নির্বাচনী ট্রেন চলছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হাওয়া বইছে বন্দরনগরীসহ বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের সর্বত্র। ভোটের মাঠে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরা ভোটের মাঠে। মাঠ জমতে আরও যথেষ্ট সময় বাকি। সবাই এখন নির্বাচনী অঙ্কের হিসাব-নিকাশের খাতা খুলে বসেছেন। শীত আসি আসি করছে; ‘গ্রামের সংসদ’ চা-দোকানে গরম চায়ের কাপ সামনে নিয়ে আড্ডা-আলাপ চলছেই। এসব আড্ডায় একে অপরকে প্রশ্ন করছেন, ‘আগামী নির্বাচনে জিতবে কোন দল? এবার কারা সরকারে যাবে’? তবে যেহেতু ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনক্ষণ অর্থাৎ রমজানের আগে ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধ আসতে এখন পর্যন্ত পাক্কা তিন মাসের কিছু বেশি সময় বাকি আছে; সেহেতু সবার মুখে ‘কমন’ একটি কথা ঘুরেফিরে উঠে আসছেÑ ভোটের রাজনীতিতে শেষ কথা, নাটক ও চমক এখনো অনেক দূরে। বাণিজ্যিক রাজধানী খ্যাত বন্দরনগরী, চট্টগ্রাম জেলা, কক্সবাজার জেলা এবং তিনটি পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটির ২৩টি আসনে এ মুহূর্তে নির্বাচনী মাঠে-ময়দানের হালচাল দেখে বোঝা যাচ্ছে, বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামী নিজেদের পক্ষে জনসমর্থন আকর্ষণের জন্য এলাকাভেদে কমবেশি তৎপর। এনসিপি এবং বিভিন্ন ইসলামী দল কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের দিকে তাকিয়ে। অরাজনৈতিক বৃহৎ সংগঠন হেফাজতে ইসলামের বিপুল সংখ্যক কওমি দেওবন্দি আলেম-মাশায়েখ, মাদরাসা শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মী-সমর্থকরাও কেন্দ্রের নির্দেশনার অপেক্ষায় আছেন।
চট্টগ্রাম বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। অতীতের সবকটি সুষ্ঠু নির্বাচনে এই অঞ্চলের বেশিরভাগ আসনে জিতেছেন ‘ধানের শীষের’ প্রার্থীরা। আগামী নির্বাচনেও দলের সেই ‘ঘাঁটি’ দখলে আনতে চায় বিএনপি। এই টার্গেটে এলাকাওয়ারি গ্রহণযোগ্য, ভালো ইমেজের এবং জনপ্রিয় নেতাদের প্রার্থী করার প্রস্তুতি চলছে। সেই সাথে সমমনাদেরও কাছে টানছে বিএনপি। গত প্রায় ষোলো বছরে তিন তিনটি নির্বাচন আওয়ামী লীগের একদলীয়, ভোটারবিহীন ও জনবিচ্ছিন্ন অবস্থায় অনুষ্ঠিত হয়েছে। দীর্ঘ এই ব্যবধানে বিএনপির সেই পুরনো ‘ঘাঁটি’ আগামী নির্বাচনে অক্ষত থাকবে কিনাÑ এ ক্ষেত্রে সম্ভাবনার পাশাপাশি বেশকিছু কঠিন বাস্তবতা, দলের ভেতরের সমস্যা এবং চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি আজকের বিএনপি। নতুন প্রজন্মের ভোটার ও নারী ভোটারদের কাছাকাছি বিএনপি নিজেকে কতটা তুলে ও মেলে ধরতে সক্ষম হচ্ছে বা হবে তাও কঠিন এক চ্যালেঞ্জ। ‘বিএনপির ঘাঁটি’, ‘পুুরনো জমিদারি’ ভেবে বসে থাকা কিংবা ‘জোরালো আত্মবিশ^াস’ বিএনপির জন্য যেমন শক্তি; তেমনি ‘অতি আত্মবিশ^াস’ বুমেরাং হতে পারে। যা সেই ইসপের গল্পের খরগোশ এবং কচ্ছপের দৌঁড়ের পরিণাম ফল বয়ে আনতে পারে।
অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী দুয়েকটি ছাড়া চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রতিটি আসনে নির্বাচনী মাঠ চষে বেড়াচ্ছে; দেখে মনে হবে ‘আজ বাদে কাল নির্বাচন’। আগেই সবকটি আসনে প্রার্থী ঘোষণার সুবাদে জামায়াত পরিকল্পিতভাবে মাঠে তৎপর। দলের মহিলা ও অন্যান্য শাখা গণসংযোগ চালাচ্ছে দাঁড়িপাল্লা মার্কা হাতে। জামায়াত এলাকাভিত্তিক সামাজিক ও কল্যাণমুখী কর্মকা- নিয়ে হাজির হচ্ছে। সেই সাথে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের কর্মীদের সঙ্গে ‘বন্ধুত্বের নীতি’তে ভোটের অঙ্ক কষছে। বিএনপি-বিরোধী প্রচারণা অব্যাহত রেখে নেগেটিভ ভোট পাওয়ার সুযোগ খুঁজছে জামায়াত। তবে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের একেক সময়ে একেক ধরনের বক্তব্য-বিবৃতি, ‘পি.আর. ছাড়া ভোট নয়’, জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট চাইÑ এসব কথায় সাধারণ মানুষ সন্দেহ ও প্রশ্ন তুলছে জামায়াত আসলে কি চায়। হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামা শাহ মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরীর সাম্প্রতিক জামায়াত ও মওদুদী-বিরোধী কঠোর বক্তব্য ও সমালোচনায় চট্টগ্রামের নির্বাচনী মাঠে কমেবেশি প্রশ্ন ও বিপাকে পড়ে গেছে জামায়াত। এনসিপি নেতাদের সম্প্রতি জামায়াতকে তীব্র ভাষায় সমালোচনার কথাগুলোও মানুষের মুখে মুখে আলোচনা হচ্ছে।
এর বিপরীতে চট্টগ্রাম অঞ্চলে দুয়েকটি বাদে বেশিরভাগ আসনে বিএনপির দলীয় কোন্দল, যত নেতা তত গ্রুপে দ্বন্দ্ব, কতিপয় নেতা-কর্মীর চাঁদাবাজি, এখানে-সেখানে দখলবাজি আর নিজেদের মধ্যে খুনোখুনি, হানাহানিতে দলের ইমেজের বারোটা বাজছে একথা বলছেন বিএনপির ত্যাগী তৃণমূল নেতা-কর্মীরা। দলে নবাগত ও বহিরাগত হাইব্রিডদের প্রভাব বেড়ে গেছে। এলডিপির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান কর্নেল অব. ড. অলি আহমদ বীর বিক্রমের নির্বাচনী এলাকাও চট্টগ্রামে। তিনিও বিএনপি জোটের হয়ে ভোটে লড়বেন এমন আভাস পাওয়া যাচ্ছে। পতিত আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকলেও সমর্থনের বাড়তি ‘ভিটামিন’ পেতে স্থানীয় পর্যায়ে বিএনপি-জামায়াত উভয়পক্ষই আওয়ামী সমর্থকদের কাছে টানার রীতিমতো প্রতিযোগিতায় আছেন।
