
এক ডজনেরও বেশি ব্যাংকে মন্দ ঋণের পরিমাণ উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। আগের সরকারের সময় এসব ব্যাংক ঋণ অনিয়ম ও আর্থিক কেলেঙ্কারিতে নিমজ্জিত ছিল। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর পূর্ববর্তী সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক থাকা বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাপকভাবে খেলাপি হয়েছে।
গত বছর শেষে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল তিন লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা। এর সিংহভাগই নেওয়া হয়েছিল রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে—২০২৪ সাল শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ রেকর্ড ৬৭ হাজার ১৪৮ কোটি টাকা হয়। এটি প্রতিষ্ঠানটির মোট বিতরণ করা ঋণের ৭২ শতাংশ।
জনতা ব্যাংকের খেলাপি এক বছরের ব্যবধানে বেড়েছে ২৮৪ শতাংশ। ২০২৩ সাল শেষে তা ছিল ১৭ হাজার ৫০১ কোটি টাকা বা মোট ঋণের ১৯ দশমিক দুই শতাংশ।
এক সময়ের স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান জনতা ব্যাংক বিগত সরকারের আমলে অ্যানটেক্স, ক্রিসেন্ট, বেক্সিমকো, থার্মেক্স ও এস আলম গ্রুপসহ নানা প্রতিষ্ঠানের একের পর এক কেলেঙ্কারি ও ঋণ অনিয়মের কারণে কুখ্যাতি অর্জন করে।
এই পাঁচ প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ৪৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।
ব্যাংকটিতে এখন তারল্যের সংকট দেখা দিয়েছে। নগদ অর্থ সংকট কাটাতে সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে ২০ হাজার কোটি টাকার তারল্য সহায়তা চেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
গত সপ্তাহে জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মজিবুর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আগস্টে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকে ব্যাংকের নতুন ব্যবস্থাপনা ঋণ অনিয়ম নিয়ে কাজ করছে।'
এখন খেলাপিদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
ন্যাশনাল ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ২০২৪ সালের শেষে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১০৯ শতাংশ বেড়ে ২৫ হাজার ৮৪৬ কোটি টাকা হয়েছে। এটি মোট বিতরণ করা ঋণের ৬১ শতাংশ।
গত বছরের আগস্টে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর ন্যাশনাল ব্যাংকসহ ১১ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
দেশে প্রথম বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক ন্যাশনাল ব্যাংকের অতীত সমৃদ্ধ ছিল। তবে ব্যাপক ঋণ অনিয়ম, দুর্বল সুশাসন ও বোর্ডরুম দ্বন্দ্বের কারণে এটি লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ১৬ বছরের শাসনামলে ব্যাংকটিতে একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল ব্যবসায়ী গোষ্ঠী সিকদার গ্রুপের। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ব্যবসায়ী ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টুকে ন্যাশনাল ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।
ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের খেলাপি ঋণ ২০২৪ সাল শেষে ৩২ হাজার ৮১৭ কোটি টাকা হয়েছে। এটি আগের বছর ছিল ছয় হাজার ৯১৯ কোটি টাকা। এটি প্রতিষ্ঠানটির মোট ঋণের ২১ শতাংশ।
মূলত বিতর্কিত ব্যবসায়িক গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের কারণে ইসলামী ব্যাংক সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই গোষ্ঠী গত বছরের আগস্টের মাঝামাঝি পর্যন্ত ব্যাংকের পর্ষদে আধিপত্য বিস্তার করেছিল।
