
- ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরতন্ত্র প্রতিরোধে সাংবিধানিক নিরাপত্তা
- অংশগ্রহণকারীদের সম্মান ও সুরক্ষা দিতে হবে
- শহীদদের জন্য ন্যায়বিচার এবং ঘাতকদের কঠোর শাস্তির দাবি
- রাষ্ট্রের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার
গণ-অভ্যুত্থানের মুখে গত বছর ৫ আগস্ট ফ্যাসিবাদী শাসনের পতনের মাধ্যমে রাজনৈতিক পরিবর্তনের নতুন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গঠনের জন্য ‘জুলাই বিপ্লব ঘোষণাপত্র-২০২৪’ (জুলাই সনদ) সরকারের কাছে ৯টি প্রস্তাবনা দিয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। যে ৯টি ধারা বাস্তবায়নের জন্য সরকারের কাছে প্রস্তাবনাটি পাঠানো হয়েছে, সেটি দ্রুত কার্যকরের জন্য সরকারের প্রতি এনসিপির নেতারা জোর দাবি জানিয়েছেন। সংশ্লিষ্ট দফতর, এনসিপির একাধিক নেতাকর্মী ও গোয়েন্দা সূত্র বিষয়টি নয়া দিগন্তকে নিশ্চিত করেছে।
গোয়েন্দাদের একটি সূত্র জানিয়েছে, বিপ্লবের স্বীকৃতিসহ মোট ৯টি ধারা উল্লেখ করে চূড়ান্ত প্রস্তাবনা সরকারের কাছে দিয়েছেন। সেটি বাস্তবায়নের জন্য সরকারবে চাপে রাখা হয়েছে। তবে সরকারের একাধিক সূত্রে জানা গেছে শিগগিরই জুলাই ঘোষণাপত্র প্রকাশ করা হবে। সে ক্ষেত্রে যেসব প্রস্তাবনা দেয়া হয়েছে এনসিপির পক্ষ থেকে সেগুলো যাচাই-বাছাইয়ের কাজ চলমান রয়েছে।
এনসিপি সূত্র জানিয়েছে, সম্মিলিতভাবে প্রস্তাবনায় যে ৯ ধারা যুক্ত করা হয়েছে সেটি মূলত তৈরি করেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম সদস্যসচিব আলাউদ্দিন মোহাম্মদ নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী।
প্রধান উপদেষ্টার কাছে পাঠানো প্রস্তবানায় বলা হয়েছে, আমরা, বাংলাদেশের জনগণ, স্বাধীনতা, ন্যায় ও মর্যাদার অভিন্ন আদর্শে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ঘোষণা করছি যে, ২০২৪ সালের জুলাই মাস থেকে শুরু হওয়া ঘটনাগুলো ছিল একটি জনগণের বিপ্লব একটি ন্যায়সঙ্গত, শান্তিপূর্ণ ও দৃঢ় সঙ্কল্পবদ্ধ গণ-আওয়াজ যা শোষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে জনতার প্রতিবাদ ও অধিকার প্রতিষ্ঠার স্পষ্ট ঘোষণা। এই বিপ্লব আমাদের গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রতি অবিচল প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন। আমরা এই বিপ্লবে অংশগ্রহণকারী সব নারী, পুরুষ, ছাত্র, শিক্ষা, শ্রমিক ও নাগরিকদের সাহস ও আত্মত্যাগকে গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করি, যারা শহীদ হয়েছেন কিংবা আহত হয়েছেন।
ধারা ১ বিপ্লবের স্বীকৃতি : ২০২৪ সালের জুলাই মাসে ছাত্র-জনতার স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ ও প্রতিবাদ থেকে উদ্ভূত এই গণ-আন্দোলনকে একটি ঐতিহাসিক ও ন্যায়সঙ্গত বিপ্লব হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদান করা হবে। এটি কোনো অপরাধমূলক বা ষড়যন্ত্রমূলক ঘটনা নয়, বরং স্বাধীনতা ও ন্যায়ের জন্য জনগণের এক বৈধ, গণতান্ত্রিক ও নৈতিক সংগ্রাম। রাষ্ট্র তার পরবর্তী সংবিধানে তফসিল আকারে এই ঘোষণাপত্র সংরক্ষণের ব্যবস্থা করবে।
ধারা ২ অংশগ্রহণকারীদের সম্মান ও সুরক্ষা : এই বিপ্লবে অংশগ্রহণকারী সব নাগরিককে ‘জুলাই যোদ্ধা’ হিসেবে পূর্ণ সম্মান ও মর্যাদা প্রদান করা হবে। তাদের বিরুদ্ধে কোনো পরিকল্পিত রাজনৈতিক হয়রানি, সামাজিক বৈষম্য কিংবা অপপ্রচার চালানো যাবে না। যদি কোনো সরকার, সংস্থা বা কর্তৃপক্ষ এই বিপ্লব বা বিপ্লবীদের রাজনৈতিক প্রতিশোধের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে, তবে তা জনগণের বিরুদ্ধে অবস্থান হিসেবে গণ্য করা হবে।
ধারা ৩ শহীদ ও আহতদের সম্মান : জুলাই বিপ্লবে যারা প্রাণ উৎসর্গ করেছেন, তাদের জাতীয় শহীদ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হবে এবং মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে তাদের পরিবারকে সব রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ও সুবিধা নিশ্চিতপূর্বক শহীদদের স্মৃতিকে চিরস্থায়ী করার ব্যবস্থা করা হবে। যারা আহত হয়েছেন, তাদের জন্য রাষ্ট্র পর্যায়ে উপযুক্ত চিকিৎসা, পুনর্বাসন ও আর্থিক সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে।
