
সাহিত্যজগতে অপ্রতিরোধ্য ও জ্বলজ্বলে এক তারকা হারুকি মুরাকামি। তার জন্ম ১৯৪৯ সালের ১২ জানুয়ারি, জাপানের কিয়োটা শহরে। ৩০ বছর বয়সে লেখালেখি শুরু, এরপর গল্প-উপন্যাসে কল্পনার জাদুর পরশ ছড়িয়ে বিশ্বব্যাপী পাঠকদের মনে জায়গা করে নিয়েছেন। ২০০৮ সালে তিনি নিউ ইয়র্কার ফেস্টিভ্যালে এলে মুহূর্তের মধ্যে টিকেট ফুরিয়ে যায়। ভক্তরা তাকে কাছ থেকে দেখার জন্য জাপান, কোরিয়া ও অস্ট্রেলিয়াসহ দূর-দূরান্ত থেকে নিউ ইয়ার্ক ছুটে আসেন। কারণ পাবলিক ইভেন্টগুলোতে খুব কমই অংশ নেন তিনি।
মুরাকামি ফিকশন লেখার প্রথম প্রচেষ্টায় অভূতপূর্ব উদ্যমী সাড়া পেয়ে ‘বিস্মিত ও বিভ্রান্ত’ হওয়ার কথা বলেছিলেন নিউ ইয়র্কার ফেস্টিভ্যালে। যে বিভ্রান্তি তাকে ভেতর ভেতর জ্বালিয়ে দিয়েছিল। তার গল্পগুলো প্রায় সময়ই কৌতূহলী ও গবেষণাধর্মী। গল্পের নায়করা হতভাগা বা কারো দ্বারা পরিচালিত, যারা কোনো কিছু আবিষ্কারের মিশনে যাত্রা শুরু করে। যেখানে তারা থামে, সে জায়গাটা সচরাচর পরিচিত ও নিগূঢ়, কখনো আবার আদি-উদ্ভট। একটি সূক্ষ্ম রচনাশৈলী এবং একগুঁয়ে ধরনের সাধারণ মানুষ মুরাকামি। রহস্য ও সমাজবিদ্যা উভয় জায়গাতেই সমান দক্ষ। তার ভাষা যেন বিভ্রান্তির পর্দা, যার পেছনে রহস্য লুকিয়ে থাকে। ফিকশনে মায়ামূর্তি, আলাদা একটি দুনিয়ায় আত্মাদের মিলন, অল্প কিছু লোক যারা চিত্র থেকে উঠে এসেছে, কিন্তু শিল্পের অন্তরালে এবং প্রায়ই স্বপ্নের মতো অতিপ্রাকৃত- এই ধরনের দৃশ্যগুলো তুলে ধরেন মুরাকামি।
তার কাজের অধিকাংশ এড়িয়ে যাওয়া বা ‘বুঝেও না বুঝতে পারা’ সংযোগগুলোর অধ্যয়ন। আবার আমাদের একে অপরকে বুঝতে না পারার ব্যর্থতার কমেডি ও ট্র্যাজেডিক ট্রিগারও। হারুকি মুরাকামির ৭৪তম জন্মদিন ছিল ১২ জানুয়ারি। এ উপলক্ষে পাঠকদের জন্য তার একটি সাক্ষাৎকার থাকছে, যেখানে অনেক প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন তিনি। ২০০৮ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন দ্য নিউ ইয়র্কারের ফিকশন এডিটর ও ফিকশন পডকাস্টের হোস্ট দেবোরাহ ট্রিজম্যান। ভাষান্তর করেছেন শিলু হোসেন।
মুরাকামি : সর্বশেষ ১০ বছর আগে আমাদের কথা হয়েছিল। এই সময়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে গেছে। উদাহরণস্বরূপ আমার ১০ বছর বয়স বেড়েছে। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, অন্তত আমার জন্য। দিন দিন আরও বুড়ো হচ্ছি। সেই সঙ্গে যৌবনের দিনগুলোর চেয়ে আলাদা করে এখন নিজেকে অন্যভাবে ভাবছি। এখন আমি ভদ্রলোক হওয়ার চেষ্টা করছি। কিন্তু আপনি জানেন, ভদ্রলোক ও ঔপন্যাসিক হওয়া সহজ নয়। এটা অনেকটা একজন রাজনীতিবিদের একই সঙ্গে ওবামা ও ট্রাম্প হতে চাওয়ার মতো! তবে আমার কাছে ভদ্রলোক ঔপন্যাসিকেরও একটা ব্যাখ্যা আছে। প্রথমত, তিনি যে আয়কর দেন সে সম্পর্কে কোনো কথা বলেন না। দ্বিতীয়ত, তিনি সাবেক প্রেমিকা বা সাবেক স্ত্রী সম্পর্কে লেখেন না এবং তৃতীয়ত, তিনি সাহিত্যে নোবেল পাওয়ার কথা চিন্তা করেন না। তাই দেবোরাহ, দয়া করে আমাকে এই তিনটি জিনিস সম্পর্কে কিছুই জিজ্ঞেস করবেন না। আমি মুশকিলে পড়ে যাব।
দেবোরাহ ট্রিজম্যান : আপনি আমার প্রশ্নের ভান্ডারই নাই করে দিলেন! আসলে আমি আপনার লেখা সাম্প্রতিক বই নতুন উপন্যাস ‘কিলিং কম্যান্ডেটোর’ দিয়ে শুরু করতে চেয়েছিলাম। বইয়ে এমন এক ব্যক্তির কথা আছে, যার স্ত্রী তাকে ছেড়ে চলে যায়। এরপর একজন বৃদ্ধ চিত্রশিল্পীর বাড়িতে জীবনের বাকিটা সময় কাটান। ওই বাড়িতে ওঠার পর অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটতে শুরু করে। মাটির গর্ত বা এক ধরনের খালি কুয়া থেকে কিছু একটা উঠে আসতে থাকে। আপনি কীভাবে উপন্যাসটির এই ভিত্তি সূচনা করলেন, তা ভেবে আমি অবাক হই।
মুরাকামি : বইটা অনেক বড়। লিখতে দেড় বছরেরও বেশি সময় লেগেছে। তবে উপন্যাসটা শুরু হয়েছিল মাত্র একটি বা দুটি প্যারা দিয়ে। লেখার পর সেগুলো আমার ডেস্কের ড্রয়ারে রেখে দিয়েছিলাম এবং ভুলে গিয়েছিলাম। সম্ভবত এর তিন-চার মাস পর মনে হলো, এই একটি বা দুটি প্যারা থেকে আমি উপন্যাস লিখে ফেলতে পারি। এরপর লেখা শুরু করলাম। আমার না ছিল কোনো পরিকল্পনা, না ছিল রুটিন। এমনকি কোনো স্টোরি লাইনও ছিল না। আমি শুধু ওই প্যারা থেকে শুরু করলাম এবং লেখা চালিয়ে গেলাম। কাহিনিই আমাকে উপন্যাসের শেষে নিয়ে গেল।
দেবোরাহ : উপন্যাসটিতে একটা চরিত্র বা ধারণা আছে, যেটা মোৎসার্ট অপেরার ডন জিওভান্নি থেকে ‘কম্যান্ডেটোর’-এর রূপ নিয়েছে। এমন চরিত্র বা এই ধারণা উপন্যাসের কেন্দ্রে কেন?
মুরাকামি : সচরাচর আমি শিরোনাম দিয়ে লেখা শুরি করি। এ ক্ষেত্রে আমার কাছে ‘কিলিং কম্যান্ডেটোর’ শিরোনামটি ছিল এবং ছিল উপন্যাসের প্রথম প্যারা। ভাবছিলাম, এটা নিয়ে আমি কী ধরনের কাহিনি লিখতে পারি। ‘কম্যান্ডেটোর’ বলে জাপানে কিছু নেই। কিন্তু শিরোনামের উদ্ভট ব্যাপারটি অনুভব ও দারুণ উপলব্ধি করতাম।
দেবোরাহ : ‘ডন জিওভান্নি’ অপেরা কি আপনার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ?
মুরাকামি : চরিত্র আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত আমি কোনো মডেল দাঁড় করাই না। আমার ক্যারিয়ারে শুধু একবারই একজনকে ‘মডেল’ হিসেবে বেছে নিয়েছিলাম- সে খারাপ লোক ছিল, আমি খুব একটা পছন্দ করিনি। আমি তার সম্পর্কে লিখতে চেয়েছিলাম, তবে শুধু একবারই। আমার বইয়ের অন্য সব চরিত্র একেবারে শূন্য থেকে তৈরি করেছি। আমি লেখক, আমি লিখি। কিন্তু একই সময়ে অনুভব করি, আমি কোনো উত্তেজনাপূর্ণ বা মজার বই পড়ছি। তাই আমি লেখা উপভোগ করি।
দেবোরাহ : আপনি উপন্যাসে উল্লেখ করেছেন, প্রধান চরিত্র অপেরার পাশাপাশি অন্যান্য বিভিন্ন ধরনের গান শোনে। প্রায়ই নির্দিষ্ট কোনো ব্যান্ড বা ধারার সংগীত শোনে আপনার চরিত্ররা। এগুলো কি আপনার কাজে সহায়তা করে?
মুরাকামি : লেখার সময় আমি গান শুনি। তাই খুব স্বাভাবিকভাবেই আমার লেখায় সংগীতের প্রসঙ্গ চলে আসে। গানের ধরন নিয়ে ভাবি না। তবে গান আমার জন্য এক ধরনের খাদ্য, এটা লেখার শক্তি জোগায়।
দেবোরাহ : গান আপনাকে সুস্থ রাখে?
মুরাকামি : হ্যাঁ, খুব। গান ও বিড়াল। তারা আমাকে অনেক সহায়তা করে।
দেবোরাহ : নিউ ইয়র্কার যখন ‘কিলিং কম্যান্ডেটোর’-এর একটা অংশ প্রকাশ করেছিল, তখন আমি আপনার কাজের ‘অবাস্তব উপাদানগুলো’ নিয়ে প্রশ্ন করেছিলাম। জবাবে বলেছিলেন, ‘যখন আমি উপন্যাস লিখি, বাস্তবতা ও অবাস্তবতা স্বাভাবিকভাবেই একত্রে মিশে যায়। এটা এমন না যে আমার পরিকল্পিত, কিন্তু আমি লেখায় এটা অনুসরণ করি। তবে বাস্তবতা নিয়ে আমি যত বেশি বাস্তববাদী তরিকায় লেখার চেষ্টা করি, অবাস্তব জগৎ তত বেশি বিচ্ছিন্নভাবে হাজির হয়। আমার কাছে উপন্যাস একটা পার্টির মতো। যে কেউ চাইলে এখানে যোগ দিতে পারে কিংবা চলে যেতে পারে।’ তাহলে মানুষ ও অন্যান্য বিষয়কে এই পার্টিতে কীভাবে আমন্ত্রণ জানান? অথবা লেখার সময় আপনি কীভাবে এমন জায়গায় পৌঁছান যেখানে তারা বিনা আমন্ত্রণে চলে আসতে পারে?
