 
              হাসিনার দেড় দশকের শাসনে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ইসলামোফোবিয়া ভয়ংকর মাত্রায় রূপ নিয়েছিল। টুপি কিংবা হিজাব পরার কারণে বহু শিক্ষার্থী শারীরিক ও মানসিক নিপীড়নের শিকার হয়েছে। দাড়ি রাখা, নামাজ পড়া কিংবা প্রাথমিকপর্যায়ে মাদরাসায় পড়েছেন এমন শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে নানাভাবে হেনস্তা করা হয়েছে। বহু শিক্ষার্থীকে ধর্ম পালন করার অপরাধে শিক্ষকরা কম নম্বর দিয়েছেন এমন অভিযোগের শেষ নেই।
হাসিনা আমলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ধর্মচর্চার সুযোগ পর্যন্ত সীমিত করা হয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইফতার মাহফিল কিংবা কোরআন তিলওয়াতের মতো কর্মসূচি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অনুমতি দেয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা রাষ্ট্রের উচ্চপর্যায় থেকে নির্দেশনা পেয়ে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছেন, এমনটি নয়। তারা নিজেরাই অতি-উৎসাহের সঙ্গে এসব সিদ্ধান্ত নিতেন। শিক্ষার্থীদের এ ধরনের মানসিক নিপীড়নের সঙ্গে শুধু চিহ্নিত আওয়ামী শিক্ষকরা এমন আচরণ করছেন, তা নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের বামপন্থি শিক্ষকরা একই কাজ করেছেন।
বাংলাদেশের বামপন্থিদের মনের গভীরে ইসলামোফোবিয়ার অসুখ রয়েছে। পুরো দুনিয়ার বামপন্থিরা যখন নাগরিকের ধর্মীয় ও নাগরিক অধিকার রক্ষার জন্য সোচ্চার, তখন বাংলাদেশের বামপন্থিরা ধর্মীয় অধিকারকে শুধু অস্বীকার করছে না, একে দেখছে প্রগতিশীলতার বিরুদ্ধ হিসেবে। নিজেদের প্রগতিশীল প্রমাণ করতে অন্যের ব্যক্তি অধিকারের সীমা অতিক্রম করছে। এমনকি শিক্ষার্থীরা কী ধরনের পোশাক পরবেন, তা নিয়েও তারা বিরূপ মন্তব্য করেছে। বামপন্থি শিক্ষার্থী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষকদের মধ্যে হিজাবফোবিয়া এখন ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।
সম্প্রতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে হিজাব পরা নির্বাচিত শিক্ষার্থী প্রতিনিধিদের একটি ছবি একজন শিক্ষক তার ফেসবুকে শেয়ার করে নিজে ছোট পোশাক ও মদের বোতল হাতে ক্লাসে আসার ঘোষণা দিয়েছিলেন। এ নিয়ে ব্যাপক প্রতিবাদ ও বিক্ষোভের মুখে এই শিক্ষক তার এই লেখার জন্য ক্ষমা চেয়েছেন। তিনি বলেছেন, হতাশাগ্রস্ত হয়ে ঝোঁকের মুখে তিনি এমন মন্তব্য করেছেন। যেহেতু এই শিক্ষক ক্ষমা চেয়েছেন এবং বলেছেন, ‘তিনি পোশাকের কারণে কাউকে ছোট বা বড় করে দেখেননি।’ তাকে নিয়ে আমরা এখন আলোচনা করতে চাই না। তিনি যদি মদিরাচ্ছন্ন হয়ে অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায় এমন মন্তব্য করে থাকেন, তাতেও বাংলাদেশের বামপন্থিদের মনের গভীরের অসুখের প্রতিফলন ঘটিয়েছেন মাত্র। পশ্চিমা কোনো দেশের শিক্ষকও আন্ডারওয়্যার পরে মদের গ্লাস হাতে শিক্ষার্থীদের সামনে যাওয়ার কথা কল্পনাও করতে পারেন না। অনেক পশ্চিমা দেশে প্রকাশ্য মদপান তাদের মূল্যবোধে গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু আমাদের দেশে বাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের কাছে এমন দৃষ্টিভঙ্গি প্রগতিশীলতার লক্ষণ বলে বিবেচনা করা হয়।
ডাকসু নির্বাচনের সময় হিজাব পরা এক শিক্ষার্থীর পোস্টারে তার ছবি বিকৃত করা হয়েছিল। এই কাজটিও করেছিল প্রগতিশীলরা। এই শিক্ষার্থী সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে যখন ডাকসুর প্রতিনিধি নির্বাচিত হন, তখন সিনেট ভবনে ফল ঘোষণার পর হিজাব হিজাব বলে স্লোগান উঠেছিল। কারণ এই শিক্ষার্থীর হিজাব পরা ছবি বিকৃত করা হয়েছিল। তার পক্ষে সমর্থন জানাতে এই স্লোগান দেওয়া হয়। বামপন্থিরা তখন বলেছিল, ডাকসুর নির্বাচিত প্রতিনিধিরা বিশ্ববিদ্যালয়ে হিজাব পরা বাধ্যতামূলক করবেন এ কারণে এই স্লোগান দেওয়া হয়েছে। মজার ব্যাপার, ভারতের একাধিক গণমাধ্যমে বামপন্থিদের এই বয়ান প্রচার করা হয়েছিল।
হিজাবফোবিয়াকে গবেষকরা ইসলামোফোবিয়ার একটি অংশ বলে মনে করেন। যারা হিজাব পরেন, তারা তাদের নিজস্ব ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও ব্যক্তিগত পরিচয়ের অংশ বলে মনে করেন। যখন কোনো ব্যক্তি কী পরবেন বা পরবেন না, তা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়, তাকে পোশাকের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখতে হবে। সাধারণভাবে প্রত্যেক ব্যক্তির নিজের পোশাক সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা ও অধিকারই পোশাকের স্বাধীনতা। কেউ চাইলেই হিজাব পরতে পারেন, আবার না পরার অধিকারও রাখেন এটাই মূলনীতি। হিজাবফোবিয়া হলো এই স্বাধীনতার পরিপন্থী এক সামাজিক প্রবণতা, যা নির্দিষ্ট ধর্ম বা সংস্কৃতিকে টার্গেট করে। এ কথাও মনে রাখতে হবে, যদি কোনো ইসলামপন্থি দাবিদার ব্যক্তি বা সংগঠন শাড়ি, টিপ কিংবা পশ্চিমা ধাঁচের পোশাক পরার জন্য বিরূপ মন্তব্য করেন, সেটিও পোশাকের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ ও সমানভাবে নিন্দনীয়।
 
বাংলাদেশের বামপন্থিদের সমস্যা হচ্ছে, তারা পোশাকের স্বাধীনতা চান, তবে তারা যে ধরনের পোশাক পছন্দ করেন, শুধু সে ধরনের পোশাকের ক্ষেত্রে। ইসলামের প্রতীক বহন করে বা ধর্মীয় মূল্যবোধের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ পোশাকের ব্যাপারে তাদের উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার শেষ নেই। এই দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বিশ্বাস ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে লড়াই করা যেন এই দেশে বামপন্থার একটি অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই লড়াইয়ের একটি রূপ আমরা দেখেছিলাম শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ গঠনের মধ্য দিয়ে। যেখান থেকে নবী-রাসুলদের নোংরাভাবে গালি দিয়ে ইসলামের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিশ্বাসের ওপর আঘাত হানা হয়েছিল। হাসিনার শাসনে যে সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদ কায়েম হয়েছিল, তাতে প্রধান ভূমিকা পালন করেছিল বামপন্থিরা। হাসিনা-পরবর্তী সময়ে হিজাব কিংবা ইসলামোফোবিয়ার যেসব ঘটনার সঙ্গে বামপন্থি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, লেখক ও সাংবাদিকদের সমর্থন আমরা দেখছি, এরা কোনো না কোনোভাবে শাহবাগের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ডান বা বাম সেক্যুলার কিংবা ধর্মভীরু সব ধরনের মানুষ অংশ নিয়েছিল। বামপন্থিদের একটি অংশ এই আন্দোলনে সামনের সারিতে ছিলেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষককে নিয়ে তীব্র সমালোচনা হচ্ছে, তিনিও সে সময় অভ্যুত্থানের পক্ষে ভূমিকা রেখেছিলেন। অনেকে আশা করেছিল, অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশে একটি বহুমতের-সহনশীল সমাজ গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হবে। যেহেতু এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা, ফলে এমন আবহ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে গড়ে উঠবে। কিন্তু ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা থেকে প্রমাণ হচ্ছে, সমাজে বিভেদ এবং বিভাজন সৃষ্টির যে চেষ্টা বামপন্থিরা বছরের পর বছর ধরে করে গেছে, সেই অবস্থান থেকে সরে আসার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা তাদের নেই।
বামপন্থিরা এ দেশের সমাজ ও রাজনৈতিক বাস্তবতা থেকে এতটাই বিচ্ছিন্ন, সাধারণ মানুষের আকাঙ্ক্ষা বোঝার মতো সক্ষমতা তারা হারিয়ে ফেলেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক ঘটনা তার বড় প্রমাণ। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যখন মাদকাসক্ত এবং ভবঘুরেদের এই এলাকা থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও নির্বাচিত ছাত্র প্রতিনিধিরা, তখন বামপন্থি ছাত্র সংগঠনগুলো এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে। ছোট ছোট টং দোকানের মাধ্যমে যে মাদক ব্যবসার সিন্ডিকেট বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় গড়ে উঠেছে, তা রক্ষা করতে তারা মরিয়া। এগুলো তারা রাখতে চায় গরিব মানুষের রুটি-রুজি রক্ষার নামে।
বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ভবঘুরে ও মাদকমুক্ত রাখার এই তৎপরতার প্রতি সাধারণ শিক্ষার্থী, বিশেষ করে নারী শিক্ষার্থীদের জোরালো সমর্থন আছে। কারণ তারা ভবঘুরে ও বহিরাগতদের ধারা নানাভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের এই তৎপরতার সঙ্গে ডাকসুর একজন নির্বাচিত প্রতিনিধি ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিক্ষার্থী সর্বমিত্র চাকমা জোরালো ভূমিকা রাখছেন। বামপন্থিরা এখন ভিন্ন ধর্ম ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর এই শিক্ষার্থী কেন ইসলামপন্থি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মিলে কাজ করছেন, এ জন্য তিনি এখন বামপন্থিদের টার্গেটে পরিণত হয়েছেন। তিনি বলছেন, বহিরাগত ও মাদকাসক্ত ব্যক্তিরা নারী শিক্ষার্থীদের হয়রানি করছে। তার ভিডিও ফুটেজ আছে। কিন্তু এরপরও তার ওপর বর্ণবাদী আক্রমণ চলছে। তাকে শিবিরের ভাড়াটিয়া হিসেবে উল্লেখ করে হেয় করা হচ্ছে। সর্বমিত্রের ওপর তাদের ক্ষোভ শুধু মাদক বা ভবঘুরেদের সরিয়ে দেওয়ার জন্য নয়, ভিন্ন ধর্মের ও মতের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তিনি যে ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন, সেটি মেনে নিতে পারছে না বাম ছাত্র সংগঠনগুলো।
বাস্তবতা হচ্ছে, অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে বামপন্থিদের বিভেদ ও বিভাজনের রাজনীতির পুরোনো কৌশল এখন অকার্যকর হয়ে পড়ছে। এই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ শুধু একজন নিপীড়ক শাসককে উৎখাত করেনি, তাদের আত্মপরিচয় ফিরে পেয়েছে। হাসিনার দুঃশাসনে রাজনৈতিক নিপীড়নের পাশাপাশি সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের ওপর আঘাত হানা হয়েছিল। শুধু মুসলিম চিহ্ন ধারণ করার জন্য তাদের নানাভাবে অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল। যেমনটা হতে হয়েছিল বসনিয়ার মুসলমানদের, এখনো হতে হচ্ছে ভারতের মুসলমানদের।
এই দেশের মানুষ রক্ত দিয়ে হাসিনাকে উৎখাত করে তার মুসলিম জাতিসত্তার পরিচয় ফিরে পেয়েছে। মানুষ বুঝে গেছে, এই দেশের একজন নাগরিক হিসেবে মাথা উঁচু করে মর্যাদার সঙ্গে বেঁচে থাকতে হলে তার মুসলিম জাতিসত্তার পরিচয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। হাসিনার দেড় দশকের দুঃশাসনে সমাজের এই রূপান্তর কিংবা মানুষের আত্মপরিচয় খুঁজে পাওয়ার এই সংগ্রাম অনুধাবন করতে পারেনি বামপন্থিরা। তারা ছিল এ দেশের ভারতপন্থি সাংস্কৃতিক এলিটদের রাজনৈতিক হাতিয়ার মাত্র। বাংলাদেশের ইসলামফোবিক বামপন্থিরা যে হাসিনার সাংস্কৃতিক লাঠিয়ালের ভূমিকা পালন করেছে, সেটি এই দেশের মানুষ ভালোভাবে বুঝতে পারছেন। এই বিকৃত চিন্তাধারা নিয়ে দেশের মূলধারার রাজনীতিতে বামপন্থিরা আর কখনো প্রাসঙ্গিক হতে পারবে না, বরং গণপ্রতিরোধের মুখে পড়তে হবে।
লেখক: সহযোগী সম্পাদক, আমার দেশ
 
       
                 
                
 
                                                  
                                                  
                                                  
                                                  
                                                 