বাংলাদেশে দীর্ঘ দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে রাজনীতির মাঠ ছিল মূলত দ্বিমুখী—একদিকে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ আর অন্যদিকে রাজপথে থাকা বিএনপি। কিন্তু ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতন এবং পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের পলায়নের পর রাজনীতির দৃশ্যপট নাটকীয়ভাবে বদলে গেছে। এক সময় যারা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন করেছে, সেই বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামীর মধ্যকার দীর্ঘদিনের মিত্রতা এখন রূপ নিয়েছে চরম তিক্ততায়।
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক মেরুকরণ এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যেখানে বিএনপিকে এখন একই সঙ্গে দুটি ভিন্ন ফ্রন্ট সামলাতে হচ্ছে। একদিকে ১৫ বছরের পুরনো প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগের রেখে যাওয়া প্রেতাত্মা ও তাদের সাইবার প্রোপাগান্ডা, অন্যদিকে এক সময়ের জোটসঙ্গী জামায়াতে ইসলামীর প্রকাশ্য চ্যালেঞ্জ ও রাজনৈতিক কৌশল। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এই ত্রিমুখী লড়াই বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে।
সম্প্রতি এই দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে আসে গত ৭ ডিসেম্বর বিএনপির ‘দেশ গড়ার পরিকল্পনা’ কর্মসূচির আলোচনা সভায় ভার্চ্যুয়ালি দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বক্তব্যে। জামায়াতে ইসলামীর নাম উল্লেখ না করেও ওইদিন তিনি দলটির তীব্র সমালোচনা করেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াতে ইসলামীর ভূমিকার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, “কেউ কেউ বলে যে একবার দেখুন না এদের (জামায়াত)। তাদেরকে তো দেশের মানুষ ১৯৭১ সালেই দেখেছে। ১৯৭১ সালে তারা তাদের নিজেদের স্বার্থ রক্ষার্থে কীভাবে লক্ষ লক্ষ মানুষ হত্যা করেছে, ঠিক যেভাবে পতিত স্বৈরাচার পালিয়ে যাবার আগে হাজার হাজার মানুষ হত্যা করেছিল ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য। তারা লাখ লাখ মানুষকে শুধু হত্যাই করেনি, তাদের সহকর্মীরা কীভাবে মা-বোনদের ইজ্জত পর্যন্ত লুট করেছিল, এই কথাটি আমাদের মনে রাখতে হবে।”
তারেক রহমানের এই বক্তব্য রাজনীতির মাঠে নতুন উত্তাপ ছড়ায়। একই বক্তব্যে তিনি ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার নিয়েও কড়া হুঁশিয়ারি দেন। জামায়াতের রাজনীতিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, “একটি রাজনৈতিক দলের কিছু ব্যক্তি বা বেশ কিছু ব্যক্তি বিভিন্ন জিনিসের টিকিট বিক্রি করে বেড়াচ্ছেন। বিভিন্ন জিনিসের কনফারমেশন (নিশ্চয়তা) দিয়ে বেড়াচ্ছেন। দোজখ, বেহেশত, দুনিয়া- সবকিছুর মালিক আল্লাহ। যেটার মালিক আল্লাহ, যেটার কথা একমাত্র আল্লাহ তাআলাই বলতে পারেন, সেখানে যদি আমি কিছু বলতে চাই, আমার নরমাল দৃষ্টিকোণ থেকে আমি বুঝি যে সেটি হচ্ছে শিরক। সেটি শিরকের পর্যায়ে পড়ে। ঘরে ঘরে গিয়ে মানুষকে বোঝাতে হবে যারা এসব কথা বলে, তারা শিরক করছে। যারা শুনবেন, তারাও শিরকের পর্যায়ে পড়ে যাবেন।” তিনি আরও অভিযোগ করেন, পলাতক স্বৈরাচার যেভাবে বিএনপির বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা ছড়াতো, ইদানীং কিছু ব্যক্তি বা দল ঠিক একই সুরে কথা বলছে।
তারেক রহমানের এই বক্তব্যের জবাব দিতে দেরি করেননি জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান। পরদিন ৮ ডিসেম্বর ঢাকায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিদের সাথে বৈঠক শেষে তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পাল্টা মন্তব্য করে বলেন, জামায়াত ধর্মকে ব্যবহার করে না বরং ধারণ করে। তিনি আরও বলেন, “ধর্ম আমাদের চিন্তার অঙ্গ, আমাদের কলিজার অংশ। আমরা ধর্ম নিয়েই কাজ করি, ধর্মকে ব্যবহার করি না। নির্বাচনের সময় নতুন করে যারা বেশি বেশি নামাজ শুরু করেন, টুপি পরেন, তসবিহ হাতে নিয়ে ঘোরেন, ধর্মকে তারাই সম্ভবত ব্যবহার করেন। আমরা কিন্তু সারা বছর তসবিহ হাতে নিয়ে ঘুরি না, তসবিহ বুকে নিয়ে ঘুরি। আমরা আমাদের কাজগুলো আমাদের বিশ্বাসের আওতায় করতে চাই। এখন যে যেভাবে বোঝেন, এটা তাদের ব্যাপার।”
দুই শীর্ষ নেতার এই সরাসরি বাকযুদ্ধ প্রমাণ করে যে, নির্বাচনের মাঠে কেউ কাউকে বিন্দুমাত্র ছাড় দিতে নারাজ। জামায়াতে ইসলামী সম্পর্কে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সাম্প্রতিক বক্তব্যগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা সৃষ্টি করেছে। কেউ কেউ বলছে, তারেক রহমানের এই বক্তব্যগুলোই নির্দিষ্ট করে দিচ্ছে, বর্তমানে বিএনপি কাদেরকে নিজেদের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসেবে গণ্য করেছে।
এদিকে দুই দলের শীর্ষনেতাদের এই বাকযুদ্ধ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বাংলানিউজকে বলেছেন, “আমরা তো কোনো ধারণার উপর ভিত্তি করে কথা বলছি না, মিথ্যে প্রচারও চালাচ্ছি না। ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়ারও বানাচ্ছি না। আমরা যা বলছি, তা তো ইতিহাসভিত্তিক। সত্যি তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই বলছি। আমরা না বললেও কি এই দেশের মানুষ অতীত ইতিহাস জানে না? কোন সময় কাদের কী ভূমিকা ছিল, সেটা দেখেনি? আমরা শুধু মানুষকে সেটা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই।”
কেন্দ্রীয় নেতাদের এই তপ্ত বাক্যবিনিময় তৃণমূলেও ছড়িয়ে পড়েছে। সম্প্রতি সিলেটে এক সমাবেশে জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান বিএনপিকে ইঙ্গিত করে বেশ কিছু গুরুতর অভিযোগ আনেন, যা এই দুই দলের সম্পর্কের ফাটলকে আরও স্পষ্ট করে তোলে। তিনি বলেন, “একদল চাঁদাবাজির কারণে জনগণের ঘৃণা কুড়িয়েছে, আরেক দল আবার তার চেয়ে বেশি শক্তি নিয়ে চাঁদাবাজিতে নেমে পড়েছে।” দখলদারিত্বের অভিযোগ তুলে তিনি আরও বলেন, “একদল দখলদার বনতে গিয়ে জনগণ প্রত্যাখ্যান করেছে, আরেক দল বেপরোয়া দখলদার হয়ে উঠেছে। একদল জনগণের জানমাল নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে, আরেক দল একই পথ ধরেছে, এমনকি নিজেদের মধ্যে মারামারিতে নিজেদের শেষ করে দিচ্ছে।” জামায়াতের আমিরের এই বক্তব্যের মাধ্যমে এটি পরিষ্কার যে, তারা বিএনপিকে আওয়ামী লীগের মতোই আরেকটি ‘ফ্যাসিবাদী’ শক্তি হিসেবে চিত্রিত করতে চাচ্ছে।
বিএনপিও বসে নেই। গত ১১ নভেম্বর ঠাকুরগাঁওয়ে এক জনসভায় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জামায়াতের ধর্মীয় রাজনীতির কঠোর সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, “জামায়াতের টিকিট কাটলেই কি কেউ বেহেশতে যেতে পারবে? যারা এসব মুনাফেকি করে, তাদের কাছ থেকে আমাদের সাবধান থাকতে হবে।” মির্জা ফখরুলের এই বক্তব্য ছিল জামায়াতের প্রতি সরাসরি চ্যালেঞ্জ। এর জবাবে ২০ নভেম্বর খুলনায় এক অনুষ্ঠানে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, “বিএনপি এখন আওয়ামী লীগের ভাষায় কথা বলছে। তারা বর্তমানে মাহফিলে বাধা দেয়, মা–বোনদের তালিম প্রোগ্রামে বাধা দেয়। এটি করে তারা জামায়াতকে নয়, মূলত ইসলামকে বাধাগ্রস্ত করছে।” রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এই পাল্টাপাল্টি অভিযোগের মাধ্যমে দুই দলই নিজেদের ভোট ব্যাংক সংহত করার পাশাপাশি একে অপরের নৈতিক অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করছে।
আধুনিক রাজনীতির অন্যতম বড় হাতিয়ার এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপির জন্য সাইবার জগত এক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বিএনপিকে এখন সাইবার স্পেসে দ্বিমুখী আক্রমণের মোকাবেলা করতে হচ্ছে। একদিকে দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া আওয়ামী লীগের নেতারা এবং তাদের সমর্থকরা বিদেশ থেকে বিএনপির বিরুদ্ধে মিথ্যা তথ্য ও প্রোপাগান্ডা ছড়াচ্ছে। অন্যদিকে, দেশের ভেতরে জামায়াতে ইসলামীর একটি শক্তিশালী সাইবার ইউনিট বিএনপির অতীত ইতিহাস, নেতৃত্বের দুর্বলতা এবং বিভিন্ন বিতর্কিত ইস্যু সামনে এনে ক্যাম্পেইন চালাচ্ছে।
বিএনপির অভিযোগ, আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হলেও তাদের অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টরা এখনো সক্রিয়। তারা প্রতিনিয়ত বিএনপির বিরুদ্ধে বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়ে জনমনে সংশয় তৈরির চেষ্টা করছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে জামায়াতের সুসংগঠিত অনলাইন প্রচারণাও। জামায়াত কর্মীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তারেক রহমানের বিভিন্ন বক্তব্যকে খণ্ডন করে এবং বিএনপির বিভিন্ন সময়ের নেতিবাচক কর্মকাণ্ড তুলে ধরে পোস্ট দিচ্ছে। দেশের প্রায় সব স্তরের মানুষ এখন ইন্টারনেট ব্যবহার করে, ফলে এই সাইবার আক্রমণ যদি শক্ত হাতে মোকাবেলা করা না যায়, তবে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির ওপর এর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টরা। বিএনপিকে এখন রাজপথের পাশাপাশি এই ডিজিটাল যুদ্ধক্ষেত্রেও সমান গুরুত্ব দিতে হচ্ছে।
রাজনীতির মাঠে সবচেয়ে কৌতূহল জাগানিয়া বিষয় হলো জামায়াতে ইসলামীর সাথে আওয়ামী লীগের তৃণমূলের এক ধরনের অলিখিত সমঝোতার গুঞ্জন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা লক্ষ্য করছেন, বিএনপিকে কোণঠাসা করতে জামায়াত এখন আওয়ামী লীগের বিশাল ভোট ব্যাংকের দিকে নজর দিয়েছে। যেহেতু নেতৃত্বশূন্য আওয়ামী লীগ আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারছে না বলে অনেকটাই নিশ্চিত হওয়া গেছে, তাই এই বিশাল ভোট কার বাক্সে যাবে- তা নিয়ে শুরু হয়েছে হিসাব-নিকাশ। বিএনপি অভিযোগ করছে, তাদের দীর্ঘদিনের মিত্র জামায়াত এখন কৌশলে আওয়ামী লীগের সাথে সখ্যতা গড়ে তুলছে।
বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু তার নির্বাচনী এলাকা নাটোরে এক সমাবেশে এই বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, “যারা গত ১৫ বছর আমাদেরকে শোষণ করলো, আমাদের ওপর হামলা-গুলি করলো, আমাদের জীবন থেকে বছরের পর বছর, মাসের পর মাস কেড়ে নিলো, ওই আওয়ামী লীগের সাথে আঁতাত করে, আমরা কী এইটা বুঝি না? বাংলাদেশের মানুষ বোঝে না? আপনারা আওয়ামী লীগ আর জামায়াতের সাথে একাকার হয়ে গেছেন।” তিনি জানান, এই আঁতাতকে বিএনপিরই ঠেকাতে হবে।
বিএনপির এই অভিযোগ অমূলক নয় বলে মনে করছেন অনেক বিশ্লেষক। গত বছর ৩ সেপ্টেম্বর এক অনুষ্ঠানে জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, গত ১৬ বছরে আওয়ামী লীগ সরকার তাদের ওপর যে নির্যাতন করেছে, তা দল হিসেবে তারা ক্ষমা করে দিয়েছেন। তার এই বক্তব্য রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এটা ছিল জামায়াতে ইসলামীর একটি দীর্ঘমেয়াদী রাজনৈতিক চাল। সম্প্রতি জামায়াতের নেতারা এমন সব বক্তব্য দিচ্ছেন এবং কর্মকাণ্ড করছেন যা আওয়ামী লীগের সমর্থকদের আশ্বস্ত করছে বলেও তারা মনে করছেন।
আওয়ামী লীগের দুর্গ হিসেবে পরিচিত গোপালগঞ্জেও জামায়াতে ইসলামী তাদের তৎপরতা বাড়িয়েছে। জাতীয় নির্বাচনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গোপালগঞ্জের তিনটি আসনেই নৌকা প্রতীক বিপুল ভোটে জয়ী হয় এবং বিরোধীদের জামানত বাজেয়াপ্ত হয়। জানা গেছে, আওয়ামী লীগ নির্বাচনে থাকবে না ধরে নিয়েই গোপালগঞ্জে নৌকার সমর্থকদের ভোট নিজেদের পক্ষে টানতে কাজ করছেন জামায়াতের প্রার্থীরা। তারা আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাদের আইনি সহায়তা দিচ্ছেন এবং তাদের নিরাপত্তার আশ্বাসও দিচ্ছেন। মামলা থেকে আওয়ামী লীগের শতাধিক ব্যক্তির নাম প্রত্যাহারের বিষয়েও জামায়াতের তৎপরতার খবর পাওয়া গেছে।
জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ারের বক্তব্যেও এই কৌশলের বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়েছে। তিনি গণমাধ্যমে বলেন, “সরকারের সিদ্ধান্তে বা আইনগত কারণে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে আসতে পারছে না। কিন্তু তাদের ভোটাররা তো রয়ে গেছে। যারা বড় বড় অপরাধে অপরাধী নয়, দাগী আসামি নয়। যাদের নামে কোনো মামলা নাই। যাদের মানুষ সন্ত্রাসী দাগী আসামি হিসেবে চেনে না। সিম্পল মানুষ একটা দল করে। তার তো রাজনীতি করার অধিকার আছে। আওয়ামী লীগের শাসনের কেন্দ্রে থাকা, ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা নেতাদের যত অপরাধ তার জন্য সাধারণ আওয়ামী লীগের যারা ভোটার ছিলেন তারা সে অপরাধে অপরাধী নন।” তিনি আরও যোগ করেন, “যারা আওয়ামী লীগকে ভোট দিতো, তার মধ্যে একটা বড় অংশ আছে সাধারণ ভোটার। এখন যেহেতু তারা নেই, তাদেরকে এখন আমরা আওয়ামী লীগ ভাবি না। তারা এখন দেখবে কোন রাজনৈতিক দল ইশতেহারে কী বলছে। কার কাছে আমরা নিরাপদ। কাদের চরিত্র সৎ, কারা দুর্নীতিবাজ না, চাঁদাবাজ না। কার কাছে তাদের জানমাল, সম্পদ, ইজ্জত নিরাপদ।"
শুধু তাই নয়, সম্প্রতি এক নির্বাচনী প্রচারণায় জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতা ও সাবেক নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের আওয়ামী লীগের সাবেক রেলমন্ত্রী মুজিবুর রহমান মুজিবকে ‘ভাই’ সম্বোধন করে আওয়ামী লীগের ভোটারদের কাছে ভোট চেয়েছেন, যা বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। অভিযোগ রয়েছে, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে স্থানীয় আওয়ামী লীগের এক নেতাকে থানা থেকে ছাড়িয়ে আনতে গিয়েছিলেন জামায়াত নেতা জাহাঙ্গীর আলম। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ না থাকায় তাদের সমর্থকদের ভোট দলীয় আদর্শের চেয়ে ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ও স্থানীয় প্রভাবের ওপর ভিত্তি করে প্রদান করা হবে, আর জামায়াত ঠিক এই সুযোগটিই কাজে লাগাতে চাচ্ছে।
বিএনপি ও জামায়াতের এই বর্তমান বৈরিতার পেছনে দীর্ঘ ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট রয়েছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করা জামায়াতে ইসলামী স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছিল বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের শাসনামলে। এরপর ১৯৯১ সালের নির্বাচনের পর জামায়াতের সমর্থন নিয়েই সরকার গঠন করেছিল বিএনপি। পরবর্তী সময়ে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার বিরোধী আন্দোলনে বিএনপি ও জামায়াত জোটবদ্ধ হয় এবং ২০০১ সালের নির্বাচনে বিশাল জয় নিয়ে ক্ষমতায় আসে। সেই সময় জামায়াতের দুজন শীর্ষ নেতা মন্ত্রিত্বও পান।
তবে ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে এই সম্পর্কে ফাটল ধরতে শুরু করে। বিশেষ করে যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু হলে বিএনপি কিছুটা দূরত্ব বজায় রাখার কৌশল নেয়। একপর্যায়ে তাদের দীর্ঘদিনের জোট ভেঙে যায়। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর এই দূরত্ব শত্রুতায় রূপ নেয়। বিশেষ করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস লন্ডনে গিয়ে তারেক রহমানের সাথে বৈঠকের পর নির্বাচনের সময়সীমা ঘোষণা করলে জামায়াত অসন্তোষ প্রকাশ করে। এছাড়া জামায়াত ও আরও কয়েকটি দল যখন সংখ্যানুপাতিক (পিআর) পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবি তোলে, বিএনপি তখন তার তীব্র বিরোধিতা করে। নির্বাচন আগে না সংস্কার আগে- এই বিতর্কেও দুই দল ছিল দুই মেরুতে।
একদিকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের মোকাবেলা, অন্যদিকে দলের অভ্যন্তরীণ নেতৃত্বের সংকট- সব মিলিয়ে বিএনপি এখন কঠিন সময় পার করছে। গত ২৩ নভেম্বর থেকে দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালের সিসিইউতে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে রয়েছেন। দীর্ঘ ১৭ বছরের নির্বাসন কাটিয়ে এখনো দেশে ফিরতে পারেননি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। গত ৫ ডিসেম্বর বেগম জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য লন্ডনে নেওয়ার কথা থাকলেও মেডিকেল বোর্ডের সম্মতি না পাওয়ায় সেই সিদ্ধান্ত স্থগিত করা হয়েছে।
এরমধ্যেই প্রধান নির্বাচন কমিশনার এম এম নাসির উদ্দিন জানিয়েছেন, এ সপ্তাহের মধ্যেই নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করা হবে। ধারণা করা হচ্ছে, তফসিল ঘোষণার পরপরই তারেক রহমান দেশে ফিরবেন। তার আগমনের অপেক্ষায় রয়েছে দলের লক্ষ লক্ষ নেতাকর্মী। তবে দেশে ফিরে তাকে এক বিশাল চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে বলেও মনে করছেন রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টরা। একদিকে তাকে দলকে সুসংগঠিত করে নির্বাচনে নেতৃত্ব দিতে হবে, অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী এবং আওয়ামী লীগের মতো দুটি রাজনৈতিক শক্তিকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করতে হবে বলে তারা মনে করছেন।
বাংলাদেশের রাজনীতি এখন এক জটিল সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। দীর্ঘদিনের পরিচিত সমীকরণগুলো ভেঙে নতুন নতুন মেরুকরণ তৈরি হচ্ছে। বিএনপিকে এখন আর শুধু আওয়ামী লীগকে মোকাবেলা করতে হচ্ছে না, বরং তাদের এক সময়ের বিশ্বস্ত মিত্র জামায়াতে ইসলামীও এখন তাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এই ত্রিমুখী লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত কারা বিজয়ী হবে, তা নির্ধারণ করবে আগামী দিনের ভোটের রাজনীতি এবং দলগুলোর কৌশলগত অবস্থান। তবে এটা নিশ্চিত যে, আগামী নির্বাচন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় যোগ করতে যাচ্ছে।