ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক প্রেস সচিব ও বিশিষ্ট সাংবাদিক নাঈমুল ইসলাম খান শারীরিক বিভিন্ন অসুস্থতায় ভুগছেন। ঢাকার বেসরকারি একটি হাসপাতালে চিকিৎসা করাচ্ছেন, চিকিৎসক বিভিন্ন পরীক্ষা করাতে পরামর্শ দিয়েছেন তাকে। বেসরকারি ওই হাসপাতালের সূত্র সুখবর ডটকমকে জানায়, বয়সজনিত একাধিক রোগের সঙ্গে তার শরীরে নতুন রোগের কিছু উপসর্গ দেখা দিয়েছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার ভিত্তিতে আগামী সপ্তাহে জানা যাবে তিনি নতুন কোনো রোগে আক্রান্ত কিনা।
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, ওই হাসপাতালে সশরীরে উপস্থিত হয়ে নাঈমুল ইসলাম চিকিৎসা ও পরীক্ষা করাচ্ছেন। গত বছরের অভুত্থানে আওয়ামী লীগের সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তার অবস্থান নিয়ে যে নানা জল্পনা-কল্পনা ছিল, এ বিষয়ে আবারও নিশ্চিত হওয়া গেছে হাসপাতালের ওই সূত্রের তথ্যের মাধ্যমে। তিনি দেশেই অবস্থান করছেন। শারীরিক অসুস্থতায় অনেকটা ভেঙে পড়েছেন তিনি। আওয়ামী লীগের সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর 'আত্মগোপনে' থাকতে বাধ্য হওয়ায় নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা যথাসময়ে করাতে পারেননি তিনি।
এতে নাঈমুল ইসলাম খানের শরীরে রোগের তীব্রতা বেড়েছে বলে বেসরকারি ওই হাসপাতালের একাধিক চিকিৎসকের আশঙ্কা। তাছাড়া বিদ্যমান রাজনৈতিক বাস্তবতা, মামলা-মোকদ্দমা ও গ্রেপ্তার হওয়ার ভয় ইত্যাদি কারণে যে মানসিক বিপর্যয় ঘটে, এতেও শারীরিক অসুস্থতার তীব্রতা বাড়ে বলে চিকিৎসকদের অভিমত। তবে সরকারের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র সুখবর ডটকমকে জানায়, 'আত্মগোপনে' থাকলেও তাকে গ্রেপ্তার করা হবে না, এই আশ্বাস নাঈমুল ইসলাম সরকারের প্রভাবশালী এক উপদেষ্টার কাছ থেকে পেয়েছেন। ওই উপদেষ্টার গ্রামের বাড়ি বৃহত্তর কুমিল্লায়।
এই আশ্বাস পাওয়ায় সুযোগ থাকা সত্বেও নাঈমুল ইসলাম খান বিদেশে যাননি। 'আত্মগোপনে' থাকা অবস্থাতেই তিনি কুমিল্লায় নিজের জমি বিক্রি করতে পেরেছেন, তার মালিকানাধীন আমাদের নতুন সময় পত্রিকার মালিকানা আরেকজনের কাছে হস্তান্তর করেছেন এবং হাসপাতালে সশরীরে উপস্থিত হয়ে চিকিৎসা করাতে পারছেন। সরকারের সমর্থন ছাড়া এসব করা সম্ভব হত না। তিনি স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে ঢাকার বেসরকারি ওই হাসপাতালে সবশেষ গত বুধবার (১০ই ডিসেম্বর) বিকেলে উপস্থিত হন বলেও সূ্ত্রটি উল্লেখ করে।
এদিকে নাঈমুল ইসলাম খানের মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘাতকদের সঙ্গে হাত মেলানো খন্দকার মোশতাকের ‘ছায়া’ দেখেন সাংবাদিক ও কলামিস্ট আনিসুল হক। তিনি এক বক্তব্যে ইঙ্গিত দেন, ২০২৪ সালের ৫ই আগস্ট আওয়ামী লীগের সরকারের ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পেছনে সরকারের ভেতর থেকে যারা জড়িত ছিলেন, তাদের তালিকায় নাঈমুল ইসলাম খানও আছেন। এসব বিষয়ে কথা বলতে বৃহস্পতিবার (১১ই ডিসেম্বর) বিকেলে ও রাতে কয়েকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে নাঈমুল ইসলাম খানের মুঠোফোন নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়।
জুলাই অভুত্থানের পর নাঈমুল ইসলামের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনসহ বিভিন্ন অভিযোগে একাধিক মামলা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে ঢাকা, বগুড়া ও রংপুরে হত্যা মামলা রয়েছে। আদালত তার এবং তার পরিবারের চার সদস্যের মোট ১৬৩টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দের নির্দেশ দেন। আওয়ামী লীগের ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার মাত্র দুই মাসেরও কম সময়ের আগে তিনি প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব হিসেবে নিয়োগ পান। আজকের কাগজ, ভোরের কাগজ ও আমাদের সময়ের সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করা নাঈমুল ইসলাম প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব হওয়ার আগে ছিলেন আমাদের নতুন সময়ের ইমেরিটাস সম্পাদক।
নাঈমুল ইসলামের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের সঙ্গে হাত মেলানো খন্দকার মোশতাকের ‘ছায়া’ দেখেন আনিসুল হক। তিনি দৈনিক প্রথম আলোর সাংবাদিক ও নামকরা সাহিত্যিক। নাঈমুল ইসলামকে যেদিন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব হিসেবে নিয়োগ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়, সেদিনই আনিসুল হক ‘ভবিষ্যদ্বাণী’ করেছিলেন যে, শেখ হাসিনার পতন আসন্ন। এ 'ভবিষ্যদ্বাণী' সত্যও হয়েছিল বলেও তার দাবি।
তিনি বলেন, ‘ওই নিয়োগের (নাঈমুল ইসলামকে প্রেস সচিব) দুই মাস পূর্ণ হওয়ার আগেই জনতার বিক্ষোভের প্রবল তরঙ্গ-অভিঘাতে শেখ হাসিনা ও তার ১৫ বছরের শাসনের লৌহদুর্গ খড়কুটোর মতো ভেসে যায় এবং তার উপলক্ষটা হয়, ওই প্রেস সচিব সঞ্চালিত একটা সাংবাদিক সম্মেলনে দুই সাংবাদিকের (একাত্তর টিভির সাবেক সাংবাদিক ফারজানা রূপা ও এটিএন নিউজের সাবেক সাংবাদিক প্রভাষ আমিন) মোসাহেবি মার্কা দুটো প্রশ্ন।’
আনিসুল হক বলেন, ‘জুন মাসের ৭ তারিখ, ২০২৪। প্রজ্ঞাপন জারি হলো, তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রেস সচিব হিসেবে একজন সম্পাদককে (নাঈমুল ইসলাম খান) নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষুদ্র কলাম লেখক (আনিসুল হক) তা দেখে তার পত্রিকার বার্তাকক্ষে সহকর্মীদের উদ্দেশে একটা ভবিষ্যদ্বাণী উচ্চারণ করেন, হাসিনা সরকারের পতনের আর দেরি নেই। সাংবাদিক সহকর্মীরা বললেন, এটা কেন বলছেন?’
