
১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বিশ্বব্যাপী মার্কিন সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র জামানা শুরু হয়েছে। এই শতাব্দীতে চীনের বিস্ময়কর অর্থনৈতিক উত্থান ঘটলে মনে করা হচ্ছিল, আমরা আবার বহুপক্ষীয় বিশ্বব্যবস্থার দিকে যাত্রা শুরু করেছি।
তবে সে রকম বিশ্বব্যবস্থা নির্মাণে যে এখনো অনেক দেরি আছে, সেটি সব আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একতরফা ইরান আক্রমণের মধ্য দিয়ে পুনর্বার প্রমাণ হলো। প্রেসিডেন্ট বুশ ২০০৩ সালে সম্পূর্ণ মিথ্যা গোয়েন্দা তথ্য ব্যবহার করে ইরাক আক্রমণের পক্ষে যুক্তি খাড়া করেছিলেন। সেই মিথ্যা পরবর্তী সময়ে ধরাও পড়েছিল।
কিন্তু ততদিনে প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার ইরাকি নারী, পুরুষ ও শিশুকে হত্যা এবং দেশটিতে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা দেশগুলো। সেই অপরাধের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে জাতিসংঘ কিংবা অন্য কোনো আন্তর্জাতিক ফোরামে কোনোরকম জবাবদিহি করতে হয়নি। এবার অবশ্য ট্রাম্প একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সামরিক আগ্রাসন চালানোর জন্য কোনো যুক্তি দেখানোর প্রয়োজনই বোধ করেননি; বরং তারই গোয়েন্দাপ্রধান তুলসী গ্যাবার্ডের কংগ্রেসে দেওয়া বক্তব্যকে ‘তিনি কিছু জানেন না’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন।
তুলসী গ্যাবার্ড বলেছিলেন, ‘ইরানের কাছে কোনো পারমাণবিক বোমা নেই এবং আয়াতুল্লাহ খামেনি বোমা তৈরির কোনো নির্দেশ প্রদান করেননি।’ প্রচণ্ড দাম্ভিক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজেকে আসলে সারা দুনিয়ায় প্রভু মনে করতে আরম্ভ করেছেন।
আমেরিকা বর্তমানে বিশ্বের যে এক নম্বর সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তি, তা নিয়ে বিতর্কের কোনো অবকাশ নেই। অনেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বর্তমান বিশ্বব্যবস্থাকে মার্কিন সাম্রাজ্যের অধীন এবং সেই সাম্রাজ্যকে মানব ইতিহাসের সর্ববৃহৎ বলেও মনে করেন। দেশটির ভয়ংকর শক্তিমত্তা এবং বিশ্বব্যাপী প্রভাব নিয়ে সন্দেহ পোষণ করার মতো মূর্খ আমি নই; কিন্তু আমার তর্ক হলো, সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখতে হলে সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তির সঙ্গে নৈতিক বল থাকাও আবশ্যক। নৈতিকতা ছাড়া কোনো সভ্যতা টিকে থাকে না। আর এখানেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান দুর্বলতা দিন দিন প্রকট হয়ে উঠছে। কোনো রাষ্ট্র যখন নৈতিকতা-বিবর্জিত হয়ে কেবল পেশিশক্তির ওপর নির্ভর করে, তখন সেটি এমন এক আন্তর্জাতিক গুন্ডায় (International Bully) পরিণত হয়, যাকে পৃথিবীর অন্যান্য রাষ্ট্র সম্মানের বদলে ঘৃণা করে।
এসব রাষ্ট্রের গুন্ডামি যে দীর্ঘস্থায়ী হয় না, গত শতাব্দীতে নাৎসি জার্মানি তারই প্রকৃষ্ট উদাহরণ। হিটলারের ‘থার্ড রাইখ’ প্রচণ্ড শক্তিধর ও সমৃদ্ধিশালী হয়েও ভেঙে পড়তে সময় লাগেনি, যদিও হিটলার মনে করেছিলেন, তার ‘থার্ড রাইখ’ হাজার বছর টিকে থাকবে। প্রাচীনকালে রোমান সাম্রাজ্যের পতনের মূলেও ছিল নৈতিক অবক্ষয়। বর্তমান শতাব্দীতে মধ্যপ্রাচ্যের এক ঔপনিবেশিক ও বর্বর রাষ্ট্র ইসরাইলের প্রতি অবিশ্বাস্য মাত্রায় অযৌক্তিক সমর্থন প্রদানের নীতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নৈতিক ও আইনগত ভিতকে একেবারে নড়িয়ে দিয়েছে।
