Image description

বিচারাধীন মামলায় আসামিকে ডান্ডাবেড়ি পরানোকে সংবিধান পরিপন্থি-শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, জেল কোড অনুযায়ী কেবল কারাগারের ভেতরে কয়েদির কোনো অপরাধমূলক আচরণের ক্ষেত্রে জেল সুপার কর্তৃক কিছু শাস্তির বিধান থাকলেও বাইরে বা আদালতে আনা-নেওয়ার ক্ষেত্রে ডান্ডাবেড়ির কোনো আইন নেই। অথচ সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে রাজনৈতিক মামলা কিংবা তুলনামূলক দুর্বল মামলার বিচারাধীন আসামিকে ডান্ডাবেড়ি পরিয়ে কারাগার থেকে আনা-নেওয়া করা হচ্ছে। এমনকি মায়ের লাশের জানাজায় অংশ নিতেও পড়ে থাকতে হচ্ছে ডান্ডাবেড়ি। 

অন্যদিকে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুর্ধর্ষ জঙ্গি কয়েদিকেও কেবল এক হাতে হাতকড়া পরিয়ে আদালত চত্বরে চলাচল করাতেও সম্প্রতি দেখা যায়। যদিও সেই ঘটনায় দুজন জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। মায়ের মৃত্যুতে প্যারোলে মুক্তি পেয়ে ডান্ডাবেড়িসহ জানাজায় অংশগ্রহণের অমানবিক এমন একাধিক ঘটনায় সারা দেশে বইছে সমালোচনার ঝড়। প্রশ্ন উঠেছে, কোন আইনে বা ক্ষমতাবলে পুলিশ কিংবা কারা কর্তৃপক্ষ এমন নিষ্ঠুর, নির্যাতন-নিপীড়নমূলক ঘটনা ঘটাচ্ছে? 

সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আসামিকে ডান্ডাবেড়ি পরানোর সুনির্দিষ্ট কোনো আইনই নেই। বরং সংবিধান অনুযায়ী ডান্ডাবেড়ি পরানো অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। তা ছাড়াও ২০১৭ সালের ১৪ মার্চ হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ একটি ঘটনার প্রেক্ষিতে ডান্ডাবেড়ি পরিয়ে আসামিদের আদালতে হাজির না করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। অর্থাৎ রাষ্ট্রের সংবিধান ও হাইকোর্টের আদেশটিও যথাযথ মানা হচ্ছে না। 

বিশেষজ্ঞদের মতে, এগুলো মূলত ব্রিটিশদের শোষণ-শাসন ও নির্যাতনের অংশ হিসেবে যে ডান্ডাবেড়ি পড়ানোর প্রথা ছিল সেটিই অদ্যাবধি অপচর্চা হিসেবে হয়ে আসছে। যদিও জেল কোড অনুযায়ী কারাগারের ভেতরে কেউ অপরাধ করলে জেল সুপারিন্টেন্ডেন্ট কর্তৃক নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ডান্ডাবেড়িসহ ১১ ধরনের ‘গুরুতর শাস্তি’ ও ১১ ধরনের ‘লঘু শাস্তি’ দিতে পারেন। কিন্তু সেখানেও মনগড়া শাস্তি দেওয়ার সুযোগ রয়ে গেছে বলেও জানিয়েছেন তারা। তবে ব্যাপক সমালোচনার মধ্যে রোববার (২২ জানুয়ারি) ডান্ডাবেড়ি-হাতকড়ার অপব্যবহার বন্ধে সুপ্রিম কোর্টের ১০ জন আইনজীবী আইনি নোটিস পাঠিয়েছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশের আইজি, কারা অধিদফতরের মহাপরিদর্শকসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে।

এ প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেড আই খান পান্না সময়ের আলোকে বলেন, বিচারাধীন বা সাজাপ্রাপ্ত কোনো ক্ষেত্রেই আসামিকে ডান্ডাবেড়ি পরানো যাবে না। এটা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সবচেয়ে বড় আইন হচ্ছে দেশের সংবিধান। সংবিধানে যেটা নিষেধ আছে, সেটা নিয়ে যদি আইনও থাকে বা যদি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয় সে আইন বাতিল বলে গণ্য হবে। এসব (ডান্ডাবেড়ি) আইন হচ্ছে ‘ব্রিটিশ কলোনিয়াল ল’। ব্রিটিশরা যে আইনগুলো করেছে সেগুলো হলো- শোষণ, শাসন এবং দমন-পীড়নের আইন। সেটি তো এখনও চলতে পারে না। এটি সম্পূর্ণ বেআইনি। যারা ডান্ডাবেড়ি পরিয়েছেন তাদের প্রত্যেকের সাজা হওয়া উচিত। তারা শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছে। ১৯৭২ সালের সংবিধানই সর্বোচ্চ আইন। সে দিকেই গুরুত্বের সঙ্গে নজর দিতে হবে।