এসবকিছু মিলিয়ে বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের নির্বাচনী মাঠের যে অবস্থা তাতে বলা যায় এই মুহূর্তে নির্বাচন ২৩টি আসনের মধ্যেÑ ১৭টি আসনে বিএনপি, ৫টিতে জামায়াত এবং একটি আসনে এলডিপি বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে সময়ের সাথে নির্বাচনী মাঠে প্রভাব বলয় দিনে দিনে পরিবর্তন হলে বিএনপি এবং জামায়াতের সম্ভাব্য জয়-পরাজয়ের সূচকে পরিবর্তন এমনকি ফিফটি-ফিফটি অবস্থান তৈরি হতে পারে। প্রায় সর্বত্রই বিএনপি এলোমেলো অগোছালো অবস্থায় রয়েছে। এর বিপরীতে জামায়াত মনে করছে এটাই তাদের প্লাস পয়েন্ট বা সুবিধা।
চট্টগ্রাম-১ (মীরসরাই) আসন অতীতে বিএনপির ঘাঁটি হলেও এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। এখানে বিএনপির একাধিক মনোনয়ন প্রত্যাশী। দলে কলহ বিরোধ চরমে। ৫ আগস্টে পর বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের বিরোধে একাধিক লাশ পড়েছে। সুবিধাজনক অবস্থানে জামায়াত। দলটির নেতাকর্মীরা ভোটের মাঠে সরব দীর্ঘদিন। তাদের প্রার্থীও চূড়ান্ত। এ কারণে ভোটের দৌড়ে জামায়াতকে এগিয়ে রাখছেন বিশ্লেষকরা।
চট্টগ্রাম-২ (ফটিকছড়ি) আসনে জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী ধারার ভোটই বেশি। এবার বিএনপির অন্তত চার জন মনোনয়ন প্রত্যাশী। কে পাবেন ধানের শীষ তা স্পষ্ট নয়। দলের কর্মী, সমর্থকরা বিভক্ত। অন্যদিকে জামায়াতের প্রার্থী এক বছরের বেশি সময় আগেই মাঠে তৎপর। নেতাকর্মীরা ভোটারদের ঘরে ঘরে ছুটছেন। ছাত্রশিবির সুসংগঠিত। বিএনপি অসংগঠিত। একেকটি গ্রুপের দখল, চাঁদাবাজির অভিযোগ বিস্তর। আওয়ামী লীগ মাঠ ছাড়া হওয়ায় এই এলাকায় এখন জামায়াত-শিবিরের প্রভাব বেড়েছে। ভোটের মাঠে এগিয়ে আছে দলটি।
চট্টগ্রাম-৩ (সন্দ্বীপ) সন্দ্বীপ আসনে অতীতের সুষ্ঠু নির্বাচনে বিএনপির বিজয়ী হয়। এবার বিএনপির মনোনয়ন পেতে অনেকে মাঠে। জেলা উপজেলা নেতাদের সাথে আমেরিকা প্রবাসী কেউ কেউ দৌঁড়ে। কে পাবেন দলের টিকিট তা অনিশ্চিত। এই আসনে জামায়াত প্রার্থী দলবল নিয়ে মাঠে। জামায়াতের চেয়ে ছাত্রশিবির সংগঠিত।
চট্টগ্রাম-৪ (সীতাকু-) আসনে আওয়ামী দুঃশাসনে বিএনপি-জামায়াতের অনেকে শহীদ হন। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা আসলাম চৌধুরীসহ অনেক নেতা বছরের পর বছর কারাবরণ করেছেন। এই আসন বিএনপির জন্য সম্ভাবনাময়। বিএনপিতে প্রার্থী সঙ্কট রয়েছে। আসলাম চৌধুরী ঋণ খেলাপি হওয়ায় প্রার্থী হতে পারবেন কিনা সংশয় আছে। দলের একটি অংশ তাকে বাদ দিয়ে আওয়ামী ঘরানার কাউকে ধানের শীষ দিতে চাইছেন। জামায়াত দলীয় প্রার্থী নিয়ে মাঠে সক্রিয়। বিএনপি দোটানায়।
