Image description
আল জাজিরার রিপোর্ট

নির্বাচনকে সামনে রেখে নিজেদের উদার, গণতান্ত্রিক শক্তি হিসেবে তুলে ধরতে চাইছে দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। এর মাধ্যমে দলটি দক্ষিণ এশিয়ার বৃহৎ ইসলামপন্থি দল জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে কয়েক দশকের পুরনো সম্পর্কের চূড়ান্ত ইতি টানছে।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতনের ১৬ মাস পর এ বিষয়টি সামনে এসেছে। বিগত শাসনামলে ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘন, বিচারবহির্র্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম ও বিরোধীদের নির্বিচারে হত্যার জন্য দায়ী হাসিনা। সর্বশেষ ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে আন্দোলন চলাকালীন বিক্ষোভকারীদের ওপর চালানো নৃশংস দমনপীড়নের বিরুদ্ধে যে গণ-অভ্যুত্থান হয় তাতে ক্ষমতাচ্যুত হন তিনি। ঐতিহাসিকভাবে বিএনপি’র প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ। বাংলাদেশের রাজনীতিতে নিজেদেরকে ধর্মনিরপেক্ষ, উদার হিসেবে দাবি করে এসেছে পতিত দলটি। যদিও সমালোচকরা তাদের এ দাবি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।

এক সময় আওয়ামী লীগের বিরোধিতাই বিএনপি-জামায়াতকে জোটবদ্ধ করে। যদিও কখনোই দল দু’টির আদর্শগত পার্থক্য গোপন থাকেনি। বিএনপি জাতীয়তাবাদী আদর্শে বিশ্বাসী। অন্যদিকে জামায়াতের মূল দর্শন বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্ম ইসলাম। বর্তমানে এই মতপার্থক্য দল দু’টির মধ্যে পূর্ণাঙ্গ বিচ্ছেদ তৈরি করেছে। সর্বশেষ ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত জোট সরকার পরিচালনা করে বিএনপি ও জামায়াত।

এ সপ্তাহে এক ভাষণে বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের কথা উল্লেখ করে বলেন, তখন কী হয়েছিল মানুষ দেখেছে। এক্ষেত্রে তিনি জামায়াতের নাম সরাসরি উল্লেখ না করলেও গোটা বাংলাদেশে তার বক্তব্যের ইঙ্গিত স্পষ্ট যে, তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতায় জামায়াতের বিরোধিতাকেই বুঝিয়েছেন। ভোটের মাঠে জামায়াতে ইসলামী ধর্মের অপব্যবহার করছে বলেও অভিযোগ তারেকের।

গত মাসে একই ধরনের মন্তব্য করেছিলেন বিএনপি’র মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি ‘ধর্মের নামে’ দেশকে বিভক্ত করার বিষয়ে সতর্ক করে বলেন, বিএনপি’র রাজনীতি জাতীয় ঐক্য, গণতান্ত্রিক নীতি এবং একাত্তরের মূল চেতনার উপর প্রতিষ্ঠিত, যা বিভক্ত করা উচিত নয়।  

দুই দলের সম্পর্কে এমন পরিবর্তনের কারণ কী?
বিএনপি’র সামপ্রতিক বয়ান ইঙ্গিত দিচ্ছে তারা ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদের সেই শব্দভাণ্ডার ব্যবহার করছে যা আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনাকে পাশ কাটিয়ে একচেটিয়াভাবে ব্যবহার করেছে। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বে ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবুর রহমান। আবার তিনিই স্বাধীন বাংলাদেশে স্বৈরাচারী শাসনের ভিত্তি রচনা করেছিলেন। ১৯৭৫ সালে একদলীয় ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে অন্যান্য সকল রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেন তিনি।

ক্ষমতায় থাকাকালীন হাসিনাও সেই পথে হেঁটেছেন। ২০০৯ থেকে ২০২৪- পুরো শাসনামলে জামায়াতকে কার্যত নিষিদ্ধ রাখেন হাসিনা। গ্রেপ্তার করেন বিএনপি’র হাজার হাজার নেতাকর্মী। যার মধ্যে ছিলেন বিএনপি’র দীর্ঘদিনের প্রধান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। বর্তমানে সাবেক এই নেত্রী খুবই সংকটজনক অবস্থায় চিকিৎসাধীন রয়েছেন বলে জানিয়েছে তার দল ও পরিবার। হাসিনা সরকারের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ এবং অন্যান্য সমালোচকদের ওপর চালানো নির্মম দমনপীড়নের ফলে ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের নির্বাচনগুলো প্রহসনে পরিণত হয়। এর মাধ্যমে সংসদে আওয়ামী লীগকে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে চিত্রিত করেন শেখ হাসিনা।

গণ-অভ্যুত্থানের পর কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়া আওয়ামী লীগের ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদী মনোভাবের শূন্যস্থান পূরণে জামায়াতের মতো ইসলামপন্থি দলের সঙ্গে বিএনপি’র সম্পর্ক ছিন্ন করা বহুত্ববাদী রাজনীতিতে বিশ্বাসী জনগণের কাছে দলটির ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। তবে বিএনপি-জামায়াতের এই বিভাজন রাতারাতি হয়নি। নির্বাচনের আগে বৃহত্তর সংস্কার হওয়া উচিত কি-না, সংবিধানের পুনর্গঠন কীভাবে করা যায় ও হাসিনা-পরবর্তী রাজনীতি কোন পথে চলবে- এসব মৌলিক প্রশ্নে গত কয়েক মাসে দল দু’টির দূরত্ব ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে।

নির্বাচনের আগেই ব্যাপক কাঠামোগত পরিবর্তনের ওপর জোর দেয় জামায়াত। পক্ষান্তরে সংবিধানের ন্যূনতম সংশোধনের মাধ্যমে দ্রুত নির্বাচন চেয়েছে বিএনপি। এসব মতানৈক্য ধীরে ধীরে বড় হয়ে সামনে এসেছে। তবে এই মতানৈক্য কেবল কৌশলগত মতবিরোধ নয়। নতুন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এর আদর্শিক মূল্য রয়েছে। কারণ বাম ও উদার-ধর্মনিরপেক্ষ মনোভাবে আওয়ামী লীগের যে স্থান ছিল তা এখন ফাঁকা। ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের আগে সেই স্থানই দখল করার চেষ্টা করছে বিএনপি।

বিএনপি’র এই হিসাবনিকাশ ভোটারদের মেজাজের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। তরুণ-নেতৃত্বাধীন অভ্যুত্থানে একদলীয় স্বৈরতন্ত্রের পতন হওয়ার পর মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে গণতান্ত্রিক শাসন এবং রাজনৈতিক মধ্যপন্থার যে আশা তৈরি হয়েছে- জামায়াতের ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক প্রবণতা  সেই অনুভূতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে মনে করছে বিএনপি। নিজেদেরকে নতুনভাবে ব্র্যান্ডিং করার মাধ্যমে এসব ভোটারদের কাছাকাছি পৌঁছাতে চাচ্ছে দলটি। 

এর লক্ষ্য একাত্তরের নৈতিক শ্রেষ্ঠত্বকে পুনরুদ্ধার করা। বিগত সময়ে আওয়ামী লীগ- জামায়াতের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকে পুঁজি করে রাজনীতি করেছে। পাশাপাশি ওই বয়ান দিয়ে বিএনপিকেও অবৈধ প্রমাণ করার চেষ্টা করেছে তারা। তবে এখন সেই ধারণা পাল্টে দিচ্ছে বিএনপি। একাত্তরে জামায়াতের ভূমিকার নিন্দা জানিয়ে আওয়ামী লীগের অর্ধশতক ধরে জিইয়ে রাখা সেই আদর্শকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে দলটি। এর মাধ্যমে তারা সেই সকল তরুণদের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করছে যারা এখনকার সময়কে একক দলের প্রতি আনুগত্যের চেয়ে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রশ্নকে বেশি গুরুত্ব দেয়।

বিএনপি’র এই প্রচেষ্টা ঝুঁকিমুক্ত নয়। এভাবে মনোভাব পরিবর্তন করা কি আদৌ আন্তরিক নাকি সুযোগসন্ধানী- বিএনপিকে সে সংশয় কাটিয়ে উঠতে হবে। আবার এমন উদারনৈতিক পরিবর্তন বিএনপি নিজেদের  ভেতর থেকেই বাধাপ্রাপ্ত হতে পারে। তাছাড়া, হাসিনা-পরবর্তী রাজনীতিতে ক্ষেত্রটি বেশ কঠিন। জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মতো তরুণদের দল ও সুশীল সমাজের নেটওয়ার্কগুলোও উদার-মধ্যপন্থি ভোট দখলের চেষ্টা চালাচ্ছে। যদি বিএনপি ভিন্ন ভিন্ন গণতন্ত্রপন্থি নির্বাচনী এলাকাগুলোকে একীভূত করতে না পারে তাহলে ভোটের এই বিভাজন বিএনপি’র প্রত্যাশা লঘু করে দিতে পারে। তবে বিএনপি’র এই নতুন পরিবর্তন কৌশলগতভাবে আপাতত বেশ শক্তিশালী।

দলটিকে এখন আর আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ডানপন্থি হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হচ্ছে না। এখন গণতান্ত্রিক প্ল্যাটফরম আরও বিস্তৃত হচ্ছে। যেখানে আওয়ামী লীগের সাবেক ভোটার, উদারপন্থি, সংখ্যালঘু এবং রাজনীতি সচেতন তরুণ প্রজন্ম নিজেদের জায়গা খুঁজে নিচ্ছে।

বিএনপি’র এই পরিবর্তন সফল হবে কিনা, তা নির্ভর করবে দলটি কতোটা ধারাবাহিকভাবে এই আদর্শিক ধারা বজায় রাখবে। এ ছাড়া জামায়াতের সঙ্গে দলটির বিচ্ছেদ যে নির্বাচনী কৌশল নয়- জনগণের মধ্যে এই বিশ্বাস থাকতে হবে। তবে এটা ইতিমধ্যে স্পষ্ট ২০২৫ সালের বিএনপি এখন আর গত দশকের বিএনপি নেই। দলটির নেতারা অন্তর্ভুক্তিমূলক, অসামপ্রদায়িকতা এবং গণতান্ত্রিক সংস্কারের প্রশ্নে নতুন ভাষায় কথা বলছেন। 

জামায়াতের সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে আওয়ামী লীগের দখলে থাকা আদর্শিক অবস্থানে পা রেখে বিএনপি বাংলাদেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে নতুন সাজ আনার চেষ্টা করছে। যদি এই পরিবর্তন স্থায়ী হয় তাহলে এটি ১৯৯০-এর দশকের গোড়ার দিককার পর দেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন হতে পারে।