সারা বিশ্বেই কাজের ধরনে বড় পরিবর্তন আসছে। ২০২৪ সালের এক গবেষণায় দেখা যায়, বিশ্বের ১৬ ভাগ প্রতিষ্ঠান এখন ‘রিমোট জব’ (কর্মস্থলে না গিয়ে কাজ করা) নির্ভর। এ ছাড়া অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানই এখন ‘হাইব্রিড মডেলে’ চলে । অর্থাৎ অফিসে এসে এবং না এসে—দুভাবেই কাজের সুযোগ থাকে। বাংলাদেশের অনেক তরুণও এখন দেশে বসে রিমোট জব করছেন। এমনই কয়েকজন তরুণের সঙ্গে কথা বলে জানার চেষ্টা করেছিলাম, কীভাবে রিমোট জবের খোঁজ পাওয়া যায়? এ ধরনের কাজের অভিজ্ঞতা কেমন? কী কী দক্ষতার প্রয়োজন?
অভিজ্ঞতা কেমন
খুলনা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে কম্পিউটারবিজ্ঞান পড়ার জন্য ভর্তি হয়েছিলেন ফাহাদ বিন হাসান আলী। দুই বছর পর ড্রপআউট হয়ে আর পড়াশোনা করা হয়নি। ২০১৫ সাল থেকেই রিমোট জব করছেন তিনি। এখন ‘উই লাভ ট্রাম্প’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানে ‘লেখক’ হিসেবে যুক্ত আছেন। ফাহাদ বলেন, ‘আমার কাজটা বেশ আলাদা। উই লাভ ট্রাম্প নামের একটি ওয়েবসাইটে ট্রাম্পের পক্ষে জনমত তৈরির জন্য বিভিন্ন লেখা লিখে মার্কিন নাগরিকদের ভোট দিতে উদ্বুদ্ধ করি। এ ধরনের কাজে মাসে আয় হয় আড়াই থেকে ৩ হাজার ডলার। আগে নেদারল্যান্ডসভিত্তিক আরেকটি প্রতিষ্ঠানের জন্য রিমোট জব করেছি। তখন দেশে বসেই নেদারল্যান্ডস, আফ্রিকাসহ বিভিন্ন দেশের জন্য কাজ করতাম।’
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্য বিষয়ে পড়াশোনা শেষ করেছেন মাহমুদুর রহমান। তিনি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক পিক কনসালটেন্ট গ্রুপ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের জ্যেষ্ঠ প্রকল্প সহযোগী হিসেবে রিমোট জব করছেন। চাকরির বয়স দুই বছরের বেশি। মাহমুদুর রহমান বলেন, ‘আমি যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন গ্রাহকের ব্যবসাসংক্রান্ত কাজে সহায়তা করি। দিনে গড়ে ৬-৮ ঘণ্টা আমাকে বাড়ি থেকেই অফিস করতে হয়। মাসে প্রায় ৬৫০-৭০০ ডলার আয় হয়। মূলত লিংকডইনের মাধ্যমে এই রিমোট জবের খোঁজ পেয়েছি।’
প্রচলিত ৯-৫টার চাকরি ছেড়েও অনেকে বিদেশি করপোরেট প্রতিষ্ঠানে ‘রিমোট জব’ বেছে নিচ্ছেন। এতে শুধু যে বৈশ্বিক মানের কাজের অভিজ্ঞতা হচ্ছে তা নয়, আয়ও হচ্ছে ভালো। বিশেষ করে নারীদের জন্য এ ধরনের কাজ খুব সুবিধাজনক বলে মনে করেন উম্মে আম্মারা। ২০২২ সাল থেকে একটি ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের তথ্যবিশ্লেষক হিসেবে কাজ করছেন তিনি। বলছিলেন, ‘নিয়মিত চাকরির মতো রিমোট জবেও ৮ ঘণ্টাই কাজ করতে হয়। কিন্তু যানজট ঠেলে, রাস্তাঘাটের হাজারো ঝামেলা সামলে অফিসে যেতে হয় না, এটা একটা ভালো দিক। অন্য ভাষার অনেক সহকর্মীর সঙ্গে কাজ করতে হয়, এটাও একটা ভালো অভিজ্ঞতা।’
