Image description

যশোরে আওয়ামী লীগের পালিয়ে থাকা ইউপি চেয়ারম্যানদের অনেকেই এলাকায় ফিরতে শুরু করেছেন। দীর্ঘদিন পালিয়ে থাকা এসব নেতাকে পুনর্বাসনে সহযোগিতার অভিযোগ রয়েছে স্থানীয় বিএনপির প্রভাবশালী কিছু নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে। অভিযোগ রয়েছে, মোটা অঙ্কের টাকা লেনদেনসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার বিনিময়ে এসব আওয়ামী নেতাকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছেন তারা। তবে বিএনপির জেলা পর্যায়ের দায়িত্বশীল নেতারা এ অভিযোগ অস্বীকার করছেন না। তারা বলছেন, প্রমাণসাপেক্ষে যে কোনো অপকর্মের সঙ্গে যুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পলাতক চেয়ারম্যানদের এলাকায় ফিরতে সহায়তা করছেন প্রধানত বিএনপির স্থানীয় পর্যায়ের কিছু নেতা। এ কাজে বিস্তর অর্থকড়ি লেনদেন হয়েছে। এমনকি এক ইউপি চেয়ারম্যানকে ‘পুনর্বাসনের’ জন্য বিএনপির এক নেতাকে ৪০ লাখ টাকা পর্যন্ত অফার করা হয়েছে। এ ধরনের অভিযোগ সবচেয়ে বেশি রয়েছে মণিরামপুর, চৌগাছা ও কেশবপুর উপজেলায়।

মণিরামপুরের গা-ঢাকা দেওয়া চেয়ারম্যানদের মধ্যে শ্যামকুড় ইউপির আলমগীর হোসেন, ভোজগাতির আব্দুর রাজ্জাক, হরিদাসকাটির আলমগীর কবির লিটন, খেদাপাড়ার আব্দুল আলিম জিন্নাহ প্রমুখ এলাকায় ফিরে এসেছেন। এদের এলাকায় ফেরার পরিবেশ তৈরিতে উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান মিন্টু এবং যুগ্ম সম্পাদক নিস্তার ফারুক মুখ্য ভূমিকা রেখেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। অনৈতিক কর্মকাণ্ডের অভিযোগে ইতোমধ্যে নিস্তার ফারুককে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।

এ বিষয়ে আসাদুজ্জামান মিন্টু বলেন, ‘দলের কোনো কোনো নেতা আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যানদের ফিরতে সহযোগিতা করেছেন- এ কথা সত্য। আমার বিরুদ্ধেও এমন অভিযোগ আছে। আপনারা তদন্ত করে দেখুন অভিযোগ ঠিক কি-না।’

মিন্টু বলেন, ‘তবে আমার কাছে একটা অফার এসেছিল। দুর্বাডাঙ্গা ইউপি চেয়ারম্যান মাজহারুল ইসলামকে পুনর্বাসনে সহায়তা করলে আমাকে ৪০ লাখ টাকা দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়। কিন্তু আমি তা প্রত্যাখ্যান করি।’

স্থানীয় বিএনপি ও এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, চৌগাছার ফুলসারা ইউপি চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক মেহেদী মাসুদ চৌধুরী এলাকায় ফেরেন উপজেলা বিএনপির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক মো. আব্দুল্লাহ ও ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মান্নানের আশ্বাসে। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মাসুদকে গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে জেলে পাঠায়।