চট্টগ্রাম -৫ (হাটহাজারী) আসনের ভোটাররা জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ^াসী। অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় কর্মকা-ও এখানে। নির্বাচনে জয়-পরাজয়ে হাটহাজারি বড় মাদরাসা বড় ফ্যাক্টর। এখানে প্রার্থী নিয়ে জটিল সমীকরণে বিএনপি। কমপক্ষে তিন জন আলোচিত প্রার্থী ভোটের মাঠে। দলের টিকিট পেতে তারা মরিয়া হয়ে হাইকমান্ডের সাথে দেন-দরবার করছেন। বিএনপিতে বিরোধ চলছে। মনোনয়ন নিয়ে বিরোধ আরো বাড়তে পারে। বিরোধ কাটিয়ে উঠলে আসনটি বিএনপির ঘরেই আসবে।
চট্টগ্রাম-৬ (রাউজান) আসন এক বছরেরও বেশি সংঘাত সহিংসতার জন্য আলোচিত। বিএনপির দুই গ্রুপ রাউজানে আধিপত্য কায়েমের লড়াইয়ে লিপ্ত। ইন্ধন দেন উত্তর জেলা বিএনপির সাবেক নেতা গোলাম আকবর খোন্দকার। আওয়ামীদের ভিড়িয়ে তিনি রাজনীতি করতে গিয়ে সংঘাতে জড়ান। এই আসনে বিএনপির মজলুম নেতা সাবেক এমপি গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী দলের মনোনয়ন পাচ্ছেন এটা প্রায় নিশ্চিত। আসনটি বিএনপির থাকছে।
চট্টগ্রাম-৭ (রাঙ্গুনিয়া) শহীদ সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর কারণে বিএনপির আসন হিসাবে পরিচিত। এখানে বিএনপির হয়ে মাঠে আছেন তারই পুত্র হাসিনার আমলে গুমের শিকার বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হুম্মাম কাদের চৌধুরী। এ আসনে জামায়াত সুবিধায় নেই। রাঙ্গুনিয়ায় বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়ার প্রথম মাজার। বিএনপির মনোনয়ন পেতে আরো দুয়েকজন নেতা মাঠে আছেন।
চট্টগ্রাম-৮ (বোয়ালখালী-চান্দগাঁও) আসনে বিএনপির অবস্থান ভালো। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে চট্টগ্রামে উন্নয়ন হলেও অবহেলিত ছিল বোয়ালখালী উপজেলা। এখানে বিএনপির একাধিক সম্ভাব্য প্রার্থী মাঠে আছেন। জামায়াত আগেই তাদের একক প্রার্থী ঘোষণা করেছে। তবে জামায়াতের তেমন জনসমর্থন নেই। বিএনপি প্রার্থী একাট্টা হলে জয় নিশ্চিত।
চট্টগ্রাম-৯ (কোতোয়ালি-বাকলিয়া) মহানগরীর প্রাণ কেন্দ্রের এই আসনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে বিবেচিত। বলা হয় এ আসনে যিনি বিজয়ী হবেন তার দলই ক্ষমতায় যাবে। বিএনপির সম্ভাবনা বেশি। তবে বিএনপির একাধিক মনোনয়ন প্রত্যাশী। দলে আছে গ্রুপিং, চাঁদাবাজির সমস্যা। জামায়াত ভোটের লড়াইয়ে মাঠে নেমেছে বিশিষ্ট চিকিৎসক সমাজসেবী ডা. এ কে এম ফজলুল হককে মনোনয়ন দিয়ে। সজ্জন হিসাবে পরিচিতি এই পেশাজীবী নেতা এক বছরের বেশি সময় ধরে ভোটারদের ঘরে ঘরে ছুটছেন। এই আসনে জনসমর্থন ব্যাপক না হলেও সাংগঠনিক শক্তিশালী জামায়াত-শিবির। তারা পুরো শক্তি নিয়ে মাঠে তৎপর।
