Image description

দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বর্তমানে অন্যতম আলোচিত নাম ‘জামায়াতে ইসলামী’। আওয়ামী স্বৈরশাসনের রোষানলে পড়া দলটি জুলাই বিপ্লব-পরবর্তী সাংগঠনিক তৎপরতায় খুব দ্রুতই ঘুরে দাঁড়িয়েছে। একইসঙ্গে নিজস্ব গণ্ডি পেরিয়ে সর্বত্রই দলটির জনসমর্থন ও সম্পৃক্ততা অনেক বেড়েছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বোদ্ধারা। সাম্প্রতিক বিভিন্ন জরিপেও তার বহিঃপ্রকাশ দেখা গেছে। এ অবস্থায় আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে বড় প্রত্যাশা দলটির। সে লক্ষ্যে নানামুখী সর্বোচ্চ কৌশল নিয়ে এগোচ্ছে দলটি।

জানা গেছে, বৃহত্তর কৌশলের অংশ হিসেবে দলের ভেতরে ও বাইরের বিভিন্ন পেশার বিশিষ্টজনদের সমন্বয়ে প্রার্থিতাকে ‘ইনক্লুসিভ’ করার পরিকল্পনা নিয়েছে জামায়াতের হাইকমান্ড। যোগ্য হলে অমুসলিমদেরও প্রার্থী রাখার চিন্তা আছে দলটির। এছাড়া সরকার গঠনের মতো সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে ইসলামি ও সমমনা বিভিন্ন দলের ভোট এক বাক্সে আনতে নির্বাচনে আসন সমঝোতারও প্রক্রিয়া চলছে। এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ছাড় দেওয়ার চিন্তা রয়েছে তাদের।

এর আগে নিজেদের মতো করে প্রাথমিকভাবে ঘোষিত প্রার্থীরা মাঠে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন। একইসঙ্গে নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে বিভিন্ন দাবিতে সমমনা সাত দলের সঙ্গে অভিন্ন আন্দোলন চালাচ্ছে দলটি। শুধু তা-ই নয়, জনরায় পেলে সরকার গঠনের মতো প্রস্তুতিও নিচ্ছে তারা। এজন্য দেশের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মহলেও গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর নানা প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে বলে জানা গেছে।

যদিও জামায়াতের উদ্যোগে সম্ভাব্য ইসলামি ও সমমনাদের জোট প্রক্রিয়া ভেস্তে দিতে একটি মহল নানা তৎপরতা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিশেষ করে ‘আকিদাগত’ পার্থক্যের কথা বলে হেফাজতে ইসলামের একটি অংশসহ জামায়াতবিরোধী বিভিন্ন মহল কওমি ধারার ইসলামি দলগুলোকে নানাভাবে চাপ সৃষ্টি করছে। রাজনৈতিক প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপিও তাদের সম্ভাব্য জোটে অনেককে টানার চেষ্টা চালাচ্ছে। তবে তৃণমূলের চাওয়া ও চাপসহ বৃহত্তর স্বার্থে ইসলামি ও সমমনাদের অনেকেই আসন সমঝোতার বিষয়ে জোট গড়ার ব্যাপারে মানসিকভাবে অনড় আছেন বলে জানা গেছে।

সূত্রমতে, আগামী নির্বাচনের জন্য জামায়াতের দলীয় সব প্রস্তুতি বেশ জোর গতিতে চলছে। তবে এসব প্রস্তুতির পাশাপাশি তাদের মূল টার্গেট নির্বাচনটা যেন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়। এজন্য প্রয়োজনীয় সংস্কারের জন্য জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দিয়ে সে অনুযায়ী নির্বাচন, পিআর পদ্ধতি চালু, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিতসহ পাঁচ দফা দাবি নিয়ে রাজপথে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, দীর্ঘ আওয়ামী স্বৈরশাসনের জুলুম-নির্যাতনের শিকার সাধারণ মানুষ চব্বিশের জুলাই বিপ্লবের পর রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন দেখতে চায়। তারা আর গুম, খুন, সন্ত্রাস, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি ও লুটপাট দেখতে চান না। এজন্য ইসলামি দলগুলোর ঐক্যের মাধ্যমে একটি সরকার গঠিত হোকÑসাধারণ ও ধর্মপ্রাণ মানুষের এটাই চাওয়া।