গাজায় অব্যাহত গণহত্যা, বিশেষ করে হাজার হাজার নিষ্পাপ শিশুকে টার্গেট করে নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালানো এবং অবরোধের মাধ্যমে ২০ লক্ষাধিক মানুষকে ক্রমেই অনাহারে মৃত্যুমুখে ঠেলে দেওয়ার যে অপরাধ বাইডেন ও ট্রাম্প প্রশাসন দানব নেতানিয়াহুর সঙ্গে মিলে করেছে, তার খেসারত ওয়াশিংটনকে অবশ্যই দিতে হবে। মার্কিন রাজনীতিবিদরা যেভাবে ইসরাইলের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেন, তাকে মোহাচ্ছন্ন বললেও বোধহয় কম হয়ে যায়। এই যুদ্ধবাজ দেশটিকে অন্ধ সমর্থনের পেছনে মার্কিন সিনেটর ও কংগ্রেসম্যানদের যুক্তির বহর দেখলে তাদের উন্মাদ, মূর্খ ও ধর্মান্ধ বলা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক।
টেড ক্রুজ যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস রাজ্যের রিপাবলিকান দলীয় একজন সিনেটর। তিনি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও ইসরাইলের কট্টর সমর্থক। সম্প্রতি টাকার কার্লসন নামে রিপাবলিকান সমর্থক এক প্রখ্যাত সাংবাদিকের সঙ্গে তিনি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। দুই ঘণ্টাব্যাপী সাক্ষাৎকারটি পাঠকরা ইউটিউবে দেখতে পারেন। টেড ক্রুজ ইসরাইলের পক্ষে ওকালতি করতে গিয়ে বাইবেল টেনে এনে দাবি করেছেন, সেই ধর্মগ্রন্থে নাকি খ্রিষ্টানদের জন্য সর্বাবস্থায় ইসরাইলকে সমর্থন করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। প্রথম কথা হলো, ফিলিস্তিনিদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করে ইসরাইল রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে ১৯৪৮ সালে। আর বাইবেল এসেছে তার প্রায় দুই হাজার বছর আগে।
কাজেই বাইবেলে ইসরাইল নামক রাষ্ট্রের উল্লেখ থাকার কোনো সুযোগ নেই। দ্বিতীয়ত, বাইবেলে যে ইসরাইলের প্রসঙ্গ এসেছে, তিনি একজন মানুষ, কোনো রাষ্ট্র নয়। আমি বাইবেল যতটা পড়েছি তাতে জেনেছি, ইহুদিদের নবী জ্যাকবের অপর নাম ইসরাইল। জেনেসিসে তাকে আইজাক ও রেবেকার ছেলে বলা হয়েছে। মুসলমানরা আইজাক ও জ্যাকবকে যথাক্রমে নবী হজরত ইসহাক (আ. সা.) এবং নবী হজরত ইয়াকুব (আ. সা.) নামে জানে। আমার জানায় কোনোরকম ভুল হয়ে থাকলে খ্রিষ্টধর্ম সম্পর্কে বিষদ জ্ঞান রাখা পাঠক সংশোধন করতে পারেন।
একে তো সিনেটর টেড ক্রুজ এতটাই মূর্খ যে নিজেকে কট্টর খ্রিষ্টান দাবি করলেও বাইবেল সম্পর্কেই তিনি কিছু জানেন না; তদুপরি একবিংশ শতাব্দীর রাজনৈতিক বিতর্কে অহেতুক বাইবেল টেনে এনে নিজেকে একজন ধর্মীয় উন্মাদ (Religious Fanatic) রূপে প্রমাণ করেছেন। মার্কিন সিনেটরের মূর্খতার এখানেই শেষ নয়। সাক্ষাৎকারের একপর্যায়ে তিনি যখন ইরানকে ধ্বংস করে দেওয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করছিলেন, তখন দৃশ্যত বিরক্ত টাকার কার্লসন ইরানের জনসংখ্যা ও জাতিগত বৈচিত্র্য সম্পর্কে তার জানাশোনা কেমন জানতে চাইলে মার্কিন সিনেটর বোকার মতো কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তার