Image description

যুক্তরাষ্ট্রে চলতি বছরের প্রথম ২৫ দিনেই ৩৯টি বন্দুক হামলার ঘটনা ঘটেছে। এতে প্রাণ হারিয়েছেন ৫১ জন। এই পরিস্থিতি আবারও সামনে এসেছে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নকে। গত সোমবার কংগ্রেসে এই সংক্রান্ত একটি বিলও উত্থাপন করা হয়। এই বিল পাস করার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তবে এখনই এই বিল পাস হওয়ার সম্ভাবনা কম বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের শঙ্কা, আগের বছরগুলোর মতোই ২০২৩ সালে অস্ত্র সহিংসতার মাত্রা ভয়াবহ আকারেই থাকবে। অস্ত্র ব্যবসায়ী আর আইনপ্রণেতাদের যোগসাজশ তথা লবির বিস্তৃত ভূমিকার কারণেই সেখানে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয় না বলে দাবি বিশ্লেষকদের।

যুক্তরাষ্ট্রের গান ভায়োলেন্স আর্কাইভের বরাত দিয়ে মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন জানিয়েছে, ২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ৬৯১টি বন্দুক হামলার ঘটনা ঘটে। এতে প্রাণ হারায় অন্তত ৭০৬ জনের। আহত হন ১১৫ জন। ২০২২ সালে ৬৪৮টি বন্দুক হামলার ঘটনা ঘটে। এসব হামলায় ৬৭৩ জন নিহত এবং কয়েকশ আহত হয়েছেন। আর চলতি বছর এক মাস না যেতেই এই সংখ্যা অর্ধশতাধিক।

যুক্তরাষ্ট্রের সর্বশেষ ৪৪ ঘণ্টায় তিনটি বন্দুক হামলা হয়েছে, প্রাণ হারিয়েছেন ১৮ জন। আর এর সবই হয়েছে ক্যালিফোর্নিয়ায়। মনটেরি পার্ক এলাকায় নিহতদের বয়স ৫৭ থেকে ৭৬ বছর। শনিবার রাতে তারা নতুন বছর উদযাপন করছিলেন। সে সময়ই হামলা হয়। কর্তৃপক্ষ হতাহতদের নাম প্রকাশ করার আগেই আবার হামলার ঘটনা ঘটে ক্যালিফোর্নিয়ায়। 

সোমবারের হামলায় প্রাণ হারায় আরও সাতজন। এবারের লক্ষ্যবস্তু হয়েছেন অভিবাসী শ্রমিকরা। তারা মাশরুম ক্ষেতে মোবাইল হোমে থাকতেন। এরপর ওকল্যান্ড। এই হামলায় প্রাণ হারাল একজন।

এমন পরিস্থিতিতে সোমবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন কংগ্রেসে হাই ক্যাপাসিটি ম্যাগজিন ও আধুনিক মারণাস্ত্র ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিল উত্থাপন করেন। আর অস্ত্র কেনার সর্বনিম্ন বয়স ২১ করার ব্যাপারে তিনি জোর দেন। এক বিবৃতিতে বাইডেন বলেন, অধিকাংশ মার্কিন জনগণ কমনসেন্স অ্যাকশনের ব্যাপারে একমত। আমাদের শিশু, সমাজ ও জাতির প্রতি যে দায়বদ্ধতা এর চেয়ে বড় কিছু নেই।

আমেরিকান একাডেমি অব পেডিয়াট্রিকস প্রকাশিত জার্নালে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রে ২৩ বছরের কম বয়সিদের মৃত্যুর প্রধান কারণ বন্দুক হামলা। ২০১৫ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ১৮ বছরের কম বয়সিদের হাতে অন্তত ২ হাজার ৭০টি বন্দুক হামলা সংঘটিত হয়েছে। এতে প্রাণ হারিয়েছে ৭৬৫ জন। আহত হয়েছেন ১ হাজার ৩৬৬ জন। আর গত তিন দশকের হিসেবে দেখা যায় বন্দুক হামলায় মৃত্যুর সংখ্যা ১০ লাখ। গবেষকরা জানিয়েছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই সংখ্যা বেড়েছে। করোনা মহামারির সময় ২০-২৪ বছর বয়সি প্রতি এক লাখ কৃষ্ণাঙ্গের মধ্যে বন্দুক হামলায় প্রাণ হারান ১৪২ জন। ২০২১ সালের মৃত্যুর তুলনায় যা প্রায় ১০ গুণ।

সুইজারল্যান্ডভিত্তিক সংগঠন স্মল আর্ম সার্ভের হিসাব অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রে এখন ২৯ কোটি ৩০ লাখ অস্ত্র রয়েছে সাধারণ মানুষের হাতে। অর্থাৎ গড়ে প্রতি ১০০ মার্কিনির জন্য কাছে অস্ত্র রয়েছে ১২০টি। তবে অনিবন্ধিত অস্ত্র ও অবৈধ বাণিজ্যের কারণে সঠিক সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের। গ্যালাপ জরিপের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ৪৫ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মার্কিনি জানিয়েছেন, তারা বাড়িতে অন্তত একটি অস্ত্র রাখেন।

