Image description
 

গত সপ্তাহে অস্ট্রেলিয়া থেকে একটি বড় ক্যারিয়ার গ্রুপ আমার অফিসে এসেছিল। এই দলে কেউ কেউ অস্ট্রেলিয়ায় সরকারি চাকরিতে আছেন, যাঁরা আগে ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা করতেন। এদের সঙ্গে আমার এক দারুণ আলোচনা হয়। একই সঙ্গে, আমাদের একটি অনলাইন আড্ডাও হয়েছিল, যেখানে আমেরিকা, ইংল্যান্ড, এবং কানাডা থেকে শিক্ষক ও গবেষকরা একসঙ্গে অংশ নেন। সবার মধ্যেই এক ধরনের গভীর হতাশা কাজ করছিল। তারা স্পষ্ট করে বলেছে—আমার উচিত এই বিষয়ে লেখা, কারণ লেখালেখির মাধ্যমে কিছু আওয়াজ তোলা দরকার। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসেও ছাত্ররা প্রতিনিয়ত তাদের হতাশার কথা বলছে। তারা বলে, “স্যার, যেহেতু আপনি লেখেন, তাই আপনারই বলা উচিত।” এইসব কথাগুলোই আমাকে লিখতে বাধ্য করেছে। এই লেখাটি শুধুমাত্র ব্যক্তিগত মত নয়—এটা আমাদের সময়ের, আমাদের প্রজন্মের, এবং ভবিষ্যতের প্রশ্ন।

 

আমরা ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে দাঁড়িয়ে আছি। বহু বছর ধরে স্বৈরশাসন, দমন-পীড়ন চলার পর, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে দেশের মানুষ আবার নিজের কণ্ঠ ফিরে পেয়েছিল। সেই গণজাগরণ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত, সাহসী, এবং আশায় ভরা। কিন্তু সেই আন্দোলনের পর ধীরে ধীরে একটা শূন্যতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। যে দল এক সময় মানুষের কষ্টের কথা বলত, যে দল সবচেয়ে বেশি ত্যাগ স্বীকার করেছিল, সেই দল এখন অনেক ক্ষেত্রে অস্পষ্ট বললেই চলে। বিএনপির এই নীরবতা, দ্বিধা ও ভেতরের বিশৃঙ্খলা আমাদের খুব ভাবিয়ে তুলছে।তারেক রহমান আপনার ব্যক্তিগত ত্যাগ আমরা জানি, এবং দেশের ইতিহাসে আপনার ও আপনার পরিবারের অবদান কেউ অস্বীকার করে না। মানুষ এখনো আপনাকে আপনজন মনে করে—এটাও সত্যি। কিন্তু এখনকার বাস্তব পরিস্থিতির সঙ্গে আপনি কতটা সচেতন, সেটা খুব পরিষ্কার নয়। এখানে আপনার কতটুকু সীমাবদ্ধতা আছে সেটাও পরিষ্কার নয়। হতে পারে আপনাকে ঘিরে থাকা সিনিয়র নেতারাই অনেক সময় ভুল তথ্য দিচ্ছেন, অথবা দেশে অনুপস্থিতে আপনি অনেক সময় সত্যতা উপলব্ধি করতে পারছেন না। 

 

আপনাকে বলা হচ্ছে, আপনি দেশে ফিরলেই সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। বলা হচ্ছে, মানুষ আপনাকে চায়, দল প্রস্তুত এবং জয় শুধু সময়ের ব্যাপার। কিন্তু একজন শিক্ষক ও গবেষক হিসেবে, প্রতিদিন সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে, ছাত্রদের কণ্ঠ শুনে আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি—এই চিন্তা অনেকটা ভুল বা স্বপ্নের মতো। যদি আপনি এখনই দ্রুত, সাহসের সঙ্গে এবং পরিষ্কার পরিকল্পনা নিয়ে সামনে না আসেন, তাহলে বিএনপির ভিত্তি আরও দুর্বল হয়ে যাবে। বিশ্বাস করুন, এটা সময়ের ব্যাপার মাত্র।আপনাকে স্পষ্ট করে বলি—জাতীয় নির্বাচন আগে হওয়ার দাবি বিএনপির ভুল নয়। কিন্তু কৌশল হিসেবে বিএনপি যদি সরাসরি সবকিছু বাদ দিয়ে বসে থাকে, সেটাও ঠিক নয়। বরং বিএনপি শর্তসাপেক্ষে ধাপে ধাপে স্থানীয় নির্বাচনে অংশ নেওয়ার প্রস্তাব দিতে পারে।