তখন আনিসুল হক বলেন, ‘বলছি, তার কারণ আছে। বঙ্গবন্ধু তার পরিবারকে বলেছিলেন, যদি কোনো বিপদ আসে, প্রথম ফোনটা করবে তোমাদের মোশতাক চাচাকে। খন্দকার মোশতাক বিদূষক হিসেবে ছিলেন সবচেয়ে এগিয়ে।’ দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত একটি কলামে এসব কথা বলেন আনিসুল হক। শেখ হাসিনার সরকারের ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার মাত্র ১৯ দিন পর আনিসুল হক সাবেক সরকারের প্রতি তার সমর্থন 'প্রত্যাহার' করে এমন দাবি করেন। ২০২৪ সালের ২৪শে আগস্ট 'ভোট ও বাক্স্বাধীনতা না থাকলে যা হয়...' শিরোনামে তার লেখাটি প্রকাশিত হয়।
অবশ্য আনিসুল হক নিজেও আওয়ামী লীগের পুরো শাসনামলে দলটি ও এর নেতৃত্বে গঠিত সরকারের ‘গুণমুগ্ধ’ ছিলেন। সরকারের বিভিন্ন অন্যায়কেও তিনি বিভিন্ন সময় সমর্থন করে কলাম লিখেছেন। সরকারকে ব্রিবত করে, এমন লেখা আওয়ামী লীগের টানা দেড় দশকের শাসনামলে তিনি একবারও লেখেননি। ভিন্ন রাজনৈতিক পরিবেশ পেয়ে তিনি নাঈমুল ইসলাম খানের উপর দায় চাপিয়ে দিচ্ছেন বলে অনেকের অভিযোগ।
এক হিসাব অনুযায়ী, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের দেড় বছর পর হত্যা ও সহিংসতা মামলার বেড়াজালে জড়িয়ে আছে অন্তত ২৯৬ জন সাংবাদিকের নাম। নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শাসনামলে তাদের বিরুদ্ধে এসব মামলা দায়ের হয়েছে। ইংরেজি পত্রিকা ডেইলি স্টারের তৈরি করা ২৯৬ জনের তালিকায় থাকা সাংবাদিকদের প্রায় ২০ শতাংশের আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক ছিল—যাদের কেউ কেউ দলটির প্রচারণায় অংশ নিয়েছেন, কেউ কেউ ছিলেন সংগঠনের পদে।
তাদের মধ্যে রয়েছেন নারায়ণগঞ্জের কমল খান ও রাজু আহমেদ। তারা সাবেক সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের ঘনিষ্ঠ। একজনকে শামীম ওসমানের সশস্ত্র গ্রুপের সঙ্গে দুটি বন্দুক নিয়ে গুলি করতেও দেখা গেছে। জ্যেষ্ঠ ও কেন্দ্রীয় পর্যায়ের অন্যান্য ১৩ জনের মধ্যে আছেন নাঈমুল ইসলাম খান, যিনি ছিলেন শেখ হাসিনার প্রেস সচিব। মামলায় অভিযুক্ত সাংবাদিকেরা ৫৩টি মিডিয়া হাউসের সঙ্গে যুক্ত, যার মধ্যে রয়েছে ৩০টি জাতীয় পত্রিকা ও টেলিভিশন স্টেশন। অভিযুক্ত সাংবাদিকদের মধ্যে প্রায় ৭৪ শতাংশ ঢাকার বাইরের।
এদিকে গত ১৮ই মার্চ নাঈমুল ইসলাম খান, তার স্ত্রী নাসিমা খান ও তাদের তিন মেয়ের নামে থাকা ১৬৩টি ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করার আদেশ দেন আদালত। একইসঙ্গে তার বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন আদালত। এর আগে, গত বছরের ২৫শে আগস্ট নাঈমুল ইসলাম ও তার স্ত্রী-সন্তানদের ব্যাংক হিসাব স্থগিত করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা বিভাগ বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)।
'আত্মগোপনে' থাকা অবস্থাতেই ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে কুমিল্লায় জমি বিক্রি করেন নাঈমুল ইসলাম খান। এর আগেই তার বিরুদ্ধে রাজধানী ঢাকা, বগুড়া ও রংপুরে হত্যা মামলা দায়ের হয়। জমি বিক্রির ঘটনার আগে নাঈমুল ইসলাম ও তার স্ত্রী-সন্তানদের ব্যাংক হিসাব স্থগিত করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা বিভাগ বিএফআইইউ।