এমন পরিস্থিতিতে আগামী নির্বাচন এটাই চাওয়া।

এমন পরিস্থিতিতে আগামী নির্বাচন ঘিরে বিভিন্ন জরিপে দেশের সবচেয়ে বড় ইসলামি দল জামায়াতে ইসলামীর প্রতি মানুষের সমর্থন বেড়েছে। সম্প্রতি ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনে ইসলামী ছাত্রশিবিরের ভূমিধস বিজয়ে সংশ্লিষ্টদের সে প্রত্যাশা ও আস্থা আরো জোরদার হয়েছে। এ জনসমর্থন কাজে লাগিয়ে কাঙ্ক্ষিত ফল ঘরে তুলতে নানা কৌশল নিয়ে কাজ করছে জামায়াত।

নির্বাচনি কৌশল সম্পর্কে জানতে চাইলে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার আমার দেশকে বলেন, সব ইসলামি ও দেশপ্রেমিক কিছু দলের সঙ্গে আমাদের নির্বাচনি ঐক্য প্রক্রিয়া নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছে। আমরা এ ক্ষেত্রে অনেক সম্ভাবনা দেখছি।

তিনি বলেন, নির্বাচনি ইস্যুতে একটি অভিন্ন ইস্যুতে আমরা এগোচ্ছি। এটাই একটি ঐক্যের প্রক্রিয়ায় রূপ নেবে ইনশাআল্লাহ্। শরিকদের সঙ্গে আসন সমঝোতায় সর্বোচ্চ ছাড় দেওয়া হবে জানিয়ে গোলাম পরওয়ার বলেন, ঐক্যের স্বার্থে যতটা সম্ভব সবাইকেই ছাড় দিতে হবে। সেটা কতসংখ্যক হবে, তা কাজ শুরু হলে বলা যাবে।

বড় জয়ের টার্গেট ও জনরায় পেলে সরকার গঠনের প্রস্তুতি প্রসঙ্গে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল বলেন, জনগণ যদি আমাদের পক্ষে রায় দেয়, আল্লাহর রহমত হলে রাষ্ট্র কীভাবে পরিচালনা করব, জনগণের সেবায় কীভাবে নিয়োজিত রাখব, সেই প্রস্তুতি আমাদের আছে।

আকিদাগত পার্থক্যের কথা বলে জামায়াতের সঙ্গে ঐক্যে একটি মহলের আপত্তি প্রসঙ্গে গোলাম পরওয়ার বলেন, এটা প্রথাগত ও কিছু অসত্য তথ্যের ভিত্তিতে চালু আছে। কিছু ভিন্ন মতপার্থক্য তো থাকবেই। তবে মৌলিকভাবে ইসলামের মূল চিন্তা এবং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের ভিত্তিতে চিন্তা-আকিদাই আমাদের আকিদা। এ নিয়ে কিছু মানুষ অপপ্রচার চালায়।

ভোটের মাঠে তৎপরতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা মানুষের কাছে যাচ্ছি, সভা-সমাবেশ করছি। আমরা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেলে দেশ কীভাবে চালাব, সেই ধারণা মানুষকে দিচ্ছি। ন্যায়বিচার,

ব্যবসা-বাণিজ্যের সুষ্ঠু পরিবেশের আশ্বাস দিচ্ছি।

প্রার্থী মনোনয়নে বৈচিত্র্য আনার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা ইনক্লুসিভভাবে প্রার্থিতার ক্ষেত্রে সরকারের সাবেক পদস্থ আমলা, সেনাবাহিনীর সদস্য, বড় আলেম, এমনকি কোনো এলাকায় যদি অমুসলিমকেও যোগ্য হিসেবে পেয়ে যাই, তাহলে তাদেরকেও নেব। আমরা সবাইকে ধারণ করেই একটি নির্বাচনে যেতে চাচ্ছি, যেন সংসদ খুব দক্ষ ও যোগ্য হয়।

সূত্রমতে, আগামী জাতীয় নির্বাচনে ভোটের বিভিন্ন কাজে দায়িত্ব পালনের জন্য দলীয় নেতাকর্মী প্রস্তুত করছে জামায়াত। এজন্য সারা দেশে পোলিং এজেন্ট হিসেবে নারী-পুরুষ বাছাই করে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। ভোটকেন্দ্র দখলসহ কোনো কারচুপি যাতে না করতে পারে, সেজন্য তৎপর থাকবে দলটি।

এ প্রসঙ্গে দলটির আমির ডা. শফিকুর রহমান ঢাকা-১৫ নির্বাচনি গণসংযোগকালে ভোটকেন্দ্রগুলো শক্তভাবে পাহারা দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, আমরা চাই ভোট সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হোক। সেই ভোটে যে-ই পাস করবে, আমরা তাকে অভিনন্দন জানাব। কিন্তু যদি কেউ ভোট ডাকাতি করতে আসে, তাহলে তার হাত ভেঙে দেওয়ার জন্য তৈরি থাকতে হবে।

