রংপুরের ছয়টি আসন ঘিরে জাতীয় নির্বাচনের মাঠ এখন সরগরম। অতীতে জাতীয় পার্টির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত এ জেলায় অভ্যুত্থান-পরবর্তী রাজনীতির পালাবদলে নতুন হিসাব তৈরি হয়েছে। বিএনপি ছয়টি আসনেই মনোনয়ন ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে পাঁচটি আসনে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা জমেছে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে আর রংপুর-৪ আসনে জাপা, বিএনপি ও জামায়াতের সঙ্গে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) যোগ করে ত্রিমুখী লড়াইয়ের আভাস দিচ্ছে। জাপা এখনও মাঠে নামেনি। ফলে তাদের অবস্থান নিয়ে ভোটারের মধ্যে চলছে তীব্র আলোচনা। দলের সাংগঠনিক স্থবিরতার মধ্যে সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইছে না বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপিÑ যারা এরই মধ্যে মাঠে প্রচারে আছে।
রংপুর-১ (গঙ্গাচড়া ও সিটির একাংশ) : এ আসনে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে মোকাররম হোসেনকে। গত বছরের ২৯ মে দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে গঙ্গাচড়া উপজেলা পরিষদ নির্বাচন করে দল থেকে বহিষ্কার হন জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মোকাররম হোসেন। উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে তিনি জয়ী হলেও শেষ পর্যন্ত চেয়ারে বসা হয়নি। এবার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে তাঁকে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে। মোকাররম হোসেন বলেন, এ আসনে বারবার জোটের প্রার্থীরা মনোনয়ন পেলেও এবার ধানের শীষের প্রার্থী দেওয়ায় নেতা-কর্মীরা উচ্ছ্বসিত। আমি দীর্ঘদিন স্থানীয় সরকার নির্বাচন করে এসেছি। আমি বারংবার ইউনিয়ন চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে উপজেলা চেয়ারম্যান হয়েছি। এখানে এবার দলমত নির্বিশেষে ধানের শীষের জোয়ার উঠেছে।
এ আসনে রংপুর মহানগর জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি রায়হান সিরাজী দলের প্রার্থী। তিনি নেতা-কর্মীদের নিয়ে গণসংযোগ ও সভা-সমাবেশ করছেন। রায়হান সিরাজী বলেন, আমরা দেখেছি স্বাধীনতার আগ থেকে ও পর থেকে এ অঞ্চল জামায়াতে ইসলামীর ঘাঁটি। আমরা ১৯৮৬ সালে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়েছিলাম, আমাদের বিজয়কে অন্যায়ভাবে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিল। ১৯৯১-২০০৮ সাল পর্যন্ত যে কয়টি জাতীয় নির্বাচন হয়েছে, আমরা প্রতিটাতে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলাম। আমরা বিশ্বাস করি, এ অঞ্চলের মানুষ এবার আমাদের গ্রহণ করবে। জাপার একটি সূত্র জানায়, লন্ডনপ্রবাসী মঞ্জুম আলীকে এ আসনে প্রার্থী করার বিষয়টি ভাবা হচ্ছে। এরই মধ্যে তাঁর বাড়িতে মতবিনিময় সভা করেছেন উপজেলা জাতীয় পার্টি ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। স্থানীয়দের মতে, মঞ্জুম আলী নির্বাচন করলে বিএনপি, জামায়াত ও জাতীয় পার্টির ত্রিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। এ ছাড়া গণঅধিকার পরিষদের হানিফুর রহমান (সজীব), ইসলামী আন্দোলনের গোলাম মোস্তফা, খেলাফত মজলিসের মমিনুর রহমান ও গণতন্ত্র মঞ্চ থেকে রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের ফরিদুল ইসলাম নির্বাচনী তৎপরতা চালাচ্ছেন।
রংপুর-২ (বদরগঞ্জ-তারাগঞ্জ) : মুক্তিযুদ্ধের সময়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত হয়ে দীর্ঘদিন কারাবন্দি থাকার পর আপিল বিভাগের রায়ে কারামুক্ত হওয়া জামায়াতের সাবেক কেন্দ্রীয় ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলামকে রংপুর-২ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেছে দলটি। তিনি প্রতিদিন প্রচারে অংশ নিচ্ছেন। গত শনিবার (২২ নভেম্বর) বদরগঞ্জ ও তারাগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় প্রায় ৪ হাজার মোটরসাইকেল নিয়ে শোভাযাত্রা শেষে তিনি বলেন, সব জায়গায় দারুণ সাড়া পাচ্ছি।