সুপ্রিম কোর্টের এ সিনিয়র আইনজীবী আরও বলেন, এক সময় বলা হতো ফাঁসির আসামি, যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত দুধর্ষ আসামিদের ডান্ডাবেড়ি পরানো হবে। পরবর্তীতে একটি মামলায় আদালত কর্তৃক এই ডান্ডাবেড়ি পরানোর বিষয়টি নিষেধ করা হয়। বলা হয়, ডান্ডাবেড়ি পরানো যাবে না। কারণ এটি একটি নির্যাতন, মধ্যযুগীয় অত্যাচার।

একই প্রসঙ্গে মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন সময়ের আলোকে বলেন, আমাদের সংবিধানে স্পষ্ট বলা আছে, ‘কোনো ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেওয়া যাবে না কিংবা নিষ্ঠুর অমানুষিক বা লাঞ্ছনারকর দণ্ড দেওয়া যাবে না কিংবা কারও সঙ্গে কোনোরূপ নির্দয় আচরণ করা যাবে না।’ সে হিসেবেই সংবিধান ও মানবাধিকারের আলোকে চিন্তা করলে, এ ধরনের ব্যবস্থা নিপীড়নমূলক। এটি আইনে অচল। ডান্ডাবেড়ি পড়ানোর ঘটনাগুলো সংবিধানের পরিপন্থি। এটি আইনের ব্যত্যয়। যারা করেছেন তাদেরকে জবাবদিহিতা বা আইনের আওতায় আনা উচিত।’

মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন আরও বলেন, ‘আমরা দেখতে পাই, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জঙ্গিদের কোনোমতে একটি হাতে হাতকড়া পরিয়ে কারাগারের বাইরে তথা আদালতে আনা- নেওয়া করা হয়। আর সেখানে সাম্প্রতিক যাদের ডান্ডাড়ি পরিয়ে কারাগারের বাইরে আনা হলো (জানাজায়) তাদের কেউই কিন্তু আদালত কর্তৃক অপরাধী প্রমাণিত হয়নি। অধিকাংশই রাজনৈতিক নেতাকর্মী। পারিবারিক মৃত্যুর ক্ষেত্রেও জনসম্মুখে দেখা গেল, ডান্ডাবেড়ি পরিয়ে জানাজার আনুষঙ্গিকতা সারতে হলো। এটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়ার মতো নয়। এটা সুস্পষ্ট মানবাধিকার লঙ্ঘন।’

ডান্ডাবেড়ি বন্ধের বিষয়ে রোববার নোটিসদাতা সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আসাদ উদ্দিন সময়ের আলোকে বলেন, বাংলাদেশের সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী- ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির ক্ষতি করা নিষিদ্ধ। অনুচ্ছেদ ৩৫(৫) অনুযায়ী কোনো ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেওয়া যাবে না বা নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেওয়া যাবে না বা তার সঙ্গে অনুরূপ আচরণ করা যাবে না। কিন্তু আইনের এসব বিধানের বাইরে গিয়ে ডান্ডাবেড়ি এবং হাতকড়ার অপব্যবহার করা হচ্ছে। যা নাগরিকদের জন্য অত্যন্ত অবমাননাকর এবং মৌলিক অধিকারের পরিপন্থি। 

তিনি আরও জানান, বেঙ্গল পুলিশ রেগুলেশনের প্রবিধান ৩৩০-এ হাতকড়াসংক্রান্ত বিধান রয়েছে। সেখানে শুধু পলায়ন রোধ করতে যতটুকু প্রয়োজন তার বেশি নিয়ন্ত্রণ আরোপে নিষেধ করা হয়েছে। মূলত ডান্ডাবেড়ির ব্যবহার কেবল জেল কোড এবং কারা আইনের আওতাধীন। আর বেঙ্গল পুলিশ রেগুলেশন অনুযায়ী কেবল প্রযোজ্য ক্ষেত্রে হাতকড়া ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে, কোনোভাবেই ডান্ডাবেড়ি নয়। পার্শ^বর্তী দেশ ভারতেও তাদের সুপ্রিম কোর্টও ইতিমধ্যে হাতকড়া ও ডান্ডাবেড়ি ব্যবহার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দিয়েছেন।