মুরাকামি : পাঠকরা প্রায়ই বলেন, আমার কাজে একটা অবাস্তব জগৎ আছে, নায়ক সেখানে চলে যায় এবং আবার বাস্তব জগতে ফিরে আসে। কিন্তু অবাস্তব ও বাস্তব জগতের মাঝে আমি কখনো কোনো সীমারেখা দেখি না। তাই অনেক ক্ষেত্রে তারা (বাস্তব ও অবাস্তব) মিশে গেছে। আমি মনে করি জাপানে ‘অন্যান্য জগৎ’ আমাদের বাস্তব জীবনের খুব কাছাকাছি এবং আমরা যদি অন্যদিকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই, সেটাও খুব কঠিন নয়। আমি এটা অনুভব করেছি যে, পশ্চিমা বিশ্বে অন্যদিকে যাওয়া খুব সহজ নয়। অন্য দেশে যাওয়ার জন্য আপনাকে কিছু পরীক্ষা দিতে হবে। কিন্তু জাপানে আপনি যদি কোথাও যেতে চান যেতে পারেন। এ কারণে আমার গল্পে আপনি যদি কূপের একেবারে তলদেশে যান, সেখানেও একটা আলাদা জগৎ আছে এবং আপনি অবধারিতভাবে এপাশ-ওপাশের পার্থক্য বলতে পারবেন না।
দেবোরাহ : অন্যপাশ কি সচরাচর অন্ধকার?
মুরাকামি : তেমন না। আমি মনে করি, কৌতূহল নিয়ে আরও অনেক কিছু করা যায়। যদি কোথাও একটা দরজা থাকে এবং আপনি সেটা খুলতে ও অন্য জায়গায় প্রবেশ করতে পারেন, করে ফেলুন। এটা শুধুই কৌতূহল। ভেতরে কী? কী আছে সেখানে? আমি এটারই সন্ধান করি প্রতিনিয়ত। উপন্যাস লেখার সময় ভোর ৪টার দিকে উঠি এবং ডেস্কে বসে লেখা শুরু করি। এটা বাস্তব জগতে ঘটে। আমি বাস্তবের কফি খাই। তবে একবার লেখা শুরু করলে অন্য কোথাও চলে যাই। দরজাটা খুলে সে জায়গায় প্রবেশ করি এবং সেখানে কী ঘটছে তা দেখি। আমি জানি না, আমি ভাবি না- এটা বাস্তব জগৎ নাকি অবাস্তব। লেখায় যত মনোনিবেশ করি, আমি ততই গভীর থেকে আরও গভীরে, এক ধরনের আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যাই। সেখানে থাকাকালীন আমি কিছু অদ্ভুত জিনিসের মুখোমুখি হই। সেগুলো যখন নিজের চোখে দেখি, তখন স্বাভাবিক মনে হয়। সেখানে যদি কোনো অন্ধকার থাকে, যে অন্ধকার আমার দিকে আসে, সম্ভবত সেগুলোর একটা বার্তা আছে। বার্তাটি উপলব্ধির চেষ্টা করি। সেই জগৎটা ঘুরে দেখি। সেখানে যা যা দেখি তা বর্ণনা করি। এরপর ফিরে আসি। ফিরে আসাটা গুরুত্বপূর্ণ। আপনি যদি ফিরে আসতে না পারেন, তাহলে সেটা ভয়ংকর হবে। তবে আমি প্রফেশনাল বলে ফিরে আসতে পারি।
দেবোরাহ : ৪০ বছর আগে বেসবল খেলা দেখতে দেখতে হঠাৎ কীভাবে ভাবলেন, ‘আমি একটি উপন্যাস লিখতে পারি’; সেই গল্প বহুবার বলেছেন। যদিও এর আগে আপনি লেখার চেষ্টাও করেননি। আপনার স্মৃতিকথায় বলেছেন, ‘হোয়াট আই টক অ্যাবাউট হোয়েন আই টক অ্যাবাউট রানিং- মনে হচ্ছিল, যেন আকাশ থেকে কিছু একটা উড়ে আসছে, আর আমি পরিষ্কারভাবে সেটা আমার হাতে ধরছিলাম।’
জিনিসটা ছিল এই লেখার ক্ষমতা কিংবা হয়তো শুধু একটা ধারণা, যা আপনি চেষ্টা করেছেন। যদি আপনি খুব সাধারণ মানুষই হন, তাহলে এটা কোথা থেকে এসেছে এবং আপনার কাছে কেন এলো- এ ব্যাপারে আপনি কী ভাবেন?