ইসলামী ব্যাংকের মোট এক লাখ ৫৫ হাজার ৬৫৯ কোটি টাকার ঋণের ৮০ শতাংশের বেশি নিয়েছে চট্টগ্রামের এই শিল্পগোষ্ঠী ও এর সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো।
এস আলম গ্রুপের প্রভাবে থাকা অন্য ব্যাংকগুলো হলো ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক। গত বছর এই ব্যাংকগুলোয় মন্দ ঋণের পরিমাণ বেড়ে যায়।
বছরের ব্যবধানে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ১৫ হাজার ৭১০ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ১৭ হাজার ৮৫১ কোটি টাকা হয়। ইউনিয়ন ব্যাংকের খেলাপি ২৩ হাজার ৯৯২ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ২৪ হাজার ৮৩৫ কোটি টাকা ও কমার্স ব্যাংকের ২২৪ কোটি টাকা থেকে বেড়ে এক হাজার ৪৩২ কোটি টাকা হয়।
গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি চার হাজার ২১৬ কোটি টাকা থেকে চার হাজার ৪৪২ কোটি টাকা হয়েছে।
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক এসব ব্যাংকের বোর্ড ভেঙে নতুন বোর্ড নিয়োগ দিলে ব্যাংকগুলো এস আলম গ্রুপের প্রভাবমুক্ত হয়।
এসব ব্যাংকের কর্মকর্তারা ডেইলি স্টারকে জানান, এস আলম গ্রুপ ও এর আওতাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেওয়া ঋণের বড় অংশ খেলাপি।
গত বছর শেষে এবি ব্যাংকের খেলাপি হয় আট হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা। এর আগের বছর ছিল পাঁচ হাজার ২৭২ কোটি টাকা। একই সময়ে আইএফআইসি ব্যাংকের খেলাপি ১৪ হাজার ৬০৩ কোটি টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ১৭ হাজার ১৮২ কোটি টাকা।
ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান আইএফআইসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন। সরকার পতনের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক আইএফআইসির বোর্ড পুনর্গঠন করে। সালমান এফ রহমানের নেতৃত্বাধীন ব্যবস্থাপনাকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
ব্যাংকটির কর্মকর্তারা ডেইলি স্টারকে জানান, সালমান এফ রহমানের বেক্সিমকো গ্রুপের মাত্র ছয় শতাংশ শেয়ার থাকলেও গ্রুপটি আইএফআইসির ওপর বেশ প্রভাব বিস্তার করেছে। প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা ঋণ পেয়েছে। এটি ব্যাংকের জন্য বড় ঝুঁকি তৈরি করেছে।
রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ২৭ হাজার ৯৩২ কোটি টাকা। মোট ঋণের ৩৮ দশমিক ৪৫ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নথি অনুসারে—বসুন্ধরা, ওরিয়ন, জাকিয়া ও জজ ভূঁইয়া গ্রুপসহ কয়েকটি বড় প্রতিষ্ঠান অতিরিক্ত ঋণ নেওয়ায় ব্যাংকটি বিপাকে পড়েছে।
এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণাধীন সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি বেড়ে হয়েছে ১৩ হাজার ২৬৭ কোটি টাকা। এটি মোট বিতরণ করা ঋণের ৩৫ শতাংশ।
পদ্মা ব্যাংকের খেলাপি বেড়ে হয়েছে চার হাজার ৮৭০ কোটি টাকা। মোট ঋণের ৮৭ শতাংশ। যাত্রা শুরুর কয়েক বছরের মাথায় ব্যাপক কেলেঙ্কারি ও ঋণ অনিয়মের কবলে পড়ে ব্যাংকটি।
আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের খেলাপি ছিল সবচেয়ে বেশি। গত বছর শেষে ঋণের ৯১ শতাংশই ছিল মন্দ ঋণ।
ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন—আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বড় ঋণগ্রহীতারা খেলাপি হয়ে পড়ায় ২০২৪ সালে খেলাপি ঋণ বেড়েছে। এটি সামগ্রিকভাবে মন্দ ঋণকে নজিরবিহীন পর্যায়ে ঠেলে দিয়েছে।
তারা জানান, আরও স্বচ্ছতার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনার কারণে ব্যাংকগুলো লুকানো খেলাপি ঋণসহ আরও সঠিক পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে।