফের শর্ত মেনে নিতে নারাজ ছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। আর এ কারণেই ৭ মের বৈঠকে ঋণদাতা সংস্থাটির পক্ষ থেকে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, আইএমএফ নমনীয় বিনিময় হার বাস্তবায়নের ওপর জোর দিচ্ছে, যেখানে ছোটখাটো পরিবর্তনের বাইরে গিয়ে একাধিক বিনিময় হার তুলে দেয়ার কথা বলা হচ্ছে। তবে অর্থমন্ত্রণালয় এক বিবৃতির মাধ্যমে জানায়, ‘অর্থনীতির ভিত্তি মজবুত করতে আইএমএফের সাথে চুক্তির আওতায় যেসব শর্ত নির্ধারিত হয়েছে, তা পূরণের পরই ঋণের কিস্তি ছাড়া হয়। এসব শর্তের অনেকগুলো বাস্তবায়নে সময় লাগে।’ এতে আরো বলা হয়, ‘তাই পারস্পরিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তি একত্রে ছাড়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।’ অর্থ মন্ত্রণালয় জানিয়েছিল, এপ্রিলের পর্যালোচনা এবং ২০২৫ সালের জুনে আইএমএফ বোর্ডের অনুমোদন পাওয়ার পর জুন মাসেই এই দুই কিস্তি একসাথে ছাড়া হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, সরকারের নীতিনির্ধারণী মহল বিনিময় হার বিষয়ে আইএমএফের শর্ত পরিপালনে কিছুটা নমনীয় হতে বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নরকে অনুরোধ করা হয়। আর এরই পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কিছুটা নমনীয় হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট দু’জন কর্মকর্তার সাথে কথা বলে জানা গেছে, মার্কিন ডলারের দাম এখন যে পদ্ধতিতে নির্ধারণ করা হচ্ছে, ভবিষ্যতেও সেভাবেই হবে। তবে বাজারের চাহিদার ওপর নির্ভর করে দাম আরো হ্রাস-বৃদ্ধির সুযোগ থাকবে। টাকা-ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণে যে পদ্ধতি ঠিক করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক, সেটি ‘ক্রলিং পেগ’ নামে পরিচিত। এ ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রতি ডলারের বিপরীতে বর্তমানে ১১৯ টাকা দামের সাথে ২ দশমিক ৫ শতাংশ পর্যন্ত দাম বাড়তে ও কমতে পারে। এর ফলে ডলারের দাম এখন সর্বোচ্চ ১২৩ টাকার মধ্যে রয়েছে। এ বিষয়ে আজ বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর সংবাদ সম্মেলন ডেকেছেন। তিনি অবশ্য সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) দুবাই থেকে ভার্চুয়ালি সংবাদ সম্মেলনে যুক্ত হবেন। বাংলাদেশ ব্যাংক এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানিয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে আইএমএফের ঋণছাড়ের বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পাশাপাশি আইএমএফের পক্ষ থেকেও শিগগিরই কিস্তি ছাড়ের বিষয়ে বিবৃতি দেয়া হবে বলে জানা গেছে।
প্রসঙ্গত, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সাথে বাংলাদেশের ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ কর্মসূচি শুরু হয় ২০২৩ সালের ৩০ জানুয়ারি। তা থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত তিনটি কিস্তিতে ২৩১ কোটি ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ। এই ঋণের বাকি আছে আরো ২৩৯ কোটি ডলার।