অজ্ঞতা স্বীকার করেন। তিনি তার বিস্ময়কর অজ্ঞতার পক্ষে যুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করে বলেন, একটি দেশের জনসংখ্যা জানা তার কাজ নয়! এই টেড ক্রুজ আবার ২০১৬ সালে রিপাবলিকান দলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী নির্বাচনের প্রাইমারিতে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হয়েছিলেন। এই হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইহুদিবাদী প্রশাসনের জ্ঞানের নমুনা। ক্ষমতার দম্ভে তারা জানে শুধু দুনিয়াব্যাপী ফ্যাসাদ তৈরি করতে।
মুসলমান দেশের কোনো নেতা যদি সিনেটর ক্রুজের মতো এভাবে ধর্মগ্রন্থের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে রাজনৈতিক তর্কে জিততে চাইতেন, তাহলে তাকে ও মুসলমানদের পশ্চিমারা অবশ্যই অশিক্ষিত, মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক, ইসলামিস্ট, ফ্যানাটিক ইত্যাদি ইত্যাদি বিশেষণ দিয়ে তিরস্কারের বন্যা বইয়ে দিত। সম্ভবত ইতিহাস সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণেই মার্কিনিরা জানে না, অতীতে তাদের মতো এমন অনেক সাম্রাজ্যবাদী শক্তির উত্থান ও পতন ঘটেছে।
ইরানের বিরুদ্ধে যৌথ আক্রমণের সাফল্যে উল্লসিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যে ভাষায় যুদ্ধাপরাধী নেতানিয়াহু ও ইসরাইলের প্রশংসা করছেন, তাতে মনে হতে পারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নত মস্তকে ইসরাইলের প্রভুত্ব মেনে নিয়েছে। এখানে উল্লেখ্য, ইরান পরমাণু অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি স্বাক্ষরকারী একটি রাষ্ট্র এবং আইএইএ’র পরিদর্শকরা নিয়মিত ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো পরিদর্শন করে থাকেন। আন্তর্জাতিক সংস্থাটির ডিরেক্টর জেনারেল রাফায়েল গ্রোসি তার সর্বশেষ প্রতিবেদনে জানিয়েছেন, ইরান পারমাণবিক বোমা তৈরির চেষ্টা করছে, এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
আগেই বলেছি, একই কথা খোদ যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তাপ্রধান তুলসি গাবার্ডও বলেছেন। একমাত্র যুদ্ধাপরাধী নেতানিয়াহু বলে চলেছেন, ইরান কয়েক সপ্তাহের মধ্যে পরমাণু বোমা বানিয়ে ফেলবে এবং সেটি রুখতেই নাকি ইসরাইল বিনা উসকানিতে কোনো যুদ্ধ ঘোষণা ছাড়াই ইরানে সর্বাত্মক হামলা শুরু করেছে। প্রমাণিত মিথ্যাবাদী নেতানিয়াহু ইরান সম্পর্কে এই মিথ্যা প্রচারণা সেই ১৯৯৫ সাল থেকেই চালাচ্ছেন। এই দানব নেতানিয়াহুর উসকানিতেই গণবিধ্বংসী অস্ত্রের ভুয়া অভিযোগ তুলে বুশ ও ব্লেয়ার জুটি ২০০৩ সালে ইরাক আক্রমণ করেছিলেন। ইতিহাস থেকে কোনো শিক্ষা না নিয়ে এবং নিরাপত্তাপ্রধানের অভিমতকে উপেক্ষা করে ইহুদিবাদী মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প গণহত্যাকারী ও যুদ্ধাপরাধী নেতানিয়াহুর সুরেই বক্তব্য দিয়েছেন। কোনোরকম কূটনৈতিক শিষ্টাচারের তোয়াক্কা না করে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইরানের বিজ্ঞানী, সামরিক কর্মকর্তা ও বেসামরিক নাগরিকদের ইসরাইল কর্তৃক হত্যায় উল্লাস প্রকাশ করেছেন এবং ইরানের ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনিকে সরাসরি হত্যার হুমকি দিয়েছেন।
ট্রাম্পের হঠকারিতার এখানেই শেষ নয়। তিনি ইরানকে বিনা শর্তে আত্মসমর্পণের জন্যও আল্টিমেটাম দিয়েছেন। ইরানে সরাসরি আক্রমণ চালাতে গিয়ে ট্রাম্প যে শঠতার পরিচয় দিয়েছেন, তাতে করে ভবিষ্যতে আর কোনো দেশ মার্কিনিদের কোনো বিষয়ে বিশ্বাস করবে না। ট্রাম্প প্রথমে ইরানের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আলোচনা চলমান থাকা অবস্থায় ইসরাইলকে ইরান আক্রমণের সবুজ সংকেত দিয়েছেন এবং তারপর যুদ্ধে সরাসরি জড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য দুই সপ্তাহ বিলম্বের কথা বলে দুই দিনের মধ্যে ইরানে বোমা বর্ষণ করেছেন। এই শঠতার মাধ্যমে ট্রাম্প নিজেকে কেবল নেতানিয়াহুর মতো মিথ্যাবাদী প্রমাণ করেননি, একই সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাপুরুষতারও প্রমাণ দিয়েছেন। অতীতের সম্রাটরা হয়তো অত্যাচারী ছিলেন, কিন্তু শত্রুর সঙ্গে তারা বীরোচিত আচরণ করতেন। তারা শৃগালের মতো ধূর্ত না হয়ে সিংহের মতো সাহসী হতে চাইতেন। ইহুদিদের ইতিহাস নিয়ে দুই মুসলমান সুলতানের মহানুভবতার গল্প বলা এখানে প্রাসঙ্গিক মনে করছি।
১৪৯২ খ্রিষ্টাব্দে স্পেনের রাজা ফার্দিনান্দ ও রানি ইসাবেলা আলহামরা অধ্যাদেশ (The Alhambra Decree) জারি করে সমস্ত ইহুদিদের হয় ধর্মান্তরিত হয়ে খ্রিষ্টান বনে যেতে, অথবা দেশত্যাগ করতে নির্দেশ দেন। ওই বছর জুলাই মাসের মধ্যে রাজকীয় ফরমান মান্য করার সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হলে লক্ষাধিক ইহুদি ধর্ম ত্যাগের পরিবর্তে নির্বাসনে যেতে বাধ্য হয়। পাঠক কি জানেন, কোন দুটি দেশ সেদিন ইহুদিদের আশ্রয় দিয়ে জীবন ও ধর্ম বাঁচিয়েছিল? না, কোনো খ্রিষ্টান ইউরোপীয় দেশ তাদের আশ্রয় দেয়নি। বর্তমান বিশ্বে ইহুদিবাদের কট্টর সমর্থক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তো তখন জন্মই হয়নি। সেই সময়কার প্রতাপশালী দুই মুসলমান দেশের মহৎ শাসকরা স্পেনের ইহুদিদের চরম দুর্দিনে তাদের রক্ষা করতে এগিয়ে এসেছিলেন—প্রথম শাসক তুরস্কের ওসমান সাম্রাজ্যের (Ottoman) সুলতান বায়েজিদ-২ এবং দ্বিতীয় শাসক পারস্যের সুলতান ইয়াকুব।
পারস্যের এই সুলতান তুর্কি গোত্রীয় আক কোয়ুনলু (Ak Qoyunlu) বংশের ছিলেন। আক কোয়ুনলু বংশের শাসনের পতনের পরই পারস্যের বিখ্যাত সাফাভিদ সাম্রাজ্যের (Safavid Dynasty) গোড়াপত্তন ঘটে। প্রথমে সম্রাট সাইরাস দ্য গ্রেট এবং পরে সুলতান ইয়াকুবের মহানুভবতার ফলেই আজকের শিয়া ইরানেও প্রায় ২০ হাজার ইহুদি ধর্মাবলম্বী বসবাস করে থাকে। অপরদিকে সুন্নি তুরস্কেও ইহুদিদের সংখ্যা প্রায় ১৫ হাজার। পশ্চিমা মিডিয়া ও রাজনীতিবিদরা যতই তথাকথিত জুডো-খ্রিষ্টান সভ্যতার ডঙ্কা বাজান না কেন, প্রকৃত ইতিহাস হলো যিশুখ্রিষ্টের জন্ম থেকে বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত খ্রিষ্টান ও ইহুদিরা একে অপরকে অনবরত সংহার করেছে।
