
বাংলাদেশ ভারত ম্যাচ মানেই বাড়তি উত্তেজনা। খেলার মাঠে হার না মানসিকতা। ক্রিকেট বিশ্বে বাংলাদেশ-ভারত এখন শক্ত প্রতিদ্বন্দী। দুই দলের ম্যাচ মানেই টান টান উত্তেজনা। মাঠের খেলার এই উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে দুই দেশের ক্রীড়াপ্রেমিদের মাঝেও। মাঠে এবং মাঠের বাইরেও এই সম্পর্কের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে গেছে, যা প্রতিটি ম্যাচকে এক নতুন মাত্রা দিয়েছে। ২০২৫ সাল পর্যন্ত ভারত-বাংলাদেশ ক্রিকেটের উত্তপ্ত ঘটনাপ্রবাহ বর্ণনা করা হল।
ভারত-বাংলাদেশ ক্রিকেট দ্বৈরথের শুরু হয় ২০০৭ সালে। ২০০৭ সালের ওয়েস্ট ইন্ডিজ বিশ্বকাপে ভারতকে গ্রুপ পর্বে হারিয়ে দেয় বাংলাদেশ। দেশের ক্রিকেট ইতিহাসে বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে প্রথমবার বড় একটি জয় পায় সাকিব-তামিমদের নিয়ে গড়া আনকোড়া বাংলাদেশ। ভারতের মতো শক্তিশালী দলের বিপক্ষে এই জয়টি শুধু বাংলাদেশের জন্যই ছিল ঐতিহাসিক ছিল না, বরং ক্রিকেট বিশ্বকেও চমকে দিয়েছিল। বাংলাদেশের বিপক্ষে হেরে গ্রুপ পর্ব থেকে বাদ পরে ভারত। বেশ কয়েকজন ক্রিকেটার; শোচিন,রাহুল দ্রাবিরদের বাড়িতে আগুন, হামলা চালিয়েছিল ভারতীয় দর্শকেরা। এই ম্যাচের পর থেকেই বাংলাদেশকে ভারতের অন্যতম প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে বিবেচনা করা হতে থাকে।
এরপর ২০১০ সালে ভারতীয় ওপেনার বীরেন্দর শেবাগ বাংলাদেশ দলের সম্পর্কে একটি বিতর্কিত মন্তব্য করেন, যেখানে তিনি বাংলাদেশকে 'অর্ডিনারি' বা সাধারণ মানের দল হিসেবে আখ্যায়িত করেন। এ মন্তব্যটি বাংলাদেশি ক্রিকেট সমর্থকদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি করে এবং দুই দেশের ক্রিকেট সম্পর্কের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়।
২০১২ সালে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো এশিয়া কাপের ফাইনালে ওঠে। তবে ভারত গ্রুপ পর্বেই বাদ পড়ে যায়। এই ফাইনালে বাংলাদেশ একটি শক্তিশালী দল হিসেবে আত্মবিশ্বাসী ছিল, যদিও তারা শেষ পর্যন্ত জয় পায়নি। এই পরাজয় বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে একটি বড় শোক হিসেবে পরিচিত।
২০১৪ সালে বাংলাদেশর বিপক্ষে ভারত তৃতীয় সারির দলকে পাঠায়। কিন্তু সেই সিরিজে বাংলাদেশ ভারতকে হারাতে ব্যর্থ হয়, এবং শোচনীয় পরাজয়ের শিকার হয়। এর ফলে বাংলাদেশি সমর্থকদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়, বিশেষত যখন ভারতীয় বিশ্লেষকরা বাংলাদেশ দল সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করতে শুরু করেন।
সবচেয়ে বিতর্কিত ঘটনা ঘটে ২০১৫ সালে। ২০১৫ সালের বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে শফিউল ইসলাম রোহিত শর্মাকে আউট করেন, কিন্তু আম্পায়ার নো-বল না ঘোষণা করলে ব্যাপক বিতর্ক সৃষ্টি হয়। এই ঘটনায় বাংলাদেশি সমর্থকরা তীব্র প্রতিবাদ জানায়, এবং বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি মোস্তফা কামালও আম্পায়ারিংয়ের সমালোচনা করেন।