চট্টগ্রাম-১০ (ডবলমুরিং-পাহাড়তলী) এই আসনে এক সময় প্রার্থী ছিলেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মরহুম আবদুল্লাহ আল নোমান। আসনটিতে এবার কে পাবেন ধানের শীষ তা এখনো অনিশ্চিত। তবে এই আসনে বিএনপির সমর্থন বেশি। প্রার্থী যাকেই করা হোক আসনটিতে ধানের শীষের বিজয় নিশ্চিত। জামায়াত আগেই প্রার্থী দিয়েছে। তারা গণসংযোগও করছেন।
চট্টগ্রাম-১১ (বন্দর-পতেঙ্গা) আসনে এবারও বিএনপির মনোনয়ন পাচ্ছেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী এটা প্রায় নিশ্চিত। এটি বিএনপির আসন হিসাবে পরিচিত। এখানে জামায়াতের গ্রহণযোগ্য প্রার্থী নেই। বিএনপিতে আরো প্রত্যাশী থাকলেও আমীর খসরু প্রার্থী হলে সবাই তার পক্ষেই কাজ করবেন।
চট্টগ্রাম-১২ (পটিয়া) আসনটি বিএনপির ঘাঁটি হিসাবে পরিচিত। প্রতিটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে এখানে ধানের শীষের বিজয় হয়েছে। এবারও তার ব্যতিক্রম হবে না। বিএনপির একাধিক মনোনয়ন প্রত্যাশি আছেন। তারা মাঠেই আছেন। জামায়াত যথারীতি প্রার্থী দিয়ে মাঠে আছে। তবে তাদের জনসমর্থন তেমন নেই।
চট্টগ্রাম-১৩ (আনোয়ারা-কর্ণফুলী) আসনে বিএনপির মনোনয়ন দৌড়ে আছেন বেশ কয়েকজন নেতা। গ্রহণযোগ্য নেতাকে প্রার্থী দিয়ে মাঠে নামলে আসনটি বিএনপির ঘরেই যাবে। এই আসনে জামায়াত প্রার্থী দিয়েছে। তিনি প্রচারে নেমে পড়েছেন। তবে তেমন সাড়া মিলছে না।
চট্টগ্রাম-১৪ (চন্দনাইশ) আসনটি সাবেক বিএনপি নেতা এলডিপির চেয়ারম্যান কর্নেল অব. অলি আহমদ বীর বিক্রমের আসন হিসাবেই পরিচিতি। তিনি এই আসনে বিএনপি জোটের প্রার্থী হচ্ছেন বলে জানা গেছে। এমন হলে তার বিজয় নিশ্চিত। বিএনপি জোটের বাইরে এলডিপির হয়ে নির্বাচন করলেও জয়ী হতে পারেন। এ আসনে বিএনপির কয়েকজন মনোনয়ন প্রত্যাশী আছেন। জামায়াত প্রার্থী দিলেও তেমন জনসমর্থন নেই।
চট্টগ্রাম-১৫ (সাতকানীয়া-লোহাগাড়া) আসনটি জামায়াতের ‘ঘাঁটি’ হিসাবে পরিচিত। জামায়াত প্রার্থী দিয়ে মাঠে আছে। বিএনপির একাধিক নেতা দলের টিকিট পেতে মাঠে সক্রিয়। দল অসংগঠিত।
চট্টগ্রাম-১৬ (বাঁশখালী) আসনটি নিজেদের আয়ত্তে নিতে মরিয়া জামায়াত। যদিও এটি বিএনপির আসন। বিগত উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে বিজয়ী হন জামায়াত নেতা জহিরুল আলম। তাকে নিয়েই সংসদ নির্বাচনে জয় চায় দলটি। এখানে বিএনপির জনপ্রিয় নেতা ছিলেন সাবেক প্রতিমন্ত্রী জাফরুল ইসলাম চৌধুরী। তার মৃত্যুর পর ছেলে আসনটিতে মনোনয়ন পেতে তৎপর। আরো কয়েকজন প্রত্যাশীকে ঘিরে আছে বিএনপির কোন্দল।
পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়িÑ এই তিনটি আসনে বিএনপি এবং জামায়াত উভয়েই ভোটের মাঠে ধীরগতিতে তৎপর। বান্দরবান ও খাগড়াছড়িতে বিএনপির অবস্থান জোরালো হয়েছে। তবে বান্দরবানে দলে গ্রুপিং কাটেনি। রাঙ্গামাটিতে বিএনপির তৎপরতা কম। তিন আসনেই বিএনপি জামায়াতের টার্গেট নিষিদ্ধ আওয়ামী ঘরানার সমর্থন। বান্দরবানে জামায়াতের তৎপরতা দিন দিন দৃশ্যমান। তিনটি জেলার তিন আসনে বিএনপি সংগঠিত হয়ে ভোটের মাঠে নামলে জয়ের সম্ভাবনা উঁকি দিচ্ছে।
কক্সবাজারের ৩টি আসনে বিএনপির কোন্দল : ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন যত ঘনিয়ে আসছে মাঠে রাজনৈতিক দলগুলোর তৎপরতা ততই বাড়ছে। কক্সবাজারের ৪টি আসনে বিএনপি, জামায়াতসহ রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা মাঠ সরগরম করে তুলেছেন। মাঠজরিপে দেখা গেছে, ৪টি আসনেই মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আছেন বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থীরা। তবে সম্প্রতি জামায়াত নিয়ে হেফাজতে ইসলাম ও এনসিপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের মন্তব্য মাঠপর্যায়ে বিরূপ প্রভাব পড়েছে। অপরদিকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সম্প্রতি বিবিসিকে দেয়া সাক্ষাতকারে তৃণমূল বিএনপিতে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে।
জেলার ৪টি আসনেই প্রার্থী মনোনয়নে সুবিধাজনক অবস্থানে জামায়াত। কক্সবাজার-১, (চকরিয়া-পেকুয়া) আসন ছাড়া অপর ৩টি আসনে বিএনপিতে চরম কোন্দলে থাকায় এখনো প্রার্থী চুড়ান্ত হয়নি। জামায়াত আগেই প্রার্থী চুড়ান্ত করে প্রচার-প্রচারণা ও নির্বাচনী কর্মকান্ডে অনেকদূর এগিয়েছে।
কক্সবাজার-১ (চকরিয়া-পেকুয়া) আসনে বিএনপিতে তথা জাতীয় রাজনীতিতে সময়ের আলোচিত নেতা এবং গুমের শিকার মজলুম নেতা দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সাবেক যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী সালাউদ্দিন আহমদকে চূড়ান্ত প্রার্থী হিসেবে ধরে নিয়ে প্রচার-প্রচারণা চালানো হচ্ছে। এখানে জামায়াতের প্রার্থী সাবেক শিবির নেতা আব্দুল্লাহ আল ফারুক। এ আসনে সালাউদ্দিন আহমদের পক্ষে বিশাল জনসমর্থন থাকলেও আওয়ামী লীগের ভোটাররা জামায়াতের পক্ষ নিয়ে প্রকাশ্যে মাঠে নামায় কৌশলগত সুবিধা নেয়ার চেষ্টায় জামায়াত।
কক্সবাজার-২ (মহেশখালী-কুতুবদিয়া) আসনে চরম কোন্দলে থাকা বিএনপির বিরোধ এখনো মিঠেনি। অপরদিকে জামায়াত দলের কেন্দ্রীয় সহকারি সেক্রেটারী জেনারেল সাবেক এমপি ড. হামিদুর রহমান আজাদকে অনেক আগেই প্রার্থী ঘোষণা দিয়ে মাঠে কাজ করে আসছে। এখানে ঐক্যবদ্ধ বিএনপির প্রার্থী সাবেক এমপি আলমগীর ফরিদ হলে আসনটি বিএনপির হাতে আসতে পারে বলে ভোটাররা মনে করেন। তবে আসনটি পুনরুদ্ধারে জামায়াত মরিয়া।