মুরাকামি : এটা ছিল এক ধরনের অ্যাপিফ্যানি। আমি বেসবল পছন্দ করি। প্রায়ই বলপার্কে যাই। ১৯৭৮ সালে ২৯ বছর বয়সে আমার প্রিয় দল ইয়াকাল্ট সোয়ালোসের খেলা দেখতে টোকিওর বেসবল পার্কে গিয়েছিলাম। সেদিন উদ্বোধনী ছিল। দিনটি ছিল ঝলমলে। খেলা দেখছিলাম। প্রথম ব্যাটার দুবার আঘাত করল। ঠিক এই সময়ে উপলব্ধি করলাম, ‘আমি লিখতে পারি’। হয়তো অনেক বিয়ার গিলেছিলাম। আমি জানি না, কিন্তু ওই সময় মনে হচ্ছিল, আমার এক ধরনের অ্যাপিফ্যানি হলো। এর আগে আমি আদৌ কিছু লিখিনি। আমার একটি জাজ ক্লাব ছিল। সেখানে ককটেল ও স্যান্ডউইচ বানানো নিয়েই ব্যস্ত থাকতাম। আমি খুব ভালো স্যান্ডউইচ বানাতে পারি! কিন্তু ওই খেলার পর লেখার কাগজপত্র কিনতে সোজা দোকানে গেলাম। সেখান থেকে কিছু জিনিস কিনে লেখা শুরু করলাম এবং লেখক হয়ে গেলাম।
দেবোরাহ : এরপর ৪০ বছর পেরিয়ে গেছে। এই সময়ে আপনার লেখালেখির ধরন কেমন বদলেছে?
মুরাকামি : অনেক বদলে গেছে। যখন শুরু করি, কীভাবে লিখতে হয় জানতাম না। আমি খুব অদ্ভুত কৌশলে লিখতাম, তবে পাঠক সেটা পছন্দ করত। এখন আমার প্রথম বই ‘হিয়ার দি উইন্ড সিং’ ১৯৭৯ সালে প্রকাশিত হয়। এটা প্রকাশে খুব তাড়াহুড়ো হয়ে গিয়েছিল। অনেক বছর আগে টোকিওতে ট্রেনে বসে বই পড়ছিলাম। সুন্দর একটা মেয়ে কাছে এসে বলল, ‘আপনি মিস্টার মুরাকামি?।’ ‘হ্যা, আমি মিস্টার মুরাকামি।’ ‘আমি আপনার লেখার অনেক বড় ভক্ত।’ ‘অনেক ধন্যবাদ’। ‘আমি আপনার সব বই পড়েছি এবং সব ভালো লেগেছে।’ ‘ধন্যবাদ’। এরপর সে বলল, ‘আমার কাছে আপনার প্রথম বই বেশি ভালো লেগেছে। আমি মনে করি এটাই সবচেয়ে দারুণ।’ ‘ওহ, তুমি মনে করো?।’ সে বলল, ‘দিন দিন লেখা খারাপ হয়ে যাচ্ছে।’ আমি সমালোচনায় অভ্যস্ত হয়ে গেলাম। কিন্তু তার মন্তব্যে একমত নই। আমি আরও ভালো লিখছি বলে মনে করি। ৪০ বছর ধরে ভালো লেখার চেষ্টা করছি এবং মনে করছি, ভালো হচ্ছে।
ট্রেনের সেই মেয়েটি জিন কুইল নামে এক জাজ মিউজিশিয়ানের কথা মনে করিয়ে দিয়েছিল। উনিশশ পঞ্চাশ-ষাটের দশকে বিখ্যাত এই মিউজিশিয়ান স্যাক্সোফোন বাজাতেন। ওই সময়ে আরও অনেক বিখ্যাত স্যাক্সোফোন বাদক ছিলেন। জিন কুইল মূলত চার্লি পার্কার (আমেরিকান স্যাক্সোফোন বাদক) দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। এক রাতে তিনি নিউ ইয়র্কার জাজ ক্লাবে বাজাচ্ছিলেন। ব্যান্ডস্ট্যান্ড থেকে বের হওয়ার সময় এক যুবক তার কাছে এসে বললেন, ‘এই, আপনারা তো সব চার্লি পার্কারের মতো বাজাচ্ছেন।’ জিন বললেন, ‘কী?’, ওই যুবক আবারও বললেন, ‘আপনারা সব চার্লি পার্কারের মতো করছেন।’ আল্টো স্যাক্সোফোনটি ওই যুবকের হাতে ধরিয়ে দিয়ে জিন বললেন, ‘নেন, আপনি চার্লি পার্কারের মতো বাজিয়ে দেখান!’
