
জুলাই গণঅ্যভুত্থানের জেরে গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার। ২০২৪ সালের ৮ আগস্ট ড. ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে এ সরকার গঠন করা হয়। অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর পূর্তি আজ (শুক্রবার)। রাষ্ট্র ও সমাজের বৈষম্য দূর, মৌলিক সংস্কারসহ মানুষের আকাশচুম্বী প্রত্যাশা ও আকাঙ্ক্ষা নিয়ে গঠিত সরকারের সফলতা এবং ব্যর্থতা নিয়ে আলাপ চলছে জোরেশোরে।
পর্যবেক্ষক মহলের মতে, এক বছরে মানুষের ওই প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যে বিস্তর ফারাক। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসেনি। ‘মব’, চাঁদাবাজি, নারী নির্যাতন ও ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা ঘটেই চলছে। কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য কমেনি। উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে এক ধরনের স্থবিরতা বিরাজ করছে। বিনিয়োগ বাড়েনি।
নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়নি। বেকারত্ব কমেনি উলটো বেড়েছে। মূল্যস্ফীতি ৮ দশমিক ৫৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। পাচারের টাকা ফেরত আসেনি। তবে বিদেশে কিছু সম্পদ শনাক্ত ও জব্দ হয়েছে। এসবের প্রভাব পড়েছে কর্মসংস্থান, শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও উৎপাদনমুখী খাতগুলোতে। এসব খাতের সূচকগুলো নিম্নমুখী।
তবে বিশ্লেষকদের মতে, ব্যর্থতার পাশাপাশি এ সরকারের বেশকিছু সফলতাও আছে। বড় সাফল্যগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, দায়িত্ব নেওয়ার এক বছরের মাথায় জাতীয় নির্বাচনের নির্দিষ্ট সময়সীমা ঘোষণা। নির্বাচনি প্রক্রিয়া, সংবিধানসহ মৌলিক সংস্কার ও বিচার কার্যক্রমে বড় অগ্রগতি হয়েছে।
ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিকে এগোচ্ছে সরকার ও ইসি। এতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে স্বস্তি দেখা যাচ্ছে। দেশের ভেতর ও বাইরের নানা সংকটে রাজনৈতিক দলগুলোকে এক টেবিলে বসাতে পেরেছে এই সরকার। রাষ্ট্র পরিচালনায় নিয়মিত কাজগুলো অব্যাহত রেখেছে। অর্থনৈতিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরতে শুরু করেছে।
সরকারের এক বছরের মূল্যায়ন বিষয়ে জানতে চাইলে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে যুগান্তরের কথা হয়।
তিনি বলেন, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে মানুষের মৃত্যু ও আহতদের রক্তের দাগের ওপর দাঁড়িয়ে যখন এই সরকার দায়িত্ব নেয়, তখন দেশ ফাংশন করছিল না। পুলিশ আইনশৃঙ্খলা রক্ষার চেয়ে নিজেরা পালিয়ে বেড়াচ্ছিল, প্রশাসন অকার্যকর হয়ে পড়েছিল। দেশে এক ধরণের অরাজক পরিস্থিতি ছিল। দেশ তছনছ হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। এমন একটি ভঙ্গুর পরিস্থিতি থেকে দেশকে তুলে এই পর্যায়ে নিয়ে আসা এই সরকারের বড় সাফল্য।
তিনি বলেন, রাষ্ট্রের প্রতিটি বিভাগকে সচল করে সিস্টেমের মধ্যে নিয়ে আসা হয়েছে। জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বাড়ার কথা ছিল, তা বাড়েনি। ব্যাংকিং খাতে অচলাবস্থা তৈরির কথা ছিল, কিন্তু সেখানে নীরব বিপ্লব হয়েছে। দেশে এখন হেলথি রিজার্ভ রয়েছে। সমুদ্র ও স্থল বন্দরগুলো সচল রেখে দেশের আমদানি-রপ্তানির ভারসাম্য রাখা হয়েছে। দেশের আন্তঃযোগাযোগ ব্যবস্থা সচল রাখা হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সরকার নিয়ে অনেক সমালোচনা থাকতে পারে, অনেক প্রত্যাশাও থাকতে পারে। তবে বাস্তব অবস্থাও চিন্তা করতে হবে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। ওই দিনই শেখ হাসিনা ও তার বোন ভারতে পালিয়ে যান। ওই সরকারের পতনের ৩ দিন পর রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলোচনার ভিত্তিতে গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার। এরপরই বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ তাদের দীর্ঘদিনের বঞ্চনা দূর করার দাবিতে একের পর এক রাস্তায় নেমে আসেন। ঘোষণা করেন বিভিন্ন কর্মসূচিও। এছাড়া গত এক বছরে আনসার বিদ্রোহসহ সরকারবিরোধী বিভিন্ন পক্ষও মাথাচাড়া দেয়।
গণঅভ্যুত্থানে গঠিত এ সরকারের কাছে মানুষের আকাশচুম্বী প্রত্যাশা থাকলেও তা পূরণ হয়নি বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ। তিনি বলেন, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে জনগণের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তাদের আকাশচুম্বী প্রত্যাশা থাকে। পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা থেকে এতসব রক্তদান, আত্মাহুতি, সাহসিকতা এবং বীরত্বের পরও আমাদের যে প্রত্যাশা সেটা পূরণ হচ্ছে না। তিনি বলেন, দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে আমলাতন্ত্র ও পুলিশ বাহিনীতে পরিবর্তন আসেনি। অনেক জায়গায় কোনো পরিবর্তন হয়নি। এই পরিবর্তন ছাড়া খুব একটা আগানো যাবে না।
৪ আগস্ট প্রতিবেদন প্রকাশ করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। এতে রাষ্ট্র ও সরকারের এক বছরের চিত্র উঠে আসে। টিআইবি বলেছে, অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক বহুবিধ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হওয়া সত্ত্বেও কর্তৃত্ববাদী সরকার পতনের পর এক বছরে বিচার, সংস্কার, নির্বাচন প্রস্তুতি ও রাষ্ট্র পরিচালনার বিভিন্ন ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। তবে সুশাসনের আলোকে অপ্রাপ্তি বিশেষ করে একদিকে আইনের শাসন ও স্বচ্ছতার ঘাটতি, স্বার্থের দ্বন্দ্ব রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের একাংশের দলবাজি, দখলবাজি, চাঁদাবাজি, মামলা-বাণিজ্য, গ্রেফতার ও জামিন বাণিজ্যের চাপে রাষ্ট্রসংস্কারের অভীষ্ট অর্জনের পথ কণ্টকাকীর্ণ হচ্ছে।
টিআইবি আরও বলেছে, সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণে অ্যাড-হক প্রবণতা, প্রশাসন পরিচালনায় অনেক ক্ষেত্রে সরকারের দৃঢ়তা ও সুস্পষ্ট কর্মপরিকল্পনার ঘাটতি এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারে দায়িত্বশীলদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা লক্ষ্য করা যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সিদ্ধান্তহীনতা বা সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর পরিবর্তন করা, যার অন্যতম প্রতিফলন। প্রশাসনিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের ক্ষেত্রে প্রধানত উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের অপসারণের মাধ্যমে দলীয়করণ থেকে মুক্ত করার প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা গেছে। কিন্তু একই সঙ্গে একদলের স্থলে অপর দল প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে কার্যত দলীয়করণের ধারাই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
