
দেশের রাজনীতিতে নির্বাচন নিয়ে ফের বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন কোন পদ্ধতিতে হবে তা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতানৈক্যের সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে বিএনপি ও এর সমমনা দলগুলোর সঙ্গে এনসিপি ও ইসলামি দলগুলোর মতপার্থক্য দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচনের দাবিও উঠেছে একাধিক রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে। এ বিষয়গুলোকে জাতীয় নির্বাচন পেছানোর ষড়যন্ত্র হিসেবেই দেখছেন বিশ্লেষকরা।
গত মাসে লন্ডনে তারেক রহমানের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বৈঠকের পর জাতীয় নির্বাচন নিয়ে এক ধরনের আশার কথা শোনা গিয়েছিল। এর আগে বিএনপি চলতি বছরের ডিসেম্বরে নির্বাচনের দাবিতে অনড় অবস্থান নিয়েছিল। তবে ওই বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা বলেছিলেন, সংস্কার ও বিচারের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হলে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন হতে পারে। যাতে সম্মতি জানিয়েছিল বিএনপিও।
তবে সম্প্রতি নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে মতভিন্নতা দেখা দিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে। গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রদের সংগঠন এনসিপি চায় সংখ্যানুপাতিক (পিআর) নির্বাচনব্যবস্থা। যাতে সায় আছে জামায়াতে ইসলামীসহ অন্যান্য ইসলামি দলগুলোর। বাম জোটও পিআর পদ্ধতির পক্ষে। অন্যদিকে বিএনপি এ ব্যবস্থার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। তারা জানিয়েছে, বাংলাদেশে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন সম্ভব নয়। এদিকে গত শনিবার রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ইসলামী আন্দোলনের মহাসমাবেশেও জামায়াতসহ ইসলামি দলগুলো পিআর পদ্ধতির পক্ষে সওয়াল তুলেছে। এ নিয়ে দেশের রাজনীতিতে নতুন করে উত্তাপ ছড়াচ্ছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি সাধারণ ভোটারদের কাছে অত্যন্ত জটিল ও দুর্বোধ্য। এখানে মানুষ সরাসরি প্রার্থীকে ভোট দেয় না, দলকে দেয়। ফলে একজন ভোটার নিশ্চিত নন তার ভোটে কে সংসদ সদস্য হবেন। গণতন্ত্রের মূল আত্মা হলো সরাসরি প্রতিনিধিত্ব, যেখানে একজন প্রার্থী তার এলাকার মানুষের প্রত্যক্ষ সমর্থনে সংসদে যায়। পিআর পদ্ধতিতে এই স্বচ্ছতা হারিয়ে যায়, দায়বদ্ধতাও ক্ষীণ হয়। সাধারণ মানুষের সঙ্গে জনপ্রতিনিধির যোগসূত্র ছিন্ন হয়ে যায়।
তারা আরো বলেন, এই ব্যবস্থায় একটি বড় ঝুঁকি হলো দুর্বল এবং অস্থির সরকার গঠনের সম্ভাবনা। যেহেতু অধিকাংশ সময় কোনো দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় না, তাই জোট সরকার গঠন হয়। একাধিক দলের সমন্বয়ে গঠিত সরকার হয় চাপে জর্জরিত, সিদ্ধান্ত গ্রহণে দুর্বল, আর রাজনৈতিক দরকষাকষিতে জর্জর, সংসদ হয়ে ওঠে একটি রঙ্গমঞ্চ। বাংলাদেশের মতো রাজনৈতিকভাবে উত্তপ্ত, স্পর্শকাতর দেশে এমন একটি সরকার জাতীয় স্বার্থে বিরাট হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। প্রতিবেশী আগ্রাসী শক্তিগুলো এমন দুর্বল সরকারকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে পারে, এবং তা বাংলাদেশের অখণ্ডতা সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তাকে চরম ঝুঁকিতে ফেলবে।