এই ঘটনার তিনটি পয়েন্ট আছে বলে আমি মনে করি। প্রথমত, সমালোচনা করা খুব সহজ। দ্বিতীয়ত, খাঁটি জিনিস তৈরি করা খুব কঠিন। কিন্তু তৃতীয়ত, কাউকে এটা করতে হবে। আমি এটা ৪০ বছর ধরে করছি। এটাই আমার কাজ।
দেবোরাহ : আপনি বলেছিলেন, প্রথম দুটি বই লেখা খুব সহজ ছিল। পরে এটা একটু কঠিন হয়ে পড়ল। আপনার সংগ্রামটা কেমন ছিল?
মুরাকামি : খুব সহজেই প্রথম দুটি বই ‘হিয়ার দি উইন্ড সিং’ ও ‘পিনবল ১৯৭৩’ লিখে ফেলেছিলাম। তবে এই বইগুলো নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলাম না। আমি এখনও সন্তুষ্ট নই। বই দুটি লেখার পর আরও উচ্চাকাক্সক্ষী হয়ে উঠলাম। প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য উপন্যাস ‘অ্যা ওয়াইল্ড শিপ চেজ’ লিখলাম।
অন্য দুটি ছিল নোভেলার মতো । এটা লিখতে তিন-চার বছর সময় লেগেছিল। আমার ধারণা, প্রস্রবণ করতে একটি গর্ত খুঁড়েছিলাম। সুতরাং আমি মনে করি, ‘অ্যা ওয়াইল্ড শিপ চেজ’ আমার সত্যিকার ক্যারিয়ারের সূচনা বিন্দু। প্রথম তিন বছর জাজ ক্লাবের মালিক হিসেবে কাজ করার সময় লেখালেখি করতাম। রাত ২টায় কাজ শেষ করে রান্নাঘরের টেবিলে লিখতে বসে যেতাম। এটা আমার জন্য খুব বেশি হয়ে গিয়েছিল। প্রথম দুটি বই লেখার পর সিদ্ধান্ত নিলাম, জাজ ক্লাব বিক্রি করে পুরোদস্তুর লেখক হয়ে যাব। কিন্তু ক্লাবটি ভালো চলছিল। সবাই এটা বিক্রি না করার পরামর্শ দিল।
দেবোরাহ : দৈনন্দিন কাজ ছাড়বেন না!
মুরাকামি : এরপর ‘অ্যা ওয়াইল্ড শিপ চেজ’ লিখলাম। আমি একটি বড় বই লিখতে চেয়েছিলাম।
দেবোরাহ : বড় বই লেখা কি সহজ ছিল? কিংবা এতে আরও চ্যালেঞ্জ ছিল?
মুরাকামি : ‘অ্যা ওয়াইল্ড শিপ চেজ’ লেখার সময় খুব এক্সাইটেড ছিলাম। কারণ আমি জানতাম না এরপর কী হতে চলেছে। পরবর্তী দিন আসার জন্য অপেক্ষা করতে পারছিলাম না। উদঘাটন করতে চাইতাম, এরপর কী ঘটতে পারে। পৃষ্ঠা উল্টাতে চাইতাম, কিন্তু সেখানে কোনো কিছু বা কোনো লেখা থাকত না। সেগুলো আমাকে লিখতে হয়েছিল।