Image description

দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি এবং আসন্ন সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজশাহী অঞ্চলের সীমান্ত দিয়ে অবৈধ অস্ত্র অনুপ্রবেশের তৎপরতা বেড়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং একাধিক গোয়েন্দা সূত্রের তথ্যমতে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় অবস্থানরত কয়েকজন পলাতক রাজনৈতিক নেতা ও সন্ত্রাসী এই অস্ত্র পাচারচক্রের নেপথ্য নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করছে। তাদের নির্দেশনায়

সীমান্তজুড়ে সক্রিয় রয়েছে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট।

গোয়েন্দা সূত্র জানায়, পদ্মা নদী ও রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্ত ঘিরে গড়ে ওঠা এই অস্ত্র চোরাচালান নেটওয়ার্কের সঙ্গে অতীতে রাজশাহী অঞ্চলের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কয়েকজন প্রভাবশালী নেতার সংশ্লিষ্টতা ছিল। মামলা ও তদন্তের চাপে তারা ভারতে পালিয়ে গেছেন। সেখান থেকেই তারা বাংলাদেশে থাকা অনুসারী ও সহযোগীদের মাধ্যমে অস্ত্র পাচার কার্যক্রম পরিচালনা করছেন।

একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, পূর্ববর্তী সরকারের সময় স্থানীয় এমপি ও উপজেলা চেয়ারম্যানদের ছত্রছায়ায় যারা অস্ত্র কারবারে যুক্ত ছিল, তাদের কেউ দেশে ফিরে সক্রিয় হয়েছে, কেউ বিদেশে থেকেই নেটওয়ার্ক পরিচালনা করছে, আবার কেউ কারাগারে থেকেও সিন্ডিকেটের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে।

সীমান্ত রুট ও নজরদারি

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে সবচেয়ে বেশি আগ্নেয়াস্ত্র প্রবেশ করছে। র‌্যাবের একটি সূত্র জানায়, ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সহিংসতার আশঙ্কায় বিভিন্ন চক্র দেশি-বিদেশি অস্ত্র মজুত করছে। এ পরিস্থিতিতে র‌্যাব-৫ সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থানে রয়েছে।

এদিকে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) জানিয়েছে, অস্ত্রসহ যেকোনো অবৈধ পণ্যের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সীমান্তে নজরদারি জোরদার করা হয়েছে এবং গোয়েন্দা তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে।

সাম্প্রতিক উদ্ধার ও অভিযান

গত ১৫ ডিসেম্বর চাঁপাইনবাবগঞ্জের মনোহরপুর সীমান্ত থেকে বিজিবি চারটি বিদেশি পিস্তল, ৯টি ম্যাগাজিন ও ২৪ রাউন্ড গুলি জব্দ করে। বিজিবির চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৫৩ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল কাজী মুস্তাফিজুর রহমান জানান, গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্রে প্রস্তুত এসব অস্ত্র জব্দ করা হয়।

এর আগে ২৬ অক্টোবর বনলতা এক্সপ্রেস ট্রেন থেকে আটটি বিদেশি পিস্তল, ১৬টি ম্যাগাজিন, গুলি, গানপাউডার ও প্লাস্টিক বিস্ফোরক উদ্ধার করা হয়। গোয়েন্দা সূত্রের দাবি, চালানটি ভারতীয় সীমান্ত পেরিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ দিয়ে দেশে প্রবেশ করেছিল।

এছাড়া ১৬ আগস্ট রাজশাহীর বোয়ালিয়া থানায় সেনাবাহিনীর বিশেষ অভিযানে সাবেক মেয়র ও আওয়ামী লীগ নেতা খায়রুজ্জামান লিটনের চাচাতো ভাই মোন্তাসেরুল আলম অনিন্দ্যকে আটক করা হয়। অভিযানে উদ্ধার করা হয় দুটি বিদেশি এয়ারগান, একটি রিভলবার, ছয়টি দেশি অস্ত্র, একটি টেজারগান, চারটি ওয়াকিটকি ও একটি বাইনোকুলার। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে রাজশাহী ও নওগাঁ এলাকায় সেনাবাহিনী, র‌্যাব ও পুলিশের অভিযানে একাধিক বিদেশি ও দেশি অস্ত্র জব্দ এবং সংশ্লিষ্টদের আটক করা হয়েছে।

অস্ত্রের উৎস ও পাচার কৌশল

গোয়েন্দা সূত্র জানায়, জব্দ করা অস্ত্রের গায়ে ‘জাপান’ বা ‘ইউএসএ’ লেখা থাকলেও অধিকাংশই ভারতের বিহারের মুঙ্গেরে তৈরি। গ্রেপ্তার হওয়া বহনকারীদের স্বীকারোক্তিতে জানা গেছে, বিদেশি নাম লেখা থাকলে অস্ত্রের দাম দ্বিগুণ হয়ে যায়। এসব অস্ত্র প্রথমে পশ্চিমবঙ্গের মালদা ও মুর্শিদাবাদের বিভিন্ন এলাকায় মজুত করে পরে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে পাঠানো হয়। পাচারকাজে সবজি ও ফলের চালান ব্যবহার করা হয়, আর বহনকারীদের বেশিরভাগই কিশোর ও যুবক।

রাজনৈতিক ছত্রছায়ার অভিযোগ

স্থানীয় সূত্রগুলোর দাবি, কলকাতায় অবস্থানরত পলাতক নেতারা বাংলাদেশে তাদের পুরোনো রাজনৈতিক নেটওয়ার্ক ব্যবহার করছেন। দেশে থাকা আওয়ামী লীগের কিছু স্থানীয় নেতাকর্মী অস্ত্রের ক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ, চালান পৌঁছে দেওয়া এবং অর্থ লেনদেনে সহায়তা করছেন।

রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করছেন, রাজনৈতিক ছত্রছায়া ও সীমান্তের আন্তর্জাতিক রুট ব্যবহারের কারণে এই অপরাধচক্র ভাঙা কঠিন হয়ে পড়েছে। অবৈধ অস্ত্রের মজুত আসন্ন নির্বাচনি পরিবেশকে বড় ঝুঁকির মুখে ফেলতে পারে।

সাম্প্রতিক সময়ে একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের উদ্দেশ্যে রাজশাহীর চারঘাট-বাঘা সীমান্ত দিয়ে গানপাউডার ও অস্ত্র দেশে প্রবেশ করছে। এসব অস্ত্র বিভিন্ন হাত ঘুরে রাজধানীসহ দেশের নানা অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ছে। সূত্রের দাবি, ভারতের কলকাতাসহ রাজশাহী অঞ্চলের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলো থেকে কয়েকজন পলাতক সাবেক এমপি, মেয়র ও চিহ্নিত সন্ত্রাসী এই সিন্ডিকেটটি নিয়ন্ত্রণ করছে।

স্থানীয় একটি সূত্রের অভিযোগ, দেশে বসেই অস্ত্র পাচারের তদারকি করছেন সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত মোহাম্মদ মানিক। তবে তিনি এ অভিযোগ অস্বীকার করে একে ‘অপপ্রচার’ বলে দাবি করেছেন।

রাজশাহীর পদ্মা নদীর খানপুর সীমান্তে দায়িত্বরত কয়েকজন বিজিবি সদস্য জানান, অধিনায়কের নির্দেশে আমরা কঠোরভাবে দায়িত্ব পালন করছি।

চারঘাট উপজেলার ইউসুফপুর চর এলাকার কৃষক সোলায়মান হোসেন জানান, সম্প্রতি এলাকায় অপরিচিত যুবকদের চলাচল বেড়েছে। বিজিবি ইউসুফপুর কোম্পানি কমান্ডার সুবেদার সোলায়মান বলেন, সীমান্তে টহল ও গোয়েন্দা নজরদারি জোরদার করা হয়েছে। অবৈধ অনুপ্রবেশের চেষ্টা হলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বিজিবি রাজশাহী ব্যাটালিয়ন-১-এর পরিচালক লে. কর্নেল রিয়াজ শাহরিয়ার বলেন, অস্ত্র ও বিস্ফোরকসহ যেকোনো অবৈধ সামগ্রী অনুপ্রবেশ রোধে বিজিবি সর্বদা সজাগ রয়েছে। র‌্যাব-৫-এর একটি সূত্র জানায়, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সহিংসতার লক্ষ্যে অস্ত্র মজুতের তথ্য পাওয়া গেছে। আমরা এ ব্যাপারে সতর্ক রয়েছি।

রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, রাজনৈতিক ছত্রছায়া ও সীমান্তে আন্তর্জাতিক রুট ব্যবহারের কারণে অস্ত্র পাচারচক্র ভাঙা কঠিন হয়ে পড়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক আনোয়ার হোসেন বলেন, দেশে চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করতে এবং ২০২৬ সালের নির্বাচনকে ‘টার্গেট ইভেন্ট’ হিসেবে ধরে নিয়ে বিভিন্ন অশুভ শক্তি অস্ত্রের মজুত বাড়াচ্ছে। ভারতে বসে থাকা পলাতকরা এই সহিংসতার বাজার তৈরি করে নিজেদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব বজায় রাখতে চাইছে। স্থানীয়ভাবে তাদের দলের কিছু লোকের সমর্থন এই অপরাধ সংঘটনে সহায়তা করছে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. তারেক মো. তৌফিকুর রহমান বলেন, অবৈধ অস্ত্রের মজুত নির্বাচনি পরিবেশকে ঝুঁকির মুখে ফেলতে পারে। এ জন্য নির্বাহী বিভাগ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। একইসঙ্গে গোয়েন্দা সংস্থার সহযোগিতায় অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও পাচার রোধে কঠোর ব্যবস্থা প্রয়োজন।

সব মিলিয়ে সীমান্তজুড়ে অস্ত্র পাচারের এই নেটওয়ার্ক শুধু আইনশৃঙ্খলার জন্যই নয়, আসন্ন নির্বাচনি পরিবেশের জন্যও বড় হুমকি হয়ে উঠছে। এই হুমকি অপসারণে কার্যকর ও সমন্বিত অভিযানের কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।