অবশ্য সরকারের বছরপূর্তিতে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে ১২টি সফলতার কথা তুলে ধরেছেন। সেগুলো হচ্ছে-শান্তি ও স্থিতিশীলতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা; অর্থনীতি পুনরুদ্ধার; বাণিজ্য ও বিনিয়োগে অগ্রগতি; গণতান্ত্রিক সংস্কার ও জুলাই সনদ; জুলাই হত্যাযজ্ঞের বিচার; নির্বাচন পরিকল্পনা ও সংস্কার; প্রাতিষ্ঠানিক ও আইনগত সংস্কার; সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও ইন্টারনেট অধিকার; পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন; প্রবাসী ও শ্রমিক অধিকার; শহীদ ও আহত বিপ্লবীদের সহায়তা এবং সামুদ্রিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন।
শফিকুল আলম বলেন, জুলাই বিপ্লবের পর দেশে শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরেছে, যার ফলে নৈরাজ্য ও প্রতিশোধের চক্র বন্ধ হয়েছে। ধ্বংসপ্রাপ্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে বড় ভূমিকা রেখেছে এই সরকার। খাদ্য মূল্যস্ফীতি প্রায় ১৪ শতাংশ থেকে অর্ধেকে নামানো হয়েছে।
সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি ৮.৪৮ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে (যা ৩৫ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন)। বহু বছর পর টাকার মান ডলারের বিপরীতে বেড়েছে এবং ব্যাংক খাত স্থিতিশীল হয়েছে। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সফল শুল্ক আলোচনা হয়েছে। অনেক বিশেষজ্ঞ বলেছিলেন, দুর্বল সরকার এটি পারবে না। কিন্তু এই সরকার সেটি করে দেখিয়েছে।
নির্বাচনি পরিকল্পনার বিষয়ে তিনি উল্লেখ করেন, ফেব্রুয়ারিতে অবাধ, সুষ্ঠু ও উৎসবমুখর নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রবাসী, নতুন ভোটার এবং নারীদের অন্তর্ভুক্তির প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। প্রায় ৮ লাখ পুলিশ, আনসার ও সেনা মোতায়েনের পরিকল্পনা করা হয়েছে যাতে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন নিশ্চিত করা যায়।
বিচার ও সংস্কার : জানা গেছে, মূলত অন্তর্বর্তী সরকার তিনটি বিষয়ে জোর দিয়েছে। সেগুলো হচ্ছে-বিচার, সংস্কার ও নির্বাচন। ইতোমধ্যে ফেব্রুয়ারিতে রোজার আগে নির্বাচন আয়োজনের ঘোষণা দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
আর বিচার কার্যক্রমগুলোর মধ্যে রয়েছে, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় সারা দেশে দায়ের করা প্রায় সব হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহার, গণ-অভ্যুত্থানে হত্যায় জড়িতদের বিচার কার্যক্রম শুরু, গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক কনভেনশনে স্বাক্ষর, ৫০টি আইন প্রণয়ন এবং সুপ্রিমকোর্ট সচিবালয় অধ্যাদেশ, ২০২৫ এর খসড়া চূড়ান্তকরণ। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে গণহত্যায় চারটি মামলার বিচার কার্যক্রম চলছে। এতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারও বিচার শুরু হয়েছে।
দেশের বিভিন্ন খাত ও প্রতিষ্ঠানে সংস্কারের জন্য ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করেছে সরকার। পরবর্তীতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয়। ওই কমিশন ১৬৬টি সুপারিশ নিয়ে ৩০টির বেশি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে দুই মাস সংলাপ করেছে। এ প্রক্রিয়ায় যেসব বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেগুলো বাদ দিয়ে ১৯টি মৌলিক সংস্কারের ওপর ২৩ দিন বৈঠক করেছে। এই ১৯টি বিষয়ের ওপর দ্বিতীয় পর্যায়ে ২৩ দিন ধরে আলোচনা হয়েছে। বিএনপি ও সমমনা কয়েকটি দল ১২টি বিষয়ে ঐকমত্য এবং ৭টি বিষয়ে নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে। শিগগিরই এসব সংস্কার নিয়ে জুলাই সনদ সই হওয়ার কথা রয়েছে।