
শিক্ষা ও কর্মজীবনকে এআই শুধু যে সহজ করেছে তা নয়, অনেক ক্ষেত্রে এআইয়ের ব্যবহার হয়তো আপনার উপস্থাপনকেও করতে পারে আরও আধুনিক, যুগোপযোগী। কীভাবে পড়ালেখা বা কাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এআই ব্যবহার করবেন? জানা যাক ১০ উপায়।
১. প্রেজেন্টেশন তৈরি
প্রেজেন্টেশন তৈরি করতে এখন আর পাওয়ার পয়েন্ট কিংবা অন্য কোনো সফটওয়্যারের পেছনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। গামা এআই টুল (gamma.com.ai) ব্যবহার করে আপনি কাজটা সহজেই করতে পারবেন। কী নিয়ে প্রেজেন্টেশন তৈরি করতে চান, ঠিকঠাক নির্দেশনা দিলেই এআই আপনাকে প্রেজেন্টেশন বানিয়ে দেবে। প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটির ইংরেজি বিষয়ের প্রভাষক জিনাত সানজিদা জানালেন, ‘নিজের আইডিয়া বা অভিজ্ঞতার সঙ্গে এআই যুক্ত করে প্রেজেন্টেশন তৈরি করা যেতেই পারে। তবে এআইকে সহযোগী হিসেবে ব্যবহার করার চেষ্টা করুন। পুরোপুরি এর ওপর নির্ভরশীল হয়ে যাবেন না।’ ক্যানভার (Canva.com) কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি ব্যবহার করেও প্রেজেন্টেশন তৈরি করতে পারেন। ডিজাইন ও উপস্থাপনার বিষয়টি এআইয়ের হাতে ছেড়ে দিলে কনটেন্ট সংগ্রহ, বিশ্লেষণ ও গবেষণায় আপনি আরও বেশি সময় দিতে পারবেন। এসব সাইটে বিষয় লিখে দিলে বা কনটেন্ট দিলে এআই নিজেই স্লাইড ডিজাইন সাজিয়ে দেয়। আপনাকে শুধু টেক্সট ও ছবি নিজের মতো করে সম্পাদনা করে নিতে হবে।
২. ক্লাসওয়ার্ক, হোমওয়ার্ক ও অ্যাসাইনমেন্ট
লেখা ঠিকঠাক সাজিয়ে নেওয়া, তথ্য অনুসন্ধান কিংবা বিশ্লেষণের কাজে আপনি চ্যাটজিপিটি বা জেমিনির মতো এআই টুল ব্যবহার করতেই পারেন। ঢাকার ইউনিভার্সিটি অব স্কলারসের সিনিয়র সহকারী অধ্যাপক এইচ এম আতিফ ওয়াফিক বলেন, ‘ক্লাসওয়ার্ক ও অ্যাসাইনমেন্ট তৈরির জন্য এখন অনেক উন্নত এআই টুল আছে। এসব টুল শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল লেখায় সহায়তা করে। তবে কপি-পেস্ট কিংবা সরাসরি অনুলিপি করলে কিন্তু তা সহজেই ধরা পড়বে, ক্লাসে নম্বর কম পাওয়ার আশঙ্কা থেকে যাবে। বরং এসব টুলের সহায়তা নিয়ে নিজস্ব ভাষায় উপস্থাপন করা শিখতে হবে। চ্যাটজিপিটি বা জেমিনি কিন্তু অনেক সময় ভুল তথ্যও দেয়। তাই রেফারেন্স যাচাই করতে হবে।’ জিনাত সানজিদার মতো আতিফ ওয়াফিকেরও একই পরামর্শ—এআইয়ের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল না হয়ে একে সহায়ক হিসেবে ব্যবহার করা উচিত। এক্সামএআই (examai.ai) টুলটিও শিক্ষার্থীদের সহায়ক হতে পারে। এটি একটি আধুনিক টেস্ট প্রিপারেশন টুল, যা নিজস্ব এআই দিয়ে কুইজ, ফ্ল্যাশকার্ড ও স্টাডি গাইড তৈরি করে। শিক্ষার্থীরা এতে নিজের মতো করে পড়ালেখার পরিকল্পনা (পার্সোনালাইজড স্টাডি প্ল্যান) সাজাতে পারেন, বিভিন্ন বিষয়ে পরীক্ষা দিতে পারেন, আছে আরও নানা সেবা। এআই-শিক্ষক হিসেবে ক্যাকটাস এআইও (caktus.ai) শিক্ষার্থীদের জন্য বেশ কাজের। এটি রচনা ও থিসিস লেখায় সাহায্য করে, লিখতে পারে কোড। তৈরি করে দেয় গবেষণাপত্রের সারাংশ ও রেফারেন্স। এমন এআই টুল পরীক্ষার সময় প্রস্তুতিতে বেশ সহায়ক।
৩. বানান ও ব্যাকরণ পরীক্ষা
ইংরেজি ভাষায় লেখা অ্যাসাইনমেন্টের বানান ও ব্যাকরণ ঠিক করতে গিয়ে অনেক শিক্ষার্থীই হিমশিম খান। দ্বিধায় ভোগেন। এ ক্ষেত্রে সহায়তার জন্যও আছে একাধিক এআই টুল। যেমন গ্রামারলি। এই এআই টুলটি বানান থেকে শুরু করে ফুলস্টপ, কমা, বাক্য গঠন—সব যাচাই করে ও সেই অনুযায়ী পরামর্শ দেয়। একটি নিবন্ধ লিখে আপনি গ্রামারলির ‘হাতে’ (পড়ুন ওয়েবসাইটে) ছেড়ে দিলেই এটি সব ভুলত্রুটি শনাক্ত করে ফেলতে পারবে। এ ছাড়া আছে কুইলবট (quillbot.com)। এর মাধ্যমে একই লেখাকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করা সম্ভব। এটি বিকল্প বাক্য (রিরাইট) ও শব্দ (সিনোনিম) খুঁজতে সাহায্য করে। ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক বুশরা হুমায়রা বলেন, ‘আমাদের অনেক শিক্ষার্থীই ইংরেজি লেখার ক্ষেত্রে দুর্বলতা আছে। বিশেষ করে ব্যাকরণ, বানান ও বাক্য গঠনের ক্ষেত্রে। এআই টুল ব্যবহার করে এই ভুলত্রুটিগুলো সংশোধন করা যায়। তবে শুধু সংশোধন করলেই হবে না। শিখতে হবে—কোথায়, কেন আমার ভুল হচ্ছে। অনেক সময় শিক্ষার্থীরা একটা লেখা শেষ করার পর কারও সাজেশন নেওয়ার সুযোগ পায় না। কারণ, দেখানোর কেউ নেই। এ ক্ষেত্রে এআই হতে পারে ভরসা।’ বুশরা মনে করেন, এসব টুল শিক্ষার্থীদের আত্মবিশ্বাস বাড়াতে সাহায্য করে। এসব টুল কাজে লাগিয়ে ধীরে ধীরে নিজের লেখার মান বাড়ানোরও চর্চা করা উচিত।
৪. পিডিএফ ব্যবস্থাপনা
বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক সময় বড় বড় পিডিএফ পড়তে হয়। অনেক সময় পুরোটা পড়া সম্ভব হয় না। চ্যাটপিডিএফ (chatpdf.com) ব্যবহার করে সহজেই কোনো গবেষণাপত্র বা বইয়ের সারাংশ জেনে নেওয়া যায়। এটি মূল বক্তব্য, গবেষণার ফলাফল ও উপসংহার আলাদা করে দেখায়। পিডিএফ ফাইল আপলোড করে দিলেই এআই আপনাকে সারাংশ তৈরি করে দেবে। পিডিএফের কোনো একটা অংশটা নির্দিষ্ট করে প্রশ্ন করলেও উত্তর মিলবে।
৫. ভিডিওর ট্রান্সক্রিপ্ট ও বিশ্লেষণ
অনেক সময় ভিডিও লেকচার দেখে বা পডকাস্ট শুনে আমরা নতুন কিছু শেখার চেষ্টা করি। এ ক্ষেত্রে ইংরেজি উচ্চারণ বুঝতে অনেকে সমস্যায় পড়েন। আবার ভিডিওর দৈর্ঘ্য বেশি লম্বা হলে পুরো ভিডিও দেখে নির্দিষ্ট তথ্যটা খুঁজে বের করাও কঠিন হতে পারে। এ ক্ষেত্রে আপনাকে সাহায্য করবে অটার ডট এআই। (Otter.ai)। এই ওয়েবসাইটে ভিডিওর কনটেন্ট লিখিত আকারে পাওয়া যায়, নোট নেওয়া সহজ হয়। ভিডিওর লিংক বা ফাইল দিয়ে দিলে এটি নিজ দায়িত্বে পুরো ট্রান্সক্রিপ্ট তৈরি করে দেয়। একই ধরনের সেবা পেতে পারেন গুগলের নোটবুকএলএম (notebooklm.google) থেকেও। ধরা যাক, আপনি যে ভিডিওটির ট্রান্সক্রিপ্ট চাচ্ছেন, সেখানে একাধিক মানুষের কণ্ঠস্বর আছে। আপনি যদি আলাদা আলাদা কণ্ঠস্বর শনাক্ত করে সেই অনুযায়ী ট্রান্সক্রিপ্ট তৈরি করে দিতে বলেন, নোটবুকএলএম আপনাকে সেটাও দেবে।
৬. সিভি তৈরি
