Image description

জিয়াউদ্দিন চৌধুরী

প্রথম পর্ব

গত ডিসেম্বরে প্রায় ৩২ বছর পর পাকিস্তানে গেলাম। গেলাম লাহোর, ইসলামাবাদ, পেশোয়ার, ফয়সালাবাদ আর তক্ষশীলা। ১০ দিনে পাকিস্তান সম্পর্কে নতুন করে খুব বেশি জানা যায় না। যদিও পাকিস্তানের এই শহরগুলোর সঙ্গে আমি আমার ছাত্রজীবন থেকে পরিচিত।

লাহোরের পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি পড়াশোনা করেছি। ফাইন্যান্স সার্ভিস ও সিভিল সার্ভিস একাডেমিতে দুই বছর কাটিয়েছি। সে সময় ছিল অবিভক্ত পাকিস্তান আর আমার পরিচয় ছিল পূর্ব পাকিস্তানি হিসেবে। এরপর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ২০ বছর পর ১৯৯২–তে আমি গিয়েছিলাম। এবার গেলাম তিন দশক পর। এ সফর ছিল আমার পাকিস্তানি সতীর্থদের আমন্ত্রণে।

আমরা তৎকালীন সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তানে (সিএসপি) ১৯৬৮–তে যোগ দিয়েছিলাম। সে বছর যোগ দিয়েছিলাম ১০ জন পূর্ব পাকিস্তান থেকে আর ১০ জন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে। একই একাডেমিতে আমাদের সঙ্গে ছিলেন পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসের আরও ১৫ জন শিক্ষানবিশ। ৭ জন পূর্ব পাকিস্তান থেকে আর ৮ জন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে। আমরা পুরো এক বছর লাহোরের মাল রোডের ওপর অবস্থিত সিভিল সার্ভিস ট্রেনিং একাডেমিতে কাটিয়েছিলাম।

আমার পাকিস্তানি সতীর্থরা বহুবার চেষ্টা করেছেন এমন একটি পুনর্মিলনী, যাতে বাংলাদেশি–পাকিস্তানি মিলিয়ে সম্পূর্ণ ব্যাচ একসঙ্গে হতে পারে। এটা বাস্তবায়ন করতে অনেক সমস্যা ছিল। সুযোগ হলো আমলাতান্ত্রিক ঝঞ্জাট থেকে সবাই যখন মুক্ত হলেন সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর। তবে এখন আবার অনেকেই থাকেন বিদেশে। শেষ পর্যন্ত গত ডিসেম্বরে পুনর্মিলনীর জন্য আমরা অনেকেই সাড়া দিয়ে যোগ দিই।

এ প্রেক্ষাপটে ৩২ বছর পর পাকিস্তানে যাই। আমি এবার লাহোর গেলাম ওয়াশিংটন থেকে লন্ডন হয়ে। ফিরেও এলাম একই পথে। বাংলাদেশ–পাকিস্তানের মধ্যে সরাসরি বিমান চলাচল বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ২০১৮ সাল থেকে। তখন পর্যন্ত চালু হয়নি।

আমাদের পুনর্মিলনী অনুষ্ঠান হয়েছিল পাঁচ দিন ধরে। প্রধানত ভোজ সংবর্ধনা বা চা–চক্রের মাধ্যমে, যার মধ্যে থাকত স্মৃতিচারণা আর সতীর্থরা প্রাক্‌-চাকরিজীবনে দেশে বা বিদেশে কী কাজ করেছেন, সে নিয়ে আলাপ করে। প্রথম তিন দিন লাহোর এবং ফয়সালাবাদে এবং পরের দুদিন ইসলামাবাদে। লাহোর আমাদের প্রধান পুনর্মিলনী অনুষ্ঠান হয়েছিল সাবেক সিভিল সার্ভিস একাডেমির মূল ভবনে। সেটি এখন পাকিস্তান সরকারের রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন ও প্রধানমন্ত্রীর লাহোর কার্যালয়।

এই ভবনে আমাদের ক্লাস হতো, এখানেই আমাদের ডিরেক্টর ও তাঁর সহকারী ডিরেক্টররা অফিস করতেন। আমাদের ডাইনিং হল, লাউঞ্জ, পাঠাগার এখানেই ছিল। দুপাশে আরও দুটি শাখায় ছিল আমাদের থাকার জায়গা। আমরা ঘুরে ঘুরে সারা ভবন দেখলাম আর স্মৃতিচারণা করলাম। আনন্দময় সময় কাটালাম আমাদের সাবেক বাসস্থানে।

সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তানের সরকারি চাকরির মধ্যে এখনো শীর্ষ চাকরি হিসেবে গৃহীত। এখনো সারা পাকিস্তানে প্রতিযোগিতামূলক চাকরিতে সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তানের উত্তরসূরি পাকিস্তান অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস পরীক্ষায় বহু প্রতিযোগী যোগ দেন। চাকরিতে উত্তীর্ণ হয়ে আগের মতো মহকুমা বা জেলা প্রশাসক হিসেবে চাকরি শুরু করে পরে প্রাদেশিক সরকারে ঊর্ধ্বতন পদে যোগ দেন। আমলাতন্ত্র পাকিস্তানে মোটামুটি আগের মতোই শক্তিশালী।

গত ৫০ বছরে প্রতিটি রাজনৈতিক বা সামরিক সরকার তাদের ক্ষমতা ক্ষুণ্ন করার চেষ্টা করেছে। তবু আমলাদের ওপর নির্ভরতা কমেনি। কারণ, পাকিস্তানে আজও কোনো সত্যিকার গণতন্ত্রী সরকার কাজ করতে পারেনি।

আমলাদের ক্ষমতা ও দাপট আমি প্রত্যক্ষ করেছি এ সফরে বিশেষভাবে। আমার যে পাকিস্তানি সতীর্থ আমাদের পুনর্মিলনের সমন্বয় করেছিলেন, তিনি ছিলেন পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব। তিনি অবসরে গিয়েছেন ২০ বছর আগে। তবে বর্তমান সচিব থেকে শুরু করে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় অভিবাসন বিভাগ, কেন্দ্রীয় অনুসন্ধান বিভাগ, এমন কেন্দ্রীয় পুলিশের অধিকর্তাদের ওপর তাঁর বেশ প্রভাব ছিল।  

শুধু তিনি নন, পাকিস্তানের কেন্দ্রে বা প্রদেশে উচ্চ পদে থাকা আমার অন্য সতীর্থদের নেটওয়ার্ক খুব কম ছিল না। তাঁরা অবসরে গেলেও প্রয়োজনে কোনো সরকারি আমলাকে তাঁদের একটি ফোনে করা অনুরোধ আদেশের মতো পালিত হয়। আমি শুনেছি এ রকম নেটওয়ার্ক কাজ করে সামরিক বাহিনীতেও। আমার সতীর্থদের প্রভাবের কারণে হোক বা পাকিস্তানের ঐতিহাসিক শ্রেণিবিন্যাসের কারণে হোক, পাকিস্তানে যে সমাদর পেয়েছি তা অভাবনীয়।

সমাদরের সঙ্গে আর যা হলো, তা হচ্ছে পাকিস্তান সম্পর্কে আমার চক্ষু কর্ণের বিবাদ ভঞ্জন। আমি যুক্তরাষ্ট্রে থাকি অনেক বছর ধরে। পাকিস্তান সম্পর্কে খবরাখবর মোটামুটি পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমে পাই।

গত দুই দশক কি তার কিছু ওপর থেকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রচার হয়েছে কীভাবে পাকিস্তান ক্রমাগতভাবে ইসলামি রাজনৈতিক শক্তির দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছে। এমনকি ইমরান খানের পূর্ববর্তী সরকারও তাদের সামলাতে পারত না। গত দুই দশকে ইসলামি দলগুলোর প্রভাবে দেশটি প্রায় ধর্মীয় রাষ্ট্রে পরিণত হতে চলেছে। এর প্রধান কারণ, পাকিস্তান তিন দশক আগে আফগানিস্তান যুদ্ধে মুজাহিদিন সৃষ্টি করেছিল পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর সহায়তায় এবং যুক্তরাষ্ট্রের অর্থানুকূল্যে। কিন্তু পরে আফগানিস্তান থেকে রাশিয়ানরা সরে যাওয়ার পর এই মুজাহিদিনরা তালেবান বলে এক নতুন রাজনৈতিক দল সৃষ্টি করে। তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল আফগানিস্তানে একটি শরিয়াভিত্তিক দেশ স্থাপন করা। তারা তা করতে সক্ষম হয়েছিল।