ধারা ৪ শহীদদের জন্য ন্যায়বিচার এবং ঘাতকদের কঠোর শাস্তির দাবি : এই বিপ্লব চলাকালে যারা পরিকল্পিতভাবে হত্যা, নির্যাতন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের সাথে যুক্ত ছিল- বিশেষ করে যারা এই নৃশংস ও বর্বর হত্যাকাণ্ডে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছে, তাদের বিরুদ্ধে স্বাধীন ও ন্যায়সঙ্গত বিচারব্যবস্থার মাধ্যমে কঠোরতম শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। শহীদ ও ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর প্রতি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার স্বার্থে এই শাস্তি কেবল প্রতীকী নয়, এই শান্তি শুধু আইনি নয়- এটি শহীদদের প্রতি জাতির নৈতিক ও ঐতিহাসিক দায়।
ধারা ৫ ব্যক্তিগত অপরাধ ও গণবিপ্লব আলাদা রাখা : জুলাই বিপ্লবে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ব্যক্তিগত কোনো অপরাধের জন্য স্বতন্ত্র দায়বদ্ধতা থাকবে এবং তা বিপ্লবের সার্বিক মর্যাদা বা নৈতিক অবস্থান ক্ষুণœ করতে পারবে না। এখন কারো ব্যক্তিগত অপরাধ বা আচরণগত ত্রুটি থাকলে, তা স্বতন্ত্রভাবে বিচারযোগ্য হবে এবং বাক্তিগত অপরাধকে পুঁজি করে গণবিপ্লবের উদ্দেশ্য, মর্যাদা বা নৈতিক অবস্থানকে খাটো করার চেষ্টা করলে, তা হবে ইতিহাস বিকৃতি ও জাতির সাথে প্রতারণা।
ধারা ৬ রাষ্ট্রের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার : এই বিপ্লবের অন্যতম লক্ষ্য হলো একটি দুর্নীতিমুক্ত, স্বচ্ছ, ন্যায়ভিত্তিক, মানবিক ও জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্র গঠন, যেখানে বাকস্বাধীনতা, মানবাধিকার ও নাগরিক মর্যাদা নিশ্চিত থাকবে। রাষ্ট্র ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এই লক্ষ্য বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে এবং প্রশাসন, বিচার, অর্থ ও সমাজব্যবস্থার সম্ভাব্য সব ক্ষেত্রে প্রয়োজনে পুনর্গঠন ও সংশোধন ঘটাবে।
ধারা ৭ দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্রের সূচনা : আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় একটি গতিশীল ও জনগণভিত্তিক সংবিধান অপরিহার্য। ২০২৪ সালের বিপ্লব ছিল একটি ব্যর্থ, দলীয় ও দমনমূলক শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে জনগণের চূড়ান্ত প্রত্যাখ্যান। এই বিপ্লবের মাধ্যমে আমরা একটি দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্রের সূচনা ঘোষণা করছি- যা প্রতিষ্ঠিত হবে জনগণের ইচ্ছা, ন্যায়, স্বাধীনতা ও মর্যাদার ভিত্তিতে। অচল ও একচেটিয়া সংবিধানের বদলে একটি নতুন সংবিধান রচিত হওয়ার পথ উন্মোচিত হবে- যা ভবিষ্যতের বাংলাদেশকে গড়ে তুলবে গণতন্ত্র, জবাবদিহিতা ও মানবিক রাষ্ট্রচেতনার ওপর ভিত্তি করে।
ধারা ৮ ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরতন্ত্র প্রতিরোধে সাংবিধানিক নিরাপত্তা : যে ফ্যাসিবাদ, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে ২০২৪ সালের বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে- তা যেন কখনো আবার ফিরে না আসতে পারে, সে জন্য সংবিধানে সুনির্দিষ্ট বিধান সংযোজন করা হবে। কোনো রাজনৈতিক দল, বাক্তি বা গোষ্ঠী যদি রাষ্ট্রক্ষমতায় গিয়ে স্বৈরতান্ত্রিক, সন্ত্রাসীবাদী, দমনমূলক ও গণবিরোধী চরিত্র ধারণ করে, তবে তাদের রাষ্ট্রীয়ভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার সাংবিধানিক ক্ষমতা সংরক্ষিত থাকবে। সংবিধান জনগণের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করবে যাতে গণতন্ত্রের নামে ফ্যাসিবাদ আর কোনোদিন ফিরে না আসে।
ধারা ৯ জনগণের রক্ষণাবেক্ষণ : এই বিপ্লব বাংলাদেশের জনগণের সম্পদ। এটি তাদের ঐতিহাসিক এবং জাতীয় গৌরবের বিষয়, তাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে যেন তারা এর স্মৃতি ও মূল্যবোধ রক্ষা করে এবং এর লক্ষ্য পূরণে অগ্রসর হয়। এর ইতিহাস, আবেগ ও উদ্দেশ্য রক্ষা করার দায়িত্ব জনগণের- কোনো একক ব্যাক্তি, দল বা প্রতিষ্ঠানের নয়। জনগণই হবে এই বিপ্লবের প্রকৃত অভিভাবক।
সমাপ্তি : এই বিপ্লবের আবেগ ও ত্যাগকে সম্মান জানিয়ে আমরা, বাংলাদেশের জনগণ, একটি সর্বভৌম, বৈষমাহীন, দমনমুক্ত, গণতান্ত্রিক ও স্বনির্ভর বাংলাদেশ গঠনের অঙ্গীকার করছি- যেখানে থাকবে মানবিক মর্যাদা, ন্যায়বিচার, সমতা ও গণ-অধিকার।