
সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে গত বছরের ১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) থেকে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন শুরু হয়। এরপর তা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীতে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে। এই আন্দোলনের একপর্যায়ে ১৫ জুলাই ঢাবি ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করে নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগ। আন্দোলন চলাকালে ক্যাম্পাসে সংঘটিত বেআইনি ও সহিংস ঘটনার সত্যানুসন্ধান করে জড়িতদের চিহ্নিত করে প্রশাসনিক ব্যবস্থার আওতায় নিয়ে আসতে গঠিত সত্যানুসন্ধান কমিটির প্রতিবেদন চূড়ান্ত করা হয়েছে। দু-এক দিনের মধ্যে এই প্রতিবেদন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি নিয়াজ আহমেদ খানের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করবে সত্যানুসন্ধান কমিটি।
সত্যানুসন্ধান কমিটির সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জুলাই আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলায় অংশ নেয়া প্রায় দেড় শতাধিক ছাত্রলীগের নেতাকর্মী জড়িত রয়েছে বলে তাদের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে এসব নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে শাস্তি নিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে সুপারিশ করা হবে। দু-এক দিনের মধ্যে প্রতিবেদনটি ভিসির কাছে জমা দেওয়ার পর তিনিই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন বলে জানিয়ছে সত্যানুসন্ধান কমিটি।
তবে একটি সূত্র জানা গেছে, এ ঘটনায় নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম হোসেন এবং সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান এবং ঢাবি সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ কয়েক ডজনেরও বেশি নেতার সরাসরি সম্পৃক্ততা রয়েছে। যদিও তথ্যানুসন্ধান কমিটির সুপারিশে নিষিদ্ধ হওয়া ছাত্রলীগের কোনো নেতাকর্মীর নাম আছে কিনা সেই প্রসঙ্গে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি এ ঘটনায় গঠিত সত্যানুসন্ধান কমিটির আহ্বায়ক ও ঢাবির স্যার এ এফ রহমান হলের প্রভোস্ট কাজী মাহফুজুল হক সুপণ। তবে সুপারিশে যারা রয়েছেন তাদের একটি বড় অংশ নিষিদ্ধ হওয়া ছাত্রলীগের সিনিয়র নেতা বলে তিনি জানান।
সত্যানুসন্ধান কমিটির তথ্য মতে, আন্দোলনের মধ্যে ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর সবচেয়ে বড় হামলাটি করে ছাত্রলীগ ও যুবলীগ। এসময় আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের উপর হামলাকারীদের মধ্যে ঢাবি ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের চেয়ে বাইরের থেকে আসা বিভিন্ন জেলা উপজেলা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের পরিমাণ বেশি ছিল বলে জানান কমিটি।
সত্যানুসন্ধান কমিটি সূত্রে জানা যায়, এসব হামলায় জড়িতদের চিহ্নিত করতে মোটা দাগে তিনটি বিষয় সামনে রেখে কাজ করে তারা। প্রথমত বিভিন্ন গণমাধ্যমের ফুটেজ, ছবি ও সংবাদ। দ্বিতীয়ত ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপে থাকা ফুটেজ ও ছবি এবং সর্বশেষ আন্দোলনে যেসব শিক্ষার্থী সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিল তাদের কাছ থেকে ফুটেজ, ছবি ও তথ্য নিতে সাক্ষাৎকার নেওয়া। পাশাপাশি তাদের কাছ থেকে ই-মেইলের মাধ্যমেও এসব ফুটেজ ও ছবি নিয়েছে কমিটি।
সত্যানুসন্ধান কমিটির কাজী মাহফুজুল হক সুপণ দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলাকারীদের মধ্যে ঢাবি শিক্ষার্থীদের চেয়ে বাইরের থেকে আসা বিভিন্ন জেলা উপজেলা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের পরিমাণ বেশি ছিল।
‘‘বিভিন্ন দেশি এবং আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের ফুটেজ, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপে থাকা ফুটেজ এবং যারা সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়া শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ফুটেজ ও তথ্য নিয়ে চিহ্নিত করার কাজ করেছি। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল জুলাই অভ্যুত্থানে শিক্ষার্থীদের উপর হামলায় অংশ নেয়া জড়িতদের চিহ্নিত করে প্রশাসনের কাছে প্রতিবেদন জমা দেয়। সেই রিপোর্ট তৈরির কাজ শেষের পথে। আগামী সপ্তাহের শুরুতে এই প্রতিবেদন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে দিতে পারব বলে আশা করছি। অভিযোগ এসেছিল প্রায় ১৫০ জন শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে।’’
তিনি আরও বলেন, আমরা বেশি হতাহতের ঘটনা দেখেছি ১৫ জুলাই। তবে সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের চেয়ে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের বিভিন্ন জেলা উপজেলা কমিটির নেতাকর্মীরা। তারা বেশি আক্রমণাত্মক ছিলেন। আমাদের মূল কাজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে-সব শিক্ষার্থী জড়িত ছিলেন তাদের চিহ্নিত করা। সেদিনের ঘটনায় ঢাবি এলাকায় দুজনকে গুলি করতে দেখা যায়। তারা দুজনেই বহিরাগত ছিলেন বলে আমরা নিশ্চিত হয়েছি। তবে আমরা তাদেরও চিহ্নিত করেছি।
তিনি বলেন, ১৫ জুলাইয়ের বাইরে হামলা হওয়া অন্য দিনগুলোকেও আমরা আমলে নিয়েছি। বেশ কিছু ঘটনা ছিল, যা দুঃখজনক। ১৫ জুলাই ভিসি বাসভবন এবং রোকেয়া হলের মাঝে একটি দুইতলা বাস ছিল, কিছু নারী শিক্ষার্থী নিজেদের আত্মরক্ষার্থে সেই বাসে আশ্রয় নিয়েছিল। কিন্তু হামলাকারীরা সেখানেও ওই শিক্ষার্থীদের হেনস্তা করেছিল। সেই ঘটনাকেও আমরা তদন্ত করে উপস্থিত থাকা শিক্ষার্থীদের বর্ণনা অনুযায়ী অনেককে চিহ্নিত করেছি।
কাজী মাহফুজুল হক সুপণ বলেন, কমিটিতে যারা থাকেন তারা একটু সিনিয়রই হন। তবে এই মুহূর্তে আমি নির্দিষ্ট কারো নাম উল্লেখ করতে চাই না। আর আমরা কোনো শাস্তির সুপারিশ করব না। বরং ঘটনায় জড়িতদের বিষয়ে তথ্য প্রদান করব। শান্তির বিষয়টি সম্পূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত।
কমিটির সদস্য ও ঢাবির উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আলমোজাদ্দেদী আলফেছানী দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, সত্যানুসন্ধান কমিটির দায়িত্ব হচ্ছে এ ঘটনার কারা কারা জড়িত সেটি খুঁজে বের করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে জানানো। আমাদের কমিটির তদন্ত প্রতিবেদন লেখার কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। আমার ২১শে ফেব্রুয়ারির পর যেকোনো দিন এই প্রতিবেদন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে জমা দেবো। এরপর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সেটি দেখে সেখানে জড়িত কার বিরুদ্ধে কেমন শাস্তি তা নির্ধারণ করবে।
তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খানের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি সাড়া দেননি। যদিও সত্যানুসন্ধান কমিটি বলছে, এই প্রতিবেদন দেখে ভিসিই জড়িতদের বিরুদ্ধে কেমন শাস্তি হবে তা নির্ধারণ করতে পারবেন। প্রয়োজনে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম সিন্ডিকেট কিংবা এরকম অন্যান্য বড়ির সঙ্গে আলোচনাও করতে পারেন। তারপর জড়িতদের বিরুদ্ধে কেমন শাস্তি হবে তা চূড়ান্তভাবে জানিয়ে দেবেন।
প্রসঙ্গত, গত ৮ অক্টোবর এ কমিটি গঠন করা হয়। আইন বিশেষজ্ঞ ও আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কাজী মাহফুলুল হক সুপণকে এ কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছিল। কমিটির সদস্য হিসেবে ছিলেন আইন অনুষদের ভারপ্রাপ্ত ডিন অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ইকরামুল হক, ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক অধ্যাপক ড. নাদিয়া নেওয়াজ রিমি, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আলমোজাদ্দেদী আলফেছানী, শামসুন নাহার হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. নাসরিন সুলতানা সহকারী প্রক্টর শেরীন আমিন ভূঁইয়া। কমিটির সদস্য সচিব পদে আছেন ডেপুটি রেজিস্ট্রার (তদন্ত) শেখ আইয়ূব আলী।