কিন্তু এই তালেবান সরকার পরে পাকিস্তানের ভেতরেও একটি পাকিস্তানি শাখা তৈরি করে শরিয়াভিত্তিক সরকার স্থাপনের জন্য। তারা পাকিস্তানের উত্তরাঞ্চলে সামরিক অভিযান চালাতে আরম্ভ করে। এদিকে পাকিস্তান সরকার যখন এই ধর্মভিত্তিক শক্তিকে উৎখাত করতে পাল্টা অভিযান চালায়, তখন পাকিস্তানের রাজনীতিতেও এর প্রভাব পড়ে।

রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে ঐক্যের অভাব পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকে ছিল। এর সুযোগ নেয় পাকিস্তানের শক্তিশালী সেনাবাহিনী। ফলে রাজনৈতিক নেতারা ক্ষমতায় থাকতে সেনাবাহিনীর সমর্থন নিতে থাকেন। এই রাজনৈতিক দেউলিয়াপনার জন্য কখনোই কোনো রাজনৈতিক নেতা বেশি দিন ক্ষমতায় থাকতে পারেননি। যেমন হয়েছিল কয়েক বছর আগে ক্ষমতায় আসা বিপুলভাবে জনপ্রিয় ইমরান খান।

এই ইমরান খানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) ১৯৯৬ সালে জন্ম নিয়েছিল। কিন্তু জন্মলগ্ন থেকে দলটি বিশেষ সুবিধা করতে পারেনি। দলটি পারভেজ মোশাররফের সামরিক সরকারকে সমর্থন দিয়েছিল। কিন্তু পরে সমর্থন দেয় মোশাররফের বিরুদ্ধের রাজনৈতিক শক্তিকে। ইমরান খান নিজে জনপ্রিয় হলেও তাঁর দল নির্বাচনে প্রথম কয়েক বছর সুবিধা করতে পারেনি।

কিন্তু পরে সামরিক বাহিনীর পরোক্ষ সমর্থনে তাঁর দল ২০১৮ সালে সাধারণ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও এককভাবে সরকার গঠন করতে না পেরে আরও কয়েকটি দলের সঙ্গে কোয়ালিশন করে সরকার গঠন করে। কিন্তু তিন বছরের মাথায় সামরিক শক্তির সঙ্গে তাঁর মতবিরোধ হলে ২০২২ সালে সামরিক বাহিনীর গুটি চালনায় ইমরান খানের কোয়ালিশন ভেঙে যায় এবং তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। কিন্তু পদত্যাগই পরের বিপদ ডেকে আনে।

পরবর্তী অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সামরিক শক্তির সহায়তায় ইমরান খানের বিরুদ্ধে মামলা করে তাঁকে কারারুদ্ধ করে। ইমরান খান এখনো জেলে। তাঁর দল কয়েকবার আন্দোলন করেও তাঁকে কারাগার থেকে বের করতে পারেনি। পাকিস্তানের উচ্চ আদালত তাঁকে মামলা থেকে এখনো রেহাই দেননি।

আমি পাকিস্তানে যাওয়ার মাসখানেক আগে ইমরান খানের দল এক বড় ধরনের আন্দোলন করে ইসলামাবাদে। কিন্তু বর্তমান সরকার এবং সামরিক বাহিনী তা রুখে দিতে সক্ষম হয়। পাকিস্তানে থাকার সময় শুনলাম, পাকিস্তানের প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি আর ইমরান খানের দল পিটিআইয়ের মধ্যে বোঝাপড়ার চেষ্টা হচ্ছে।

মূল বিষয়, ইমরান খানের দল আন্দোলন থেকে বিরত থাকবে। বিনিময়ে প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি ইমরান খানের দলকে নির্বাচনে আসতে দেবে। হয়তো তাঁর বিরুদ্ধে মামলাগুলোও স্থগিত থাকবে। সোজা কথায়, পাকিস্তানের রাজনীতি এখনো সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে।

  • জিয়াউদ্দিন চৌধুরী সিভিল সার্ভিসের সাবেক কর্মকর্তা

(লেখাটির দ্বিতীয় পর্ব আগামীকাল প্রকাশিত হবে)