সূত্র জানায়, চৌগাছার পাশাপোল ইউপি চেয়ারম্যান ওবাইদুল ইসলাম সবুজকে ‘দেখেশুনে রাখছেন’ ইউনিয়ন যুবদলের যুগ্ম সম্পাদক সাইফুল ইসলাম, ইউনিয়ন বিএনপির সাবেক সভাপতি ডা. আব্দুস সামাদ এবং যুবদলের উপজেলা সাংগঠনিক সম্পাদক শরিফুজ্জামান শিমুল। ধুলিয়ানি ইউপি চেয়ারম্যান এসএম মমিনুর রহমানকে ‘নিরাপত্তা দিচ্ছেন’ ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল আলিম। চৌগাছা সদর ইউপির চেয়ারম্যান আবুল কাশেমকে ‘দেখেশুনে রেখেছেন’ উপজেলা বিএনপি সভাপতি এমএ সালাম। জগদীশপুর ইউপি চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মাস্টার সিরাজুল ইসলামকে ‘নিরাপত্তা দিচ্ছেন’ উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি জহুরুল ইসলাম। নারায়ণপুর ইউপি চেয়ারম্যান শাহিনুর রহমানকে ‘পুনর্বাসনে’ রয়েছেন ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ওহিদুল ইসলাম মেম্বার ও সাংগঠনিক সম্পাদক বাবলুর রহমান মেম্বার। সুখপুকুরিয়া ইউপি চেয়ারম্যান হবিবর রহমান হবি উপজেলা বিএনপি সভাপতি এমএ সালামের আপন ভগ্নিপতি। বিএনপি সভাপতিই তাকে ‘দেখভাল’ করছেন।

অবশ্য উপজেলা বিএনপি সভাপতি এমএ সালাম অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘দলের জন্য আমি আত্মীয়তার সম্পর্কও ত্যাগ করেছি। আওয়ামী লীগের কাউকে ‘শেল্টার’ দেওয়া আমার পক্ষে অবাস্তব চিন্তা।’ তবে তিনি তৃণমূলের কোনো কোনো নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ইউপি চেয়ারম্যানদের শেল্টার দেওয়ার অভিযোগ স্বীকার করেন। বিশেষ করে পাশাপোল, স্বরূপদহ, ধুলিয়ানিসহ কয়েকটি ইউনিয়নে এমন ঘটনায় বিএনপি নেতাকর্মীরা যুক্ত হয়ে পড়েছেন বলে মন্তব্য করেন তিনি।

কেশবপুরের ১১ ইউপির অন্তত আট চেয়ারম্যান ৫ আগস্টের পর পালিয়ে যান। তাদের মধ্যে মঙ্গলকোট ইউপির আব্দুল কাদের, সুফলাকাটির মঞ্জুর রহমান মঞ্জুসহ কয়েকজন ইতোমধ্যে এলাকায় ফিরেছেন। অভিযোগ, উপজেলা ও পৌর বিএনপির কয়েক শীর্ষ নেতা টাকার বিনিময়ে আওয়ামী চেয়ারম্যানদের পুনর্বাসন করছেন।

কেশবপুর পৌর বিএনপি সভাপতি ও সাবেক মেয়র আব্দুস সামাদ বিশ্বাস বলেন, পলাতকরা এলাকায় ফিরে এসেছেন কি না জেনে বলতে হবে। আর বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ অসত্য।

বাঘারপাড়া উপজেলার একজন ইউপি চেয়ারম্যান মঞ্জুর রশিদ স্বপন গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন। অন্য সব চেয়ারম্যান প্রকাশ্যে রয়েছেন। স্থানীয় বিএনপির এক পক্ষের অভিযোগÑ দলের কেন্দ্রীয় নেতা টিএস আইয়ুবের প্রশ্রয়ে আওয়ামী চেয়ারম্যানরা বহালতবিয়তে আছেন।

তবে টিএস আইয়ুব এ অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে বলেন, ‘৫ আগস্ট দেশ স্বৈরশাসকমুক্ত হয়েছে। আমি কারাগার থেকে বেরিয়েছি ২৮ আগস্ট। মাঝের ২৩ দিন আওয়ামী লীগের ইউপি চেয়ারম্যানরা কার শেল্টারে ছিলেন? কাউকে রক্ষা বা তাড়ানোর দায়িত্ব আমার নয়। কোনো চেয়ারম্যানকে বিতাড়িত করলে আপনারাই তো গণমাধ্যমে আমার বিরুদ্ধে লিখবেন।’