সূত্রমতে, অভিন্ন আন্দোলন ঘিরে জামায়াতসহ সাতটি দল এখন অনেক কাছাকাছি। এর মধ্যে রয়েছে ইসলামী আন্দোলন, খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, খেলাফত আন্দোলন, নেজামে ইসলাম পার্টি, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা)। এর বাইরে এনসিপি, এবি পার্টি, গণঅধিকার পরিষদসহ বিভিন্ন দলের সঙ্গেও জামায়াত নেতাদের যোগাযোগ রয়েছে। তবে এসব দল নির্বাচনি জোটের বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি বলে জানা গেছে।

এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত না হলেও জামায়াতসহ ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে আসন সমঝোতা করে ভোট করার টার্গেট চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলনের। এ বিষয়ে দলের সহকারী মহাসচিব ও কুমিল্লা-৩ আসনের প্রার্থী মাওলানা আহমদ আব্দুল কাইয়ুম বলেন, নির্বাচনি এলাকায় সবার কথা হলো এবার ইসলামি দলগুলো ঐক্যবদ্ধ হলে জয়ের সম্ভাবনা অনেক। তবে কতটি আসনে তাদের সমঝোতার টার্গেটÑতা এখনো ঠিক হয়নি।

বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা জালালুদ্দীন আহমদ বলেন, আমরা কোনো নির্বাচনি জোটের বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত নিইনি। আপাতত পাঁচ দফা দাবিতে সাতটি দল মাঠে আছি। ২৫ অক্টোবর আমাদের দলের সাধারণ পরিষদ ও মজলিসে শূরার অধিবেশন ডাকা হয়েছে। সেখানে তৃণমূলের বক্তব্য শুনে জোট বা সমঝোতার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে। এ পর্যন্ত ২৭২ আসনে তারা প্রার্থী দিলেও অন্তত ৫০ আসনে তাদের সমঝোতার টার্গেট রয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

ইসলামি দলগুলোর সমঝোতার ভিত্তিতে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সম্ভাবনার কথা জানিয়ে খেলাফত মজলিসের যুগ্ম মহাসচিব অধ্যাপক আব্দুল জলিল জানান, চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত না হলেও আমরা আশাবাদী ইসলামি দলগুলোর আসন সমঝোতার ভিত্তিতে নির্বাচনে নামব। তফসিলের আগে বা পরে আসন সমঝোতার বিষয়টি আলোচনা হতে পারে। কত আসন চাওয়া হবে, তা দলের ভেতরে সম্ভাব্যতা যাচাই করে ঠিক করা হবে।

খেলাফত আন্দোলনের নায়েবে আমির মাওলানা মুজিবুর রহমান হামিদী বলেন, আমরা একটি ইসলামি জোটের মাধ্যমে নির্বাচনে যাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী। ইসলামি দলগুলোর জোটের বিষয়ে আপাতত কোনো বাধা নেই জানিয়ে তিনি বলেন, আশা করি সময়মতো সব সিদ্ধান্ত হবে। আসন সমঝোতার আলোচনা হলে প্রার্থী চূড়ান্ত করব।

নেজামে ইসলাম পার্টির মহাসচিব মাওলানা মুসা বিন ইজহার বলেন, আমরা আপাতত জামায়াতের বাইরে সমমনা দলগুলোর মধ্যে ঐক্য সুসংহত করছি। নিজেদের প্রার্থী চূড়ান্ত করা হচ্ছে। নির্বাচনি তফসিল হলে বৃহত্তর ঐক্যের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে।

ইসলামি ও সমমনাদের জোট প্রক্রিয়ার সম্ভাবনার কথা জানিয়ে জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির (জাগপা) সহসভাপতি ও দলীয় মুখপাত্র রাশেদ প্রধান বলেন, যুগপৎ আন্দোলনে সাত দলের চমৎকার বোঝাপড়া সৃষ্টি হয়েছে। এটি নির্বাচনি জোটে রূপান্তরিত হবে, তাতে আরো কিছু দল আসবে। ১৫ আসনে নির্বাচনের প্রস্তুতি থাকলেও সমঝোতায় তা চূড়ান্ত হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

অন্যদিকে এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানিয়েছে আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টি, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও গণঅধিকার পরিষদ। এসব দলের নেতারা জানান, কিছু আলোচনা হলেও তা উল্লেখ করার মতো কিছু নয়। তফসিলের পর জোটের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে।