Image description

বিশিষ্ট সাংবাদিক ও ইংরেজি পত্রিকা ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম মনে করেন, টানা ১৫ বছরের শাসনামলে শেখ হাসিনা দেশের অর্থনীতিতে অসামান্য উন্নয়ন অর্জন করেছেন। অবকাঠামো নির্মাণ ও বিদ্যুৎ উৎপাদনে (যদিও ক্যাপাসিটি চার্জের বিষয়টি বড় আকারে প্রশ্নবিদ্ধ) তার অসাধারণ অর্জন প্রশংসার দাবিদার। উন্নয়নের ধারায় বাংলাদেশের প্রশংসনীয় অগ্রগতি অবশ্যই রাষ্ট্র পরিচালনায় শেখ হাসিনার যোগ্য ও অবিচল নেতৃত্বের ফল।

আওয়ামী লীগের মূল্যায়ন করে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের গর্বিত হওয়ার মতো অসংখ্য কারণ রয়েছে। তাদের রয়েছে ঈর্ষণীয় সব অর্জন। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের অসংখ্য রাজনৈতিক দলের তুলনায় আওয়ামী লীগের রেকর্ড অসামান্য বলে বিবেচনা করা যায়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রাম-আন্দোলনের স্মৃতিচারণ করে বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহফুজ আনাম বলেন, আমরা যারা সেই সময়ে ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলাম, তারা এর প্রত্যক্ষদর্শী। আমাদের সৌভাগ্য হয়েছে তার (বঙ্গবন্ধু) মন্ত্রমুগ্ধকর ভাষণ শোনার। আমরা একইসঙ্গে পাকিস্তানের শক্তিশালী সশস্ত্র বাহিনী ও অভিজাতদের বিরুদ্ধে তার রুখে দাঁড়ানোর সাহস দেখে বিস্মিত হয়েছি।

তিনি বলেন, আমরা স্বচক্ষে দেখেছি যে কীভাবে তিনি তার (বঙ্গবন্ধু) অতুলনীয় কারিশমায় বাঙালিদের একাত্ম করেছিলেন। অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে অনুভব করেছিলাম যে শেষ পর্যন্ত এমন একজন নেতা পেয়েছি, যিনি আমাদের মুক্তি ও স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পারবেন।

মাহফুজ আনাম উল্লেখ করেন, আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বেই প্রকৃত অর্থে জনগণের কাছে পৌঁছাতে ও জনপ্রিয়তা অর্জন করতে সক্ষম হয় এবং বাঙালির আশা-ভরসার দলে পরিণত হয়। সেটা ছিল দারুণ একটি সময়—যখন প্রকৃত অর্থেই লাখো সাধারণ মানুষকে উজ্জীবিত করে তাদের অন্তরের অন্তঃস্থলে পৌঁছে যায় দলটি এবং একইসঙ্গে তাদের শতভাগ ভালোবাসা, সমর্থন ও আস্থা অর্জন করে।

তার মতে, ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ছিল দেশের সব ধরনের গণতান্ত্রিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের রচয়িতা ও মূল চালিকাশক্তি। দলটি পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের সব ধরনের অধিকার আদায়ের দাবিকে বলিষ্ঠ রূপ দিতে নিরলস কাজ করে গেছে। পাকিস্তান আমলে রাজনৈতিক দল হিসেবে একমাত্র আওয়ামী লীগই ছিল আমাদের সব গণতান্ত্রিক আশা-আকাঙ্ক্ষার ধারক ও বাহক।

ডেইলি স্টারের ছাপা সংস্করণে প্রকাশিত এক উপসম্পাদকীয়তে মাহফুজ আনাম এসব কথা বলেন। তার লেখাটি ২০২৪ সালের ২৯শে জুন প্রকাশিত হয় 'ফ্রম পিপল টু অ্যা বাবল' শিরোনামে। এর পর মাত্র দেড় মাসেরও কম সময়ের মধ্যে আওয়ামী লীগের সরকার জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাচ্যুত হয়। দেড় মাসের কম সময়ের আগে আওয়ামী লীগ, বঙ্গবন্ধু  ও শেখ হাসিনা সম্পর্কে মাহফুজ আনামের যে মূল্যায়ন ছিল, তা রাতারাতি পাল্টে যায় আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর।

মাহফুজ আনাম লেখেন, যাত্রা শুরুর পর আওয়ামী লীগের ৭৫ বছরের ইতিহাসকে সংক্ষেপে বর্ণনা করতে গেলে বলতে হবে, দলটির এই যাত্রায় তিনটি ধাপ রয়েছে—প্রতিষ্ঠাকালীন আওয়ামী লীগ, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ এবং শেখ হাসিনার হাল ধরার পরের আওয়ামী লীগ।

তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা দাবি এ দেশের মানুষকে নজিরবিহীন উজ্জীবনি শক্তি দিয়েছিল; নিজেদের অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের জন্য লড়ার দৃঢ় মনোবল এনে দিয়েছিল।

তার মতে, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জয়লাভ ছিল সেই সময়ে আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড়, একচেটিয়া এবং রাজনৈতিক বিবেচনায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্জন। অনেক দিক দিয়েই এটা ছিল আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের এক পূর্বাভাস। এই বিজয় আওয়ামী লীগকে পূর্ব পাকিস্তানের জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি হিসেবে কথা বলার আইনি, নৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার দেয়।

তিনি বলেন, যখন আমাদের নিরস্ত্র মানুষের ওপর গণহত্যা চালানো হয়, তখন এই অধিকারের বলেই দলটি স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে পাল্টা সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করতে সক্ষম হয়। আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব, মুজিবনগর সরকার এবং বিশেষত যুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের ভূমিকা ছিল সবদিক থেকেই অনবদ্য।

ওই উপসম্পাদকীয়তে মাহফুজ আনাম লেখেন, সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে নৃশংসভাবে হত্যা আমাদের জন্য সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনা এবং এটি থেকে আমরা আজও ঘুরে দাঁড়াতে পারিনি। সেসময় দেশে না থাকায় এই হত্যাকাণ্ড থেকে প্রাণে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে—আমাদের বর্তমান (এখন সাবেক) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানা।

তিনি বলেন, ৭৫ বছরের মধ্যে গত ৪৩ (বর্তমানে ৪৪ বছর) বছর ধরে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দিচ্ছেন শেখ হাসিনা। নৃশংসভাবে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বড় আকারে অস্তিত্ব সংকটে পড়ে আওয়ামী লীগ। ১৯৮১ সালে নির্বাসন থেকে দেশে ফেরার পর দলের হাল ধরেন তিনি। এরপর থেকে অদ্যাবধি দলের সভাপতির দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন এবং আওয়ামী লীগকে পুনর্গঠন করেছেন। তিনি কেবল দলটিকে সাফল্যের সঙ্গে পুনর্গঠিত ও পুনরুজ্জীবীতই করেননি, প্রায় ২১ বছর বিরোধী দলে থাকার পর নির্বাচনে জিতে ১৯৯৬ সালে ক্ষমতাসীনও করেছেন।

ওই কলামে মাহফুজ আনাম ‘জনগণের কণ্ঠস্বর হিসেবে শুরু হওয়া আওয়ামী লীগের একক কণ্ঠের দলে পরিণত হওয়া, দলটি যত ক্ষমতায় থেকেছে, ততই এর কার্যক্রম কেন্দ্রীভূত হওয়া, নেতৃত্ব কাঠামোর প্রতিটি স্তরে কর্তৃত্ববাদী প্রবণতার উত্থানের’ সমালোচনাও করেন।দলটির তৃণমূল পর্যায়েও একই ধারা দেখা যাওয়া, দলের কোনো পর্যায়ে কোনো ধরনের জবাবদিহি না থাকা, নেতাকর্মীদের দলের প্রতি দায়িত্বহীনতার কঠোর সমালোচনা করেন তিনি।