তাদের মধ্যে কখনো সৌহার্দ্যমূলক সম্পর্ক ছিল না। স্বয়ং যিশুখ্রিষ্টকে ধর্মদ্রোহী আখ্যা দিয়ে ইহুদিরাই ক্রুশবিদ্ধ করেছিল। ইতিহাস-অসচেতন পশ্চিমা দেশের খ্রিষ্টানরা শুধু তাদের ভেতরে প্রোথিত ইসলামবিদ্বেষের কারণে আজ জায়নিস্ট ইসরাইলের সব অপকর্মের অন্ধ সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। এসব খ্রিষ্টান ইউরোপীয় দেশ হাজার বছর ধরে ইহুদিদের ওপর নির্যাতন চালানোর যে দায় সেটি মুসলমানদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে একটি বর্ণবাদী ও ঔপনিবেশিক ইহুদি রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছে। মুসলমানদের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে কিছু কথা বলে আজকের মন্তব্য প্রতিবেদন শেষ করব।
সাম্প্রতিক এক বক্তৃতায় আয়াতুল্লাহ খামেনি মার্কিন প্রেসিডেন্টকে পারস্য ও মুসলমানদের ইতিহাস পড়ার পরামর্শ দিয়েছেন। আসলে ইতিহাস পাঠের এই পরামর্শ কেবল মার্কিনিদের নয়, আরব বিশ্বের জন্যও সমভাবে প্রযোজ্য। বর্তমান আরব শাসকদের নতজানু আচরণ দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন যে, খালিদ বিন ওয়ালিদ, উবাইদাহ ইবনে জাররাহ, আমর ইবনে আল-আস এবং সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাসের মতো বীরেরা তাদের পূর্বপুরুষ ছিলেন। কারবালা প্রান্তরে পরাজয় জেনেও হজরত হোসেন (রা. আ.) জালিম ইয়াজিদের কাছে আত্মসমর্পণ করেননি। যুগ অবশ্যই পাল্টেছে, কিন্তু তাই বলে একটি জাতির আত্মাভিমান এভাবে লোপ পেতে দেখলে করুণা হয়।
বিলাসব্যসনে মত্ত আরব শাসকরা ইসরাইল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনুকম্পা নিয়ে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার নীতি গ্রহণ করেছেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যেও আগের ঈমানি শক্তি ও শৌর্যবীর্যের অবসান ঘটেছে। মার্কিন মদতে উন্মত্ত হয়ে ওঠা ইসরাইল একের পর এক মুসলমান দেশে আক্রমণ ও গণহত্যা চালাচ্ছে, আর ২০০ কোটি কাপুরুষ মুসলমান নির্লজ্জের মতো তাদের ভাইয়ের হত্যাকারীদের তোষণ করে চলেছে। সংবাদে দেখলাম পাকিস্তান ‘শান্তিতে’ নোবেল পুরস্কারের জন্য চরম যুদ্ধবাজ ও ইসলামোফোবিক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নাম প্রস্তাব করেছে! তামাশারও বোধহয় একটা সীমা থাকা দরকার। আমাদের জাতীয় কবি নজরুলের একটি কবিতার দুটি লাইন স্মরণে আসছে। বিদ্রোহী কবি লিখেছিলেন—
‘যে বলে সে মুসলিম—জিভ ধরে টানো তার!
বেইমান জানে শুধু জানটা বাঁচানো সার!’
মুসলিম বিশ্বে সর্বব্যাপী অন্ধকারের মধ্যে ইরান আজ আলোকবর্তিকা হয়ে আবির্ভূত হয়েছে। তারা শিয়া নাকি সুন্নি, এটা নিয়ে আমার কোনো আগ্রহ নেই। এসব বিতর্ক সব ইসলামি ধর্মবেত্তাদের জন্য নির্ধারিত থাকুক। ইরানের অনেক অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্রনীতি নিয়েও আমার যথেষ্ট সমালোচনা রয়েছে। হিন্দুত্ববাদী ভারতের সঙ্গে সখ্য করে তার ফল কী হয়েছে, সেটা ইরানের নেতাদের বিবেচনা করা উচিত।
কিন্তু ইসরাইলি ও পশ্চিমা গুন্ডামির কাছে মাথা নত না করায় আমি ইরানকে প্রাণঢালা অভিনন্দন ও শ্রদ্ধা জানাই। বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের অন্যায়ের বিরুদ্ধে একাকী প্রতিবাদের সাহস দেখিয়ে সুপ্রাচীন সভ্যতার স্বাক্ষর রেখেছে ইরান। সীমিত সামরিক শক্তি নিয়েও জালিমের মোকাবিলা করে ইরানি নেতৃত্ব প্রমাণ করেছেন, মুসলমানের শৌর্য এখনো হয়তো একেবারে নিঃশেষিত হয়ে যায়নি। মুসলিম রেনেসাঁর স্বপ্ন দেখতে ইরান আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে। শাবাশ ইরান!