ছিটমহল বিনিময়ের কথা হঠাৎ কেন তুলছে ভারতের কংগ্রেস?
বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের ছিটমহল বিনিময় সম্পন্ন হয়েছে ২০১৫ সালের ৩১শে জুলাই আর পয়লা অগাস্টের মাঝরাতে। তার প্রায় নয় বছর পরে, লোকসভা নির্বাচনের আগে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস সেই প্রসঙ্গ তুলে এনেছে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর একটি ভাষণের জবাব দিতে গিয়ে কংগ্রেস তারই পুরনো একটি বিবৃতি তুলে ধরে বলেছে, ২০১৫ সালে বাস্তবায়িত “স্থল সীমা চুক্তি শুধু ভূমি পুনর্বিন্যাস ছিল না, সেটা ছিল হৃদয় মিলে মিশে যাওয়ার মতো ঘটনা।“
কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়্গে আসলে নরেন্দ্র মোদীর তোলা একটি গুরুতর অভিযোগের জবাব দিতে গিয়ে ভারত-বাংলাদেশের স্থল সীমা চুক্তির প্রসঙ্গ টেনে এনেছে।
মি. মোদী অভিযোগ করেন, “নতুন তথ্য সামনে এসেছে যে কীভাবে বোকার মতো কংগ্রেস কচ্ছথিভু দিয়ে দিয়েছিল।“
কচ্ছথিভু একটি ছোট দ্বীপ, দুই বর্গ কিলোমিটারেরও কম আয়তন এর। শ্রীলঙ্কা আর ভারতের মধ্যে পক প্রণালীতে অবস্থিত এই ছোট্ট দ্বীপটি। শ্রীলঙ্কা এবং ভারত দুই দেশই এই দ্বীপটি নিয়ে দাবী-পাল্টা দাবী জানিয়ে আসছিল। অবশেষে, ১৯৭৪ সালে ওই দ্বীপের ওপর থেকে ভারত তার দাবী তুলে নেয়।
এ নিয়ে তামিলনাডুর স্থানীয় রাজনীতি একাধিকবার উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। কংগ্রেসের বিরোধিতা করতে গিয়ে মি.মোদীই প্রথমবার জাতীয় রাজনীতিতে বিষয়টিকে সামনে নিয়ে এলেন।
সামাজিক মাধ্যম এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যাণ্ডেলে ওই ঘটনাকে মি. মোদী ‘চোখ খুলে দেওয়ার মতো’ এবং ‘ভয়াবহ’ বলে বর্ণনা করেছেন।
তিনি লিখেছেন, “এটা প্রতিটি ভারতীয়কে রাগিয়ে দিয়েছে এবং মানুষের মনে এ কথা আবারও পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছে যে কংগ্রেসকে কখনই বিশ্বাস করা যায় না। ভারতের ঐক্যকে দুর্বল করা, ভারতের স্বার্থে আঘাত করাই ৭৫ বছর ধরে কংগ্রেসের কাজের ধরন।”
কচ্ছথিভু নিয়ে বিতর্ক কেন?
ভারতের ইংরেজি দৈনিক টাইমস অফ ইন্ডিয়ার একটি প্রতিবেদন থেকে কচ্ছথিভু নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। ওই পত্রিকার লিখেছিল যে, ভারত সরকারের ‘উদাসীন মনোভাব’-এর কারণে ১৯৭৪ সালে কচ্ছথিভু দ্বীপটি শ্রীলঙ্কার হাতে চলে যায়।
তামিলনাড়ুর বিজেপি প্রধান কে আন্নামালাইয়ের দায়ের করা তথ্যের অধিকার আইন অনুযায়ী আবেদন থেকে বিষয়টি জানা গেছে বলে পত্রিকাটি জানায়।
রবিবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী একটি জনসভায় ভাষণ দিতে গিয়ে যেমন বিষয়টি উত্থাপন করেন, তেমনই সেদিনই তিনি এক্স হ্যান্ডেলেও লেখেন।
তারপরে সাংবাদিক বৈঠক করেন বিদেশ মন্ত্রী এস জয়শঙ্করও।
সেখানে তিনি বলেন, “ডিএমকে (দ্রাবিঢ় মুনেত্রা কাঝাগম তামিলনাডুর ক্ষমতাসীন দল) আর কংগ্রেস এমন আচরণ করছে যে সবকিছুই কেন্দ্রীয় সরকারের দায় আর তারা যেন কিছুই করে নি। বিষয়টি নিয়ে যেন এখনই শুধু আলোচনা হচ্ছে, এর যেন কোনও ইতিহাস নেই। এটা এখন আলোচনায় এজন্য উঠে এসেছে যে মানুষ জানতে চাইছেন এই বিতর্ক কীভাবে শুরু হয়েছিল? সংসদে একাধিকার এই দ্বীপ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
“আমি নিজে ২১ বার তামিলনাডু সরকারকে জবাব দিয়েছি। তৎকালীন বিদেশ সচিব ও তখনকার তামিলনাডুর মুখ্যমন্ত্রী করুণানিধির মধ্যে ১৯৭৪ সালে কথা হয় কচ্ছথিভুর ওপরে ভারত আর শ্রীলঙ্কা দুই পক্ষেরই দাবি আছে।“
তবে এর আগে ২০২২ সালে মি. জয়শঙ্করেরই মন্ত্রক – বিদেশ দফতর সংসদের উচ্চ কক্ষ রাজ্যসভায় জানিয়েছিল যে ‘ভারত-শ্রীলঙ্কা আন্তর্জাতিক সামুদ্রিক সীমা রেখার শ্রীলঙ্কার দিকে অবস্থিত কচ্ছথিভু।“
আবার ২০১৩ সালে কংগ্রেস যখন ক্ষমতায় ছিল, তারা সুপ্রিম কোর্টকে জানিয়েছিল যে ভারতের কোনও ভূখণ্ডই শ্রীলঙ্কার হাতে তুলে দেওয়া হয় নি।“
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে মাছ ধরার অনুমতি
নথিতে দেখা যায়, ভারতীয় উপকূল থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে ১.৯ বর্গকিলোমিটার জমি নিয়ে এই দ্বীপটি অবস্থিত।
কয়েক দশক ধরে ভারত এই দ্বীপটি নিজেদের বলে দাবি করে আসছিল, কিন্তু তারপর সেই দাবী থেকে তারা সরে আসে।
শ্রীলঙ্কা আগে সিলন নামে পরিচিত ছিল। দেশটি ১৯৪৮ সালে স্বাধীন হওয়ার ঠিক পরে দ্বীপটি দাবি করেছিল। তারা বলেছিল যে ভারতীয় নৌবাহিনী (তৎকালীন রয়্যাল ইন্ডিয়ান নেভি) তাদের অনুমতি ছাড়া কচ্ছথিভুতে সামরিক মহড়া করতে পারবে না।
এরপরে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু বলেছিলেন যে ওই দ্বীপটির বিশেষ কোনও গুরুত্ব নেই এবং দ্বীপটির ওপরে নিজেদের দাবি ছেড়ে দিতেও কোনও দ্বিধা নেই।