বিশ্বে আর কোনো দেশে এত সংখ্যক অস্ত্র বেসামরিকদের কাছে নেই। তালিকায় যুক্তরাষ্ট্রের পরের অবস্থানে থাকা দেশটি ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জ। ব্রিটিশদের দাবি করা এই বিরোধপূর্ণ ভূখণ্ডে প্রতি ১০০ জন বেসামরিকের কাছে অস্ত্র রয়েছে ৬২টি। যা শীর্ষে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় অর্ধেক। আর এরপরে রয়েছে সাত বছর ধরে চলা যুদ্ধবিধ্বস্ত ইয়েমেনে। তাদের প্রতি ১০০ মানুষের মধ্যে অস্ত্র রয়েছে ৫৩ জনের।

২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ৯০ লাখ অস্ত্র উৎপাদন হয়েছে। ২০০৮ সালের সাপেক্ষে যা দ্বিগুণ। আর ২০২১ সালে উৎপাদিত অস্ত্রের পরিমাণ ছাড়িয়ে গেছে আগের রেকর্ড। ২০২০ সালের তুলনায় যা ৬০ শতাংশ বেশি।

মার্কিনিদের মধ্যে আগ্নেয়াস্ত্রের ওপর সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণের প্রত্যাশা থাকলেও প্রশাসন বরাবরই তা বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ। মার্কিন সংবিধানের দ্বিতীয় সংশোধনীতে দেশটির নাগরিকদের ব্যক্তিগতভাবে আগ্নেয়াস্ত্র রাখার বৈধতা দেওয়া হয়। গান লবিগুলো এই ধারাই সামনে এনে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করে। জরিপ অনুযায়ী গড়ে প্রতিদিন যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুকের গুলি কেড়ে নেয় ৯৬ মানুষের প্রাণ। বছরের পর বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে চলমান হামলায় ক্ষোভ বাড়তে শুরু করে সমাজে। বছর চারেক আগেও এই আইন কঠোরের দাবিতে রাজপথে নেমেছিল অনেক মানুষ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আইনে কাক্সিক্ষত পরিবর্তন আসেনি।

যুক্তরাষ্ট্রে বছরে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু নিয়ে প্রায় সময় বিদ্যমান অস্ত্র আইন এবং অস্ত্র বিক্রেতা ও রাজনীতিকদের মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। যুক্তরাষ্ট্রে কথিত গান লবি একটি বিস্তৃত শব্দ। এতে অস্ত্র নীতি ইস্যুতে অঙ্গরাজ্য ও ফেডারেল পর্যায়ে প্রভাব বিস্তার অন্তর্ভুক্ত। সাধারণ এই প্রভাব বিস্তার করা হয় অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ সংশ্লিষ্ট পদক্ষেপের বিরোধিতাকারী প্রার্থীদের সমর্থনের মাধ্যমে। এতে রয়েছে আইনপ্রণেতাদের সরাসরি তহবিল প্রদান, নির্বাচিত কর্মকর্তাদের স্বতন্ত্রভাবে সহযোগিতা এবং আগ্নেয়াস্ত্র সংশ্লিষ্ট জনমত নিজেদের পক্ষে নিতে প্রচারণা। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনি অর্থ আইন এড়াতে প্রায়ই এমন লবিং খুব সতর্কতার সঙ্গে বাস্তবায়ন করা হয়।

একাধিক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, অস্ত্র নিয়ন্ত্রণবিরোধী বড় লবিং গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য, ন্যাশনাল রাইফেল অ্যাসোসিয়েশন (এনআরএ)। তাদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের শত কোটি ডলারের অস্ত্র শিল্পের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। এনআরএসহ একই ধরনের গোষ্ঠীগুলো নিজেদের নাগরিক অধিকার রক্ষাকারী হিসেবে দাবি করে। এ ক্ষেত্রে তারা মার্কিন সংবিধানের দ্বিতীয় সংশোধনীর কথা তুলে ধরে। যাতে নাগরিকদের ‘অস্ত্র রাখা ও বহনের অধিকার’ দেওয়া হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতির ব্যয় নিয়ে কাজ করা অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ওপেনসিক্রেটসের মতে, ১৯৯৮ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত বন্দুকপন্থি গোষ্ঠীগুলো লবিংয়ের পেছনে ব্যয় করেছে ১৭১.৯ মিলিয়ন ডলার। আইনপ্রণয়ন প্রভাবিত করতে এই অর্থ ব্যয় করা হয়েছে। এনআরএ একাই এই খাতে ব্যয় করেছে ৬ কোটি ৩৮ লাখ ৫৭ হাজার ৫৬৪ ডলার। ওপেনসিক্রেটসের মতে, ২০১০ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত তথাকথিত বাইরের খরচ হিসেবে ব্যয় করেছে ১৫৫.১ মিলিয়ন ডলার। ২০০০ সাল থেকে এনআরএর এমন ব্যয় ছিল ১৪০ মিলিয়ন ডলার। এগুলোর মধ্যে সেই ব্যয় রয়েছে যা সরাসরি প্রার্থীদের সঙ্গে সমন্বয় করে ব্যয় করা হয়নি।

এমন অবস্থা কংগ্রেসে নতুন বিল পাস হওয়ার বাস্তবতা কঠিন। গ্রিফিত ল সেন্টারের গবেষণা বিষয়ক পরিচালক কেলি ড্রেন বলেন, চলমান পরিস্থিতিতে এটা বলা খুবই কঠিন যে, বন্দুক হামলার যে বাস্তবতা তৈরি হয়েছে তা আমূল পরিবর্তন হবে। ২০২৩ সালেও হয়তো অস্ত্র সহিংসতার চিত্র ২০২২ এবং ২০২১ সালের মতোই হবে।