নিলয় ধর থাকেন সাভারে। পড়াশোনা করছেন ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে। বললেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের স্টোরিবক্স ডিজিটাল প্রোডাকশন নামের একটি প্রতিষ্ঠানের প্রকল্প ব্যবস্থাপনার কাজে সহায়তা করি। মাসে ১৫০-২০০ ডলারের মতো আয় হয়। অনলাইনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের গ্রাহক ব্যবস্থাপনা ও অন্যান্য নিয়মিত কাজেও সহায়তা করি।’
চাই দক্ষতা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে পড়াশোনার পাশাপাশি খণ্ডকালীন নানা চাকরির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সাদিয়া ইসলাম। স্নাতকোত্তর শেষে পূর্ণকালীন চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন, কিন্তু করোনার সময় টের পেলেন, চাকরির বাজার বদলে যাচ্ছে দ্রুত। সাদিয়া বলেন, ‘ওই সময় রিমোট জবের সুযোগ আর অফার দুটাই বাড়ছিল। তখন অন-সাইট জব ছেড়ে রিমোটলি ফুলটাইমার হিসেবে দুবাইভিত্তিক একটা সফটওয়্যার কোম্পানিতে যোগ দিই। একটা সময় মনে হতো চাকরি মানেই তো অফিসে বসে সকাল-সন্ধ্যা কাজ। সেই ধারণা এখন বদলে গেছে। দৈনন্দিন যানজট, পরিবার ও নিজেকে সময় দিতে না পারা, দেশের কোম্পানিগুলোতে শ্রম আইন না থাকা, এমন নানা অসুবিধা এড়িয়ে যেতে পারছি।’
অধিকাংশ রিমোট জবই ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠাননির্ভর। এ জন্য ইংরেজি ভাষার দক্ষতা খুব জরুরি। মাহমুদুর রহমান বলছিলেন, ‘নিজের কাজ সম্পর্কে ধারণা রাখতে হবে। খুব অভিজ্ঞতা যে প্রয়োজন হবে, বিষয়টা এমন নয়। পেশাদার আচরণ নিয়ে রিমোট জব খোঁজ শুরু করুন।’ ফাহাদের পরামর্শ, ‘শুধু ভাষা জানলেই হবে না, ভাষার প্রয়োগ ও ব্যবসায়িক দিক সম্পর্কে জানতে হবে।’ আর উম্মে আম্মারা বলেন, ‘অনলাইননির্ভর কাজে কিছু প্রযুক্তিগত দক্ষতা থাকতে হয়। কম্পিউটারের সাধারণ ব্যবহার থেকে শুরু করে কাজভেদে কার্যকর সফটওয়্যারের ব্যবহার জানতে হবে। নির্দিষ্ট কিছু দক্ষতা অর্জন করে এ ধরনের নেটওয়ার্কে যুক্ত হলে নিজেই সেই দক্ষতাগুলো কাজে লাগানোর নানা রকম সুযোগ খুঁজে পাবেন।’
কোথায় মেলে খোঁজ
রিমোট জবের খোঁজ পাওয়ার মতো বেশ কিছু ওয়েবসাইট আছে। মাহমুদ বলেন, ‘লিংকডইনে অনেক রিমোট জবের খোঁজ পাওয়া যায়। এ ছাড়া আপওয়ার্কসহ বিভিন্ন ফ্রিল্যান্সিং সাইটে খোঁজ রাখতে পারেন। ভারত ও ফিলিপাইনের বিভিন্ন জবসাইট দেখতে পারেন। এসব দেশের বিভিন্ন জব সাইটে রিমোট জবের খবর বেশি পাওয়া যায়।’ ফেসবুক ও লিংকডইনের মাধ্যমে নেটওয়ার্কিং করতে পারলে সেটিও বেশ কাজে লাগে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিষয়ে পড়েছেন ফাতেমা ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আমি যুক্তরাষ্ট্রের মহাজন ল নামের একটি প্রতিষ্ঠানে ২০২১ সাল থেকে কাজ করছি। খোঁজ পেয়েছিলাম আমার এক সিনিয়রের কাছ থেকে। এরপর অনলাইন ইন্টারভিউ ও এক মাসের ট্রেইনিং শেষে ফুলটাইম পজিশনে কাজ শুরু করি।’
রিমোট জব খোঁজার বেশ কিছু ওয়েবসাইটও আছে। যেমন weworkremotely.com, remote.co, flexjobs.com, ইত্যাদি।