এ বিষয়ে কথা বলতে কারা অধিদফতরের মহাপরিদর্শক (আইজি-প্রিজন্স)-সহ একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা হলেও তারা ফোন ধরেননি। তবে কারাগার কেন্দ্রিক একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সময়ের আলোকে বলেন, কারাগারের ভেতরে কেউ অপরাধ করলে তার নিষ্পত্তি বা শাস্তির বিষয়টি জেল কোড অনুসারে হয়ে থাকে। জেল কোডের ১৯ নম্বর অধ্যায়ের ৭০৮ নম্বর বিধান অনুযায়ী জেলের ভেতরে কেউ অপরাধ করলে জেল সুপারিন্টেন্ডেন্ট ১১ ধরনের লঘু ও ১১ ধরনের গুরুতর শাস্তি দিতে পারেন। গুরুতর শাস্তির মধ্যে-৩০ দিনের জন্য ডান্ডাবেড়ি পরানো, সব বন্দিদের থেকে আলাদা করে কাউকে ৭ দিনের জন্য কোনো সেলে আটক রাখা অন্যতম। জেল সুপার যাকে অপরাধী মনে করবেন, তিনিই অপরাধী হবেন। তবে জেল কোডের ওই ৭০৮ নম্বর বিধান অনুযায়ী বিচারাধীন আসামি বা রাজবন্দিদের এ ধরনের গুরুদণ্ড দেওয়া যায় না। কারণ ৭০৮ নম্বর বিধানটি কেবল আদালতে সাজাপ্রাপ্তদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।

এ প্রসঙ্গে পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (মিডিয়া) মো. মনজুর রহমান সময়ের আলোকে বলেন, আসামিদের কারাগার থেকে আনা-নেওয়ার ক্ষেত্রে আদালতের একটি নির্দেশনা আছে। সে নির্দেশনা মেনেই পুলিশ আসামি ব্যবস্থাপনা করে থাকে।

প্রসঙ্গত, গত ১৫ জানুয়ারি মায়ের লাশের জানাজায় অংশ নিতে ১০ ঘণ্টার জন্য প্যারোলে মুক্তি পেয়েছিলেন শরীয়তপুরে সেলিম রেজা নামে ছাত্রদলের এক কেন্দ্রীয় নেতা। কিন্তু প্যারোলে মুক্তি পেলেও জানাজার সময় তার হাতকড়া ও ডান্ডাবেড়ি খোলা হয়নি। এর আগে গত ২০ ডিসেম্বর মায়ের লাশের জানাজায় অংশ নিতে গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার বোয়ালী ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আলী আজমকে ৩ ঘণ্টার জন্য প্যারোলে মুক্তি দেওয়া হয়। 

এ সময় তাকে হাতকড়া ও ডান্ডাবেড়ি পরানো হয়। ওই অবস্থায় তিনি মায়ের জানাজা নামাজ পড়ান। তারও আগে একজন আইনজীবীসহ কয়েকজনকে ডান্ডাবেড়ি পরিয়ে ঢাকার আদালতে হাজির করা হয়। এসব ঘটনায় ব্যাপক সমালোচনা হয়। এ ছাড়াও বিগত কয়েক বছরে সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজল, তানভীর হাসান তানু, প্রবীর শিকদার, শিল্পী জে কে মজলিস এবং কয়েকজন শিশুসহ অনেক আসামিকে আদালতে হাতকড়া পরানোর ঘটনায় দেশব্যাপী সমালোচনা হয়েছে। 

তারপরও হাতকড়া ও ডান্ডাবেড়ির অপব্যবহার বন্ধে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি বলে জানা যায়। জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ কারাবন্দিদের জন্য রাষ্ট্রের তরফ থেকে অনুসৃত যে ন্যূনতম নীতিমালা তৈরি করেছে, সেখানকার ৩৩ নম্বর অনুচ্ছেদে ডান্ডাবেড়ি পরানোকে অমানবিক বলা হয়েছে।