এ আসনে বিএনপির শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী সাবেক সংসদ সদস্য মোহাম্মদ আলী সরকার। একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বিরোধকে কেন্দ্র করে গত ৪ এপ্রিল মোহাম্মদ আলী সরকারের লোকজনের ওপর অতর্কিত হামলার ঘটনা ঘটে। ওই সময় মোহাম্মদ আলী সরকারকে দল থেকে বহিষ্কার করে বিএনপি। জনপ্রিয়তা বিবেচনায় বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে তাঁকে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। তবে মোহাম্মদ আলী সরকারের প্রার্থিতা বাতিল চেয়ে শনিবার সন্ধ্যায় বদরগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সভাপতি অধ্যাপক পরিতোষ চক্রবর্তী ও সাধারণ সম্পাদক আজিজুল হকের নেতৃত্বে দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে একটি মশাল মিছিল অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ ঘটনায় মোহাম্মদ আলী সরকারের সমর্থকসহ বিএনপির বড় একটি অংশের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে। স্থানীয়রা বলছেন, দলীয় কোন্দল মেটাতে না পারলে নির্বাচনে বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে পারে বিএনপি মনোনীত
প্রার্থী। মোহাম্মদ আলী সরকার আমাদের সময়কে বলেন, দল আমাকে মনোনয়ন দিয়েছে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আমাকে মাঠে নামার জন্য বলেছেন, আমি সে অনুযায়ী কাজ করছি। জাতীয় পার্টি থেকে এ আসনে সাবেক সংসদ সদস্য আনিসুল ইসলাম মণ্ডলের প্রার্থী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ইসলামী আন্দোলনের মাওলানা আশরাফ আলীও প্রচার চালাচ্ছেন।
রংপুর-৩ (রংপুর সদর-সিটি করপোরেশন) : আশির দশক থেকে রংপুর-৩ আসনটি জাপার দখলে। ২০১৪ সালের উপনির্বাচন ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে এ আসনে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য মশিউর রহমান যাদু মিয়ার মেয়ে রিটা রহমানকে প্রার্থী করলেও এবার মনোনয়ন পেয়েছেন মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক সামসুজ্জমান সামু। বিষয়টি মানতে পারছেন না রিটা রহমান ও তাঁর সমর্থকরা। রিটা রহমান বলেন, ‘আমি কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁরা জোর দিয়ে বলেছেনÑ এটা প্রাথমিক। সুতরাং, মনোনয়নের জন্য আমি ও আমার নেতা-কর্মীরা মাঠে আছেন।’ দলের আরেকটি অংশ মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব মাহফুজ উন নবী ডনকে প্রার্থী হিসেবে চায়। গত ১১ নভেম্বর তাঁর সমর্থকরা নগরে গণমিছিল করে প্রার্থিতা পুনর্বিবেচনার দাবি জানান।
সামসুজ্জামান সামু বলেন, বিএনপি বড় দল। চার-পাঁচজন মনোনয়ন চাইতেই পারেন। তবে আমার বিশ্বাস, শেষ পর্যন্ত দলের অন্য মনোনয়নপ্রত্যাশীরা আমার পক্ষে কাজ করবেন।
এ আসনে নির্বাচনের বিষয়ে জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা বলেন, জাপা নির্বাচন করলে এ আসনে দলের চেয়ারম্যান গোলাম মুহাম্মদ (জিএম) কাদের প্রার্থী হবেন। তবে স্বচ্ছতা ছাড়া নির্বাচনের পথে হাঁটবে না জাতীয় পার্টি।
এ আসনে জামায়াতের প্রার্থী দলের কেন্দ্রীয় কাযনির্বাহী সদস্য মাহবুবুর রহমান বেলাল ও ইসলামী আন্দোলনের আমিরুজ্জামান (পিয়াল) নিয়মিত প্রচার চালাচ্ছেন। গণসংহতি আন্দোলনের জেলা আহ্বায়ক তৌহিদুর রহমান এ আসনে প্রার্থী হবেন। বাম জোট থেকে বাসদের কেন্দ্রীয় নেতা রাজেকুজ্জামান রতন অথবা জেলা আহ্বায়ক আবদুল কুদ্দুস প্রার্থী হতে পারেন বলে আলোচনা আছে।
রংপুর-৪ (কাউনিয়া-পীরগাছা) : এ আসনটিতে জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও কাউনিয়া উপজেলা বিএনপির সভাপতি এমদাদুল হক ভরসা দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন। তবে আলোচনার শীর্ষে রয়েছেন এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন। ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকেই এলাকায় গণসংযোগ করছেন আখতার। তাঁকে ঘিরে এ আসনে বিজয়ের স্বপ্ন দেখছে এনসিপি। এ আসনে জামায়াতের প্রার্থী রংপুর মহানগরের আমির এটিএম আজম খান।