এখন শুধু চাকরির জন্য নয়, বিশ্ববিদ্যালয়জীবন থেকেই সিভি তৈরি করে রাখতে হয়। সিভি তৈরির জন্যও আছে একাধিক এআই টুল। যেমন জেটি ডটকম (zety.com) বা রেজুমে ডটআইও (Resume.io)। এসব ওয়েবসাইটে ভিন্ন ভিন্ন টেমপ্লেট আছে। আপনি আপনার শিক্ষা, অভিজ্ঞতা ও কাজের বর্ণনা দিলে এআই পেশাদার ফরম্যাটে তা সাজিয়ে দেবে। সে জন্য নির্ধারিত ফরমে কিছু তথ্য পূরণ করতে হবে। আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি-বাংলাদেশের (এআইইউবি) জ্যেষ্ঠ সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মাদ আলী বলেন, ‘অনেক শিক্ষার্থীই জানেন না, কীভাবে একটি ভালো সিভি তৈরি করতে হয়। এমনকি অনেকে সিভি তৈরির জন্যও অন্যের কাছে ধরনা দেন। অথচ এআই টুল ব্যবহার করে সহজেই সঠিক ফরম্যাটে সিভি তৈরি করা যায়। এসব টুল শুধু সিভির ভাষা ও বিন্যাসে সাহায্য করে না, বরং চাকরির বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী কী কী দক্ষতা বা অভিজ্ঞতা তুলে ধরা প্রয়োজন, সেই নির্দেশনাও দেয়।’
৭. গবেষণা
বিভিন্ন গবেষণার জন্য আমাদের অনেক ‘রেফারেন্স’ পড়তে হয়। এ ধরনের কাজেও এআই সহায়ক হতে পারে। এআইইউবির শিক্ষক মোহাম্মাদ আলী বলেন, ‘প্রাসঙ্গিক লিটারেচার রিভিউ খোঁজা সবচেয়ে কঠিন কাজ। ইলিসিট (elicit.com) একটি এআই রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট (গবেষণা সহকারী), যা কোনো প্রশ্ন দিলে সংশ্লিষ্ট গবেষণাপত্র (রিসার্চ পেপার) বের করে দেয় খুব দ্রুত। রিসার্চর্যাবিট (researchrabbit.ai) দিয়ে গবেষণার রেফারেন্স ম্যাপ করা যায়, অর্থাৎ কোন পেপার কোনটি রেফার করেছে বা সাপোর্ট করছে দেখা যায়। এসব টুলসে গবেষণার প্রশ্ন টাইপ করে দিলে এটি প্রাসঙ্গিক পেপার সাজিয়ে দেয় ও সারাংশও দিয়ে দেয়।’
৮. কথা থেকে লেখা তৈরি
ক্লাসে অনেক সময় বক্তৃতা বা লেকচার রেকর্ড করে রাখি আমরা। পরে তা লিখিত আকারে পেলে কাজ করতে সুবিধা হয়। এ ক্ষেত্রে স্পিচনোটস (speechnotes.co) ব্যবহার করতে পারেন। এটি মুখের কথা বা রেকর্ডকৃত অডিওকে লেখা আকারে সাজিয়ে দিতে পারে। অডিও ফাইল আপলোড করে দিলে এআই তা শব্দে রূপান্তর করে দেয়।
৯. ছবি ও ইনফোগ্রাফ তৈরি
বিভিন্ন অ্যাসাইনমেন্ট ও প্রেজেন্টেশনের জন্য আমাদের অনেক সময় পোস্টার, চার্ট বা ইনফোগ্রাফিকস তৈরি করতে হয়। এ ক্ষেত্রে ক্যানভা সহজে ও দ্রুত সমাধান দেয়। অ্যাডোবি ফায়ারফ্লাই (firefly.adobe.com) দিয়ে ব্যাকগ্রাউন্ড তৈরি বা ইমেজ পরিবর্তন করা যায়। টেমপ্লেট বেছে নিয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য বসালেই একটি পেশাদার ডিজাইন তৈরি হয়ে যায়। সীমিত পরিসরে ছবি তৈরির জন্য আপনি চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করতে পারেন। এ ছাড়া মিডজার্নি দিয়েও অনেক ছবি, নকশা তৈরি করা যায়।
১০. দলীয় কাজ
এখন পড়ালেখার বাইরেও আমাদের নানা প্রকল্প, কাজে যুক্ত থাকতে হয়। কখন কোন কাজ, তা ঠিকমতো সাজিয়ে রাখতে নোশন এআই (notion.com) বেশ কাজের। শিক্ষার্থীরা এই প্রোডাকটিভিটি টুল ব্যবহার করে সহজে নোট নিতে পারেন। বিভিন্ন প্রকল্প ব্যবস্থাপনা ও দলীয় কাজকে সহজ করে এই এআই অ্যাপ। এটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে লেকচার ও স্টাডি ম্যাটেরিয়ালের সারাংশ তৈরি করে। রিসার্চ ও অ্যাসাইনমেন্ট সংরক্ষণের জন্য ডেটাবেজ তৈরিতে সহায়তা করে। সময়মতো বিভিন্ন কাজের কথা মনে করিয়ে (টাস্ক রিমাইন্ডার) দেয়। দল বেঁধে কোনো কাজ করা আরও সহজ হয়।
সূত্র: সুইস স্কুল অব বিজনেস অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট জেনেভা