২০১৫ সালে বাংলাদেশ সফরে আসে ভারত। বাংলাদেশ দলে অভিষেক ঘটে কাটার মাস্টার মুস্তাফিজুর রহমানের। মুস্তাফিজুরের অসাধারণ পারফরম্যান্সে প্রথমবারে মত ভারতকে ওয়ানডে সিরিজে হারায় বাংলাদেশ। ভারতীয় অধিনায়ক ধোনি মুস্তাফিজকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলে ব্যাপক বিতর্কও সৃষ্টি হয়। দেশের ক্রীড়াপ্রেমিদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করে।
২০১৬ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারত-বাংলাদেশের ম্যাচটি সমগ্র ক্রিকেট বিশ্বে আলোচিত হয়ে ওঠে। শেষ মুহূর্তে তিন বলে দুই রান দরকার থাকা অবস্থায় বাংলাদেশ ম্যাচটি হেরে যায়। মুশফিক-মাহমুদুল্লাহদের মত অভিজ্ঞ ব্যাটাররা তিন বলে দুই রান নিতে ব্যর্থ হয়। হৃদয় ভাঙ্গে দেশের ক্রীড়াপ্রেমিদের। ভারতের সমর্থকরা সোশ্যাল মিডিয়ায় বাংলাদেশকে নিয়ে ব্যাপক ট্রল করে। এই ঘটনা বাংলাদেশি সমর্থকদের কাঁটা গায়ে নুনের ছিটা দেয়।
২০১৮ সালের এশিয়া কাপের ফাইনালে ভারত-বাংলাদেশ মুখোমুখি হয়। এই ম্যাচে লিটন দাসের স্ট্যাম্পিং নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়, যদিও বাংলাদেশ শেষ পর্যন্ত পরাজিত হয়। এর আগের বছর, ২০১৭ সালে, বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কায় নিদাহাস ট্রফির ফাইনালে শেষ মূহুর্তে হেরে যায়। তবে বিতর্কের রেশ থেকে যায়।
২০২০ সালের অনূর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেট বিশ্বকাপের ফাইনালে বাংলাদেশ ভারতকে হারিয়ে প্রথমবার বিশ্বকাপ জেতে। ম্যাচের পর বাংলাদেশি ক্রিকেটারদের উল্লাস কিছুটা অতিরিক্ত ছিল বলে ভারতীয়রা মন্তব্য করেন, যা ভারতীয় ক্রিকেটারদের ক্ষোভের জন্ম দেয়। তবে, বাংলাদেশ এই জয়টিকে তাদের ক্রিকেট ইতিহাসে একটি মাইলফলক হিসেবে গণ্য করে।
২০২২ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারত এবং বাংলাদেশ একে অপরের বিরুদ্ধে খেলছিল। বাংলাদেশ যখন জয়ী হওয়ার কাছাকাছি চলে গিয়েছিল, তখন বৃষ্টি বাধায় খেলা থেমে যায়। তারপর মাঠে নামার সময় আম্পায়াররা তাড়াহুড়ো করে মাঠ পর্যবেক্ষণ করেন, দলের অধিনায়ক সাকিব আল হাসান মাঠ থেকে ব্যাটারদের উঠে আসতে বলেন। বাংলাদেশ ম্যাচটি হেরে যায়, তবে এ নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় বিতর্ক চলে।
২০২৩ সালে বাংলাদেশ নারী দল ভারতের বিপক্ষে প্রথমবারের মত ওয়ানডে সিরিজ জয় করে। এই সিরিজ জয়টি বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত হিসেবে ধরা হয়, যেখানে তারা ভারতের বিপক্ষে হোম সিরিজে জয়ী হয়। এই জয়টি বাংলাদেশের ক্রিকেট সমর্থকদের মধ্যে নতুন আশার সঞ্চার করে। ২০২৩ সালের নারী ক্রিকেট সিরিজে, ভারতীয় অধিনায়ক হারমানপ্রিত কৌর একটি বিতর্কিত মন্তব্য করেন, যেখানে তিনি বলেন, ‘আম্পায়ারদেরও নিয়ে আসো তোমরা’। এই মন্তব্যটি ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয় এবং ভারতীয় মিডিয়া এবং ক্রিকেট বোদ্ধাদের কাছ থেকে তীব্র প্রতিক্রিয়া আসে। এই ঘটনাটি ভারত-বাংলাদেশ ক্রিকেট সম্পর্কের মধ্যে একটি নতুন মাত্রা যোগ করে।