স্থানীয় রাজনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, এ আসনে অন্যান্য প্রার্থীদের তুলনায় বিএনপি মনোনীত প্রার্থী এমদাদুল হক ভরসা এগিয়ে থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে আওয়ামী লীগ ইস্যুতে একাধিকবার আপত্তিকর মন্তব্য করে সমালোচনার শিকার হয়েছেন। এ ধারা অব্যাহত থাকলে ভোটের মাঠে প্রভাব পড়তে পারে। অন্যদিকে ক্লিন ইমেজের তরুণ নেতা আখতার হোসেনের অব্যাহত ব্যতিক্রমী প্রচারণা মন কাড়ছে তরুণ ভোটারের। এ ছাড়া এনসিপির সঙ্গে বিএনপি অথবা জামায়াত যে কোনো দলের জোট হলে ওই দলের প্রার্থী প্রত্যাহার করে আখতারকে সমর্থন দিতে পারে বলে গুঞ্জন উঠেছে।
স্থানীয় জাতীয় পার্টি থেকে দলের প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে পীরগাছা উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আবু নাসের শাহ মো. মাহবুবার রহমানকে। মাহবুবার রহমান বলেন, স্বাভাবিকভাবে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছি। কোথাও কোনো বাধা পাইনি।
রংপুর-৫ (মিঠাপুকুর উপজেলা) : এ আসনে বিএনপি ও জামায়াতের প্রার্থী একই নামের। দুইজনেই শিক্ষকতা পেশার সঙ্গে যুক্ত। বিগত ইউপি নির্বাচনে ১৭টি ইউনিয়নের মধ্যে সাতটিতে জামায়াত মনোনীত প্রার্থীরা চেয়ারম্যান পদে জয়লাভ করেছেন। এ আসনে জামায়াতের প্রার্থী হয়েছেন রংপুর জেলা জামায়াতের আমির ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান গোলাম রব্বানী।
জামায়াতের প্রার্থীর তুলনায় নতুন প্রার্থী দিয়েছে বিএনপি। মনোনয়ন পেয়েছেন উপজেলা বিএনপির সভাপতি গোলাম রব্বানী। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন পর ধানের শীষ থেকে এখানে প্রার্থী হয়েছে। দলের সাংগঠনিক অবস্থা তুলনামূলক ভালো। জয়লাভ করব বলে আশা করছি।
এবি পার্টি থেকে এ আসনে জেলা আহ্বায়ক আবুল বাছেত মার্জান ও বাম জোট থেকে বাসদের জেলা কমিটির সদস্য সচিব মমিনুল ইসলাম প্রার্থী হবেন। স্থানীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে এ আসনটিতে বিএনপি পূর্বের চেয়ে অনেক ভালো অবস্থানে রয়েছে। নির্বাচনে জামায়াতের সঙ্গে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে বিএনপির।
রংপুর-৬ (পীরগঞ্জ উপজেলা) : গত তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসনে এমপি হন জাতীয় সাবেক স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী। হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর আসনটি দখলে নিতে তৎপরতা চালাচ্ছেন বিএনপি ও জামায়াতের দুই প্রার্থী। বিএনপির মনোনয়ন পেয়েছেন জেলা কমিটির আহ্বায়ক সাইফুল ইসলাম। তিনি বলেন, বেশিরভাগ সময়ই পীরগঞ্জের মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে ভাড়াটিয়া প্রার্থী, যাঁদের কাছে সাধারণ মানুষ কখনই পৌঁছাতে পারেননি। সব সময়ই মানুষকে ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। উন্নয়নের নামে সবকিছু লুটপাট হয়েছে। আগামী নির্বাচনে বিএনপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করবে ইনশা আল্লাহ। আমি নির্বাচিত হলে কোনো দালালিকে প্রশ্রয় দেব না, সাধারণ মানুষের ভোগান্তি লাঘবে কাজ করব।
জামায়াতের প্রার্থী মাওলানা নুরুল আমীন দলের জেলা কমিটির মজলিসে শুরা ও কর্মপরিষদ সদস্য। তিনি বলেন, এ পর্যন্ত যাঁরাই নির্বাচিত হয়ে সংসদে গিয়েছে, সবাই জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করেছে এবং জনগণের আবেগ নিয়ে খেলা করেছে। উন্নয়নের নামে চলেছে লুটপাট। কিন্তু এবার নতুন বাংলাদেশে নেতৃত্ব দেবে জামায়াত।
এ আসনে ২০০১ সালে নূর মোহাম্মদ জাপা থেকে শেখ হাসিনাকে পরাজিত করেন। সাবেক এই এমপির এবার স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার কথাও আলোচনায় আছে। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) পীরগঞ্জ উপজেলা সভাপতি কামরুজ্জামান দলের প্রার্থী হবেন।