এদিকে পিআর ব্যবস্থাকে ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছে বিএনপি। পিআর পদ্ধতির নির্বাচন বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটে ‘নতুন আইডিয়া’ উল্লেখ করে এই দেশের জন্য প্রযোজ্য নয় বলে মনে করেন বিএনপি নেতারা। বিএনপি নেতারা বলছেন, একটি গোষ্ঠী এসব নতুন নতুন দাবি তুলে নির্বাচন পিছিয়ে দিয়ে জাতির সর্বনাশ করতে চাচ্ছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে ভোটের দাবিকে জাতীয় নির্বাচন পেছানোর ষড়যন্ত্র বলে মনে করছেন। কারণ সংস্কার কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর আলোচনায় পিআর পদ্ধতির নির্বাচন নিয়ে এখনো পর্যন্ত ঐকমত্য হওয়া সম্ভব হয়নি। আনুপাতিক হারে নির্বাচনের কথা যারা বলছেন, তাদের একটি উদ্দেশ্য আছে বলেও মনে করেন তিনি। তার অভিযোগ, তারা (যারা পিআর পদ্ধাতিতে নির্বাচন চায়) স্থানীয় সরকার নির্বাচন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে চায়। কারণ, এই পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন চাওয়ার মাধ্যমে ‘নির্বাচন বিলম্বিত করা’ অথবা ‘বাংলাদেশে নির্বাচন না হওয়া’ কারো উদ্দেশ্য থাকতে পারে বলে তিনি মনে করেন।
সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘বাংলাদেশের বাস্তবতায় ইতিপূর্বে সংস্কার কমিশনের সঙ্গে আমাদের যেসব আলোচনা হয়েছে, সেখানে পিআর পদ্ধতির নির্বাচনের মধ্যে আমরা কোনো ঐকমত্য পাইনি। তাছাড়া বাংলাদেশে আনুপাতিক হারে নির্বাচনের কোনো ইতিহাস নেই, সংসদীয় রাজনীতি বা সংসদীয় নির্বাচন ইতিহাসেও নেই।’
দলটির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, একটি গোষ্ঠী প্রতিনিয়ত নতুন নতুন দাবি তুলে নির্বাচন পিছিয়ে দিয়ে জাতির সর্বনাশ করতে চাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘একেকজন একেকটা দাবি তুলে নির্বাচনকে পিছিয়ে, নির্বাচনের সর্বনাশ করে দিয়ে জাতির সর্বনাশ করতে চাচ্ছে।’
সালাহউদ্দিন আহমেদ পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের সমস্যা হিসেবে বলেন, ‘আনুপাতিক হারে নির্বাচনে কোনো সংসদীয় এলাকার ভোটাররা জানবেন না যে, কে তাদের এমপি হবে। তাছাড়া তারা যে তাদের নেতার কাছে যাবেন, সেজন্য নির্ধারিত কোনো ব্যক্তিকে খুঁজে পাবেন না।’
পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের যে দাবি উঠেছে, এর আড়ালে ষড়যন্ত্র লুকিয়ে আছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি। তিনি বলেন, পিআর পদ্ধতিতে যারা নির্বাচন চায়, এর পেছনে ষড়যন্ত্র লুকিয়ে আছে। এতে লাভবান কারা হবে তা ভাবতে হবে। ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন হলে ফ্যাসিস্টরা সুযোগ পাবে।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচন একটি দীর্ঘ মেয়াদি প্রক্রিয়া। তাই এটা দাবিটা একটি বিশেষ উদ্দেশ্য করা হচ্ছে। মূলত নানাভাবে সরকারের সুবিধাভোগীরা এ দাবি করে আসছে। এ দাবির অর্থ হচ্ছে, বর্তমান সরকারকে অনির্দিষ্টকালের জন্য থেকে যাওয়ার লাইসেন্স দেওয়া। এর রাজনৈতিক তাৎপর্য হচ্ছে, দলগুলো মধ্যে আরো বিভাজন, বিভক্তি উসকে দেওয়া। তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশের বর্তমান যে রাজনৈতিক বোঝাপড়া, তাতে ভোট সংখ্যানুপাতিক ব্যবস্থার জন্য উপযোগী নয়। কিন্তু বর্তমানে এ দাবি হাজির করা মানে জাতীয় নির্বাচনকে প্রলম্বিত করার তৎপরতা।