কক্সবাজার-৩ (সদর-রামু-ঈদগাঁও) আসনেও বিএনপি আগে থেকেই দুই গ্রুপে বিভক্ত। দলের কেন্দ্রীয় মৎস্যজীবী বিষয়ক সম্পাদক সাবেক এমপি লুৎফুর রহমান কাজল মাঠে আছেন আগে থেকেই। সম্প্রতি সাবেক এমপি ইঞ্জিনিয়ার সহীদুজ্জামান দলের কেন্দ্রীয় সদস্য মনোনীত হওয়ায় গ্রুপিং প্রবল হয়েছে। তার পিতা সাবেক মন্ত্রী শহীদ মৌলভী ফরিদ আহমদ ও বড় ভাই সাবেক এমপি অ্যাড. খালেকুজ্জামানের তুমুল জনপ্রিয়তা ইঞ্জিনিয়ার সহীদুজ্জামানের সমর্থনের পাল্লা ভারী করেছে বলে মনে করা হয়। তবে দুইজনের যে কাউকে মনোনয়ন দিলে আসনটি বিএনপির ঘরে থাকবে বলে মনে করেন ভোটাররা। এ আসনে জামায়াতের প্রার্থী হয়ে মাঠে তৎপর সাবেক শিবির নেতা ও কক্সবাজার কলেজের সাবেক ভিপি শহীদুল আলম বাহাদুর। অতীতে জামায়াত প্রার্থী এখানে কোন সময়ই জয়ী হয়নি। এবারে শক্ত অবস্থানে দাঁড়াতে চায় জামায়াত।
কক্সবাজার-৪ (উখিয়া-টেকনাফ) আসনে অতীতে জাতীয় নির্বাচনে জামায়াত ১৯৯৬ ছাড়া সবসময় বিএনপির সাথে সমঝোতা করায় সুবিধা পেয়েছিল বিএনপি। এ আসনে চার বার বিজয়ী হন বিএনপি নেতা শাহজাহান চৌধুরী। ‘৯৬ সালে একই পরিবার থেকে দুইজন তথা বড় ভাই শাহজাহান চৌধুরী বিএনপি থেকে এবং ছোট ভাই অ্যাড. শাহজালাল চৌধুরী জামায়াত থেকে নির্বাচন করায় আ. লীগ প্রার্থী বিজয়ী হন। এবার শাহজাহান চৌধুরীর পরিবারের বাইর থেকে জেলা জামায়াতের আমীর অধ্যক্ষ নুর আহমদ আনোয়ারীকে প্রার্থী দিয়ে শক্ত অবস্থান নিয়েছে জামায়াত। আনোয়ারী টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউপির টানা ৪ দফায় চেয়ারম্যান থাকার সুবাদে এবং জামায়াতের পরিকল্পিত দলীয় কর্মকান্ডে জনপ্রিয়তা বেড়েছে তার। অপরদিকে জেলা বিএনপির সভাপতি শাহজাহান চৌধুরী চারবার এমপি হলেও দলীয় গ্রুপিংয়ে বিএনপি এখন টালমাটাল। বিএনপি থেকে অপর মনোনয়ন প্রত্যাশী জেলা বিএনপির অর্থ সম্পাদক আব্দুল্লাহ একটি শক্ত অবস্থান সৃষ্টি করেছেন। এ আসনেও বিএনপির মনোনয়ন কে পাবেন এটা নিশ্চিত না হওয়ায় সুবিধা নিচ্ছে জামায়াত। বলা যায়, এ আসনে হাড্ডাহাড্ডি অবস্থানে আছে বিএনপি-জামায়াত। ভোটের রাজনীতিতে কক্সবাজারে অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর তৎপরতা থাকলেও কোন আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আসার মত অবস্থা এখনো সৃষ্টি হয়নি। এবি পার্টি, ইসলামী আন্দোলন, নেজামে ইসলামী, খেলাফত মজলিস ও খেলাফত আন্দোলন জেলার ৪টি আসনেই প্রার্থী ঘোষণা করেছে। এনসিপি এ পর্যন্ত শুধু কক্সবাজার সদর ও উখিয়া-টেকনাফে প্রার্থী ঘোষণা করেছে।