ঝিকরগাছা উপজেলার শংকরপুর ইউপি চেয়ারম্যান গোবিন্দ চ্যাটার্জি, হাজিরবাগ ইউপি চেয়ারম্যান আতাউর রহমান মিন্টুকে বিএনপির স্থানীয় কয়েক নেতা শেল্টার দিয়ে রেখেছেন বলে অভিযোগ। শংকরপুর ইউনিয়ন বিএনপি সভাপতি মাস্টার ফয়জুর রহমান এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তবে হাজিরবাগ ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক জামশেদ আলী জানান, তাদের ইউনিয়নে প্রশাসক নিয়োগের জন্য গত ২৬ মে তারা উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছে আবেদন করেছেন।

উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ইমরান সামাদ নিপুণ তার দলের কয়েক নেতার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ স্বীকার করেছেন। তবে তিনি বলেন, বিএনপি নেতাকর্মীরা ভুল বুঝতে পেরে আগের অবস্থান থেকে সরে এসেছেন।

অভয়নগরের চলিশিয়া ইউপি চেয়ারম্যান সানা আব্দুল মান্নান ৫ আগস্টের পর পালিয়েছিলেন। সম্প্রতি তিনি দুটি বড় দলের স্থানীয় নেতার প্রশ্রয়ে এলাকায় ফিরেছেন।

বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের ইউপি চেয়ারম্যানদের শেল্টার দেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেন যশোর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন খোকন। তিনি আমার দেশকে বলেন, কোনো কোনো নেতা এমন কাজে যুক্ত হয়ে পড়ছেন বলে খবর আসছে। যে কোনো নেতার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ প্রমাণিত হলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

দলের জেলা সভাপতি সৈয়দ সাবেরুল হক সাবু বলেন, ‘উত্থাপিত অভিযোগকে অমূলক বলতে পারছি না। তবে অভিযোগ সুনির্দিষ্ট না হলে কারো বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যায় না।’

যশোর জেলার আট উপজেলায় মোট ৯৩টি ইউপি রয়েছে। বিতর্কিত নির্বাচনে এসব ইউনিয়নের প্রায় সবগুলোতে আওয়ামী লীগ নেতারা চেয়ারম্যান হন। ফ্যাসিবাদী সরকারের পতনের পর তাদের বড় অংশই জনরোষে পড়ার আশঙ্কায় পালিয়ে যান। কেউ কেউ আশপাশের বিভিন্ন শহরে অবস্থান নিয়ে মাঝেমধ্যে অল্প সময়ের জন্য সন্তর্পণে এলাকায় ফিরতেন। ইউপির কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখতে কয়েক দফায় পলাতক চেয়ারম্যানদের অব্যাহতি দেওয়া হয়। জনগণের প্রাপ্য সেবা নিশ্চিত করতে যশোরে এখন পর্যন্ত ২৮টি ইউপিতে প্রশাসক নিয়োগ করা হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তাদেরই অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে বিভিন্ন ইউপির প্রশাসক নিযুক্ত করা হয়। বেশকিছু ইউপিতে চেয়ারম্যানের অনুপস্থিতিতে প্যানেল চেয়ারম্যানরা দায়িত্ব পালন করছেন। তবে এর মধ্যে শুধু চৌগাছার সিংহঝুলি ইউপি চেয়ারম্যান নিজেই ইস্তফা দিয়েছিলেন। আর একমাত্র উপজেলা বাঘারপাড়া, যেখানে কোনো ইউপি চেয়ারম্যানকে অপসারণ করা হয়নি।

এ প্রসঙ্গে স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক (উপসচিব) রফিকুল হাসান আমার দেশকে বলেন, অনুপস্থিত চেয়ারম্যানদের অপসারণ একটি চলমান প্রক্রিয়া। ফলে অপসারিত চেয়ারম্যানের সংখ্যা বাড়তে পারে।