জানা যায় যে ১৮৭৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দ্বীপের আশেপাশে মাছ ধরার জন্য অনুমতি দিয়েছিল স্থানীয় রামনাথপুরের রাজাকে। ভারত স্বাধীন হওয়ার পরে ওই রাজার জমিদারি স্বাভাবিকভাবেই মাদ্রাজ রাজ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়।
“কচ্ছথিভু নিয়ে ভারতের দাবী কতটা জোরালো, তা নিয়ে সন্দেহ আছে,” লিখেছেন কচ্ছথিভুর ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর সাউথ এন্ড সাউথ এশিয়ান এফেয়ার্সের সাবেক পরিচালক ভি সুর্য্যনারায়ন
মি. সুর্য্যনারায়নের বেশ কয়েকটি বই আছে কচ্ছথিভু দ্বীপ নিয়ে।
তার মতে, “শ্রীলঙ্কায় সিরিমাভো বন্দরনায়েকের ক্রমহ্রাসমান জনপ্রিয়তা রোখার জন্য কচ্ছথিভু নিয়ে একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার দরকার ছিল। সেখানকার বামপন্থী দলগুলো সন্দেহ করত যে ভারত তার প্রতিবেশীদের ওপরে খবরদারি বাড়াতে চলেছে। উদাহরণস্বরূপ তারা কচ্ছথিভুর কথা বলত। কচ্ছথিভুর অধিকার শ্রীলঙ্কাকে দিয়ে সেই সন্দেহ দূর করার চেষ্টা হয়েছিল।“
তিনি আরও লিখেছেন, “১৯৭৪ সালের চুক্তিতে ভারতীয় মৎস্যজীবীদের কিছু অধিকার দেওয়া হয়েছিল। আবার ১৯৭৬ সালের চুক্তিতে সেই সব অধিকার বাতিল করা হয়। এভাবেই কচ্ছথিভুর ওপরে সব অধিকার হারায় ভারত। তৎকালীন তামিলনাড়ু সরকার (ডিমএকে তখন ক্ষমতায় ছিল) কচ্ছথিভুকে শ্রীলঙ্কার হাতে তুলে দেওয়ার বিষয়টির তীব্র বিরোধিতা করেছিল। “
‘ছিটমহল বিনিময়ের সঙ্গে তুলনীয় নয় কখনই’
কচ্ছথিভু দ্বীপের ওপর থেকে ভারতের দাবি তুলে নেওয়ার সঙ্গে ভারত-বাংলাদেশের স্থল চুক্তি বাস্তবায়ন কখনই তুলনীয় নয় বলে মনে করছেন সাবেক ছিটমহলের নেতৃত্ব।
দুই দেশের মধ্যে স্থল সীমা চুক্তি বাস্তবায়ন করে ১৬২টি ছিটমহল বিনিময় হয় ২০১৫ সালের ৩১শে জুলাই আর পয়লা অগাস্টের মাঝরাতে। ৫১টি বাংলাদেশী ছিটমহল মিশে গিয়েছিল ভারতের সঙ্গে আর ১১১টি ভারতীয় গ্রাম হয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশের অঙ্গ।
স্থল চুক্তি বাস্তবায়নের দাবি তুলে দুই দেশের ছিটমহল-বাসীদের বাসিন্দারা যে আন্দোলন করেছিলেন, তার নেতা ছিলেন দীপ্তিমান সেনগুপ্ত।
তিনি বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, “কচ্ছথিভু দ্বীপের ঘটনা ছিটমহল বিনিময়ের সঙ্গে তুলনীয় নয় কখনই। আর ছিটমহল বিনিময়ে মি. মোদীর সরকারের ভূমিকা ছিল একান্তই বাস্তবায়নের। নেহরু-নূন চুক্তি, তারপরে ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি আর খালেদা জিয়া-নরসীমা রাও চুক্তি – এগুলোই ছিল স্থল সীমা চুক্তির ভিত্তি। সেই অনুযায়ীই আমাদের দীর্ঘদিনের আন্দোলনের ফসল হচ্ছে ২০১৫ সালে ঐতিহাসিক ছিটমহল বিনিময়।
“আর এই চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য কংগ্রেস-বিজেপি-বাম-তৃণমূল কংগ্রেস সকলেই কিন্তু সমর্থন করেছিল। তাই কোনও একটি দল ছিটমহল বিনিময় করিয়েছে, এভাবে দেখাটাও অনুচিত, “ বলছিলেন দীপ্তিমান সেনগুপ্ত।