 

 প্রথমে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনার মতো বড় শহরের সিটি করপোরেশন নির্বাচন, তারপর উপ-শহর, ওয়ার্ড কমিশনার, ইউনিয়ন পরিষদ এবং উপজেলা নির্বাচনেও অংশ নেওয়া যেতে পারে। এতে করে বিএনপি আবার সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারবে, সংগঠনের শক্তি পরখ করতে পারবে, এবং জাতীয় নির্বাচনের জন্য একটি প্রস্তুতির সুযোগ পাবে।সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো—বিএনপি যদি স্পষ্টভাবে বলে যে তারা স্থানীয় নির্বাচন অংশগ্রহণ করবে যদি অন্তর্বর্তী কালীন সরকার কোনোরকম তালবাহানা না করে জাতীয় নির্বাচনের একটি সুনির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা করে, ভোটার তালিকা ঠিক করা হয়, এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নিরপেক্ষ মনিটরিং থাকে—তাহলে বিএনপি একটি দায়িত্বশীল এবং বাস্তবমুখী দলের চেহারায় সামনে আসবে। এতে করে মানুষ ভাববে না যে বিএনপি নির্বাচন এড়িয়ে যাচ্ছে, বরং তারা বুঝবে—বিএনপি গঠনমূলক অবস্থানে আছে। আর তখন চাপে পড়ে যাবে অন্তবর্তীকালীন সরকারের নিজেই।

 

বিএনপির অনেক নেতাই মনে করছেন, এখন যদি স্থানীয় নির্বাচনে অংশ নেওয়া হয়, তাহলে জাতীয় নির্বাচন পিছিয়ে যেতে পারে। এ আশঙ্কা একেবারে ভুল নয়—কারণ দেখা যাচ্ছে, কিছু রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তি এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতার মেয়াদ বাড়াতে চায়। তাই এই দুশ্চিন্তা বাস্তব। কিন্তু এর সমাধান হতে পারে একটি স্পষ্ট ও কৌশলী অবস্থান। সরাসরি নির্বাচন বর্জন না করে, শর্তসাপেক্ষ অংশগ্রহণের পথে গেলে বিএনপি যেমন দায়িত্বশীল ভাবমূর্তি পাবে, তেমনি কৌশলগত সুবিধাও পাবে। উদাহরণ হিসেবে আমরা ঢাকার কথা বলতেই পারি—ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণে বিএনপির পরিচিত ও জনপ্রিয় মেয়র প্রার্থী আগে থেকেই আছে। ইশরাক হোসেন এবং তাবিথ আউয়াল নাম ইতোমধ্যে মানুষ চেনে। চট্টগ্রামেও ডা. শাহাদাত হোসেনের মতো নেতার তৃণমূলে ভালো গ্রহণযোগ্যতা আছে। অন্য দলগুলোর মধ্যে এই মুহূর্তে তেমন কোনো জনপ্রিয় প্রার্থী দেখা যাচ্ছে না। সুতরাং, বিএনপির এখানে পরিষ্কার একটা কৌশলগত সুবিধা আছে—যেটা ব্যবহার না করলে, সেটা হবে একটা বড় ভুল।

 

বিএনপির ভেতরে আরও একটি আশঙ্কা আছে—তা হলো, স্থানীয় নির্বাচনে অংশ নিলে সহিংসতা হতে পারে, কর্মীরা একে অন্যের সঙ্গে মারামারিতে জড়িয়ে পড়বে, প্রাণহানি হবে, আর এর প্রভাব পড়বে জাতীয় নির্বাচনের ওপর। এই আশঙ্কা অতীত অভিজ্ঞতা থেকে এলেও, এটি ধরে বসে থাকা মোটেই ঠিক না। কারণ, যদি কেউ মনে করে দেশের চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে ব্যক্তি বড়—তাহলে তার রাজনীতি করার দরকার নেই। বরং যারা রাজনীতিকে ত্যাগ ও চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখে, তাদেরই রাজনীতি করার অধিকার আছে। বিএনপির উচিত এখনই সাহস নিয়ে সামনে আসা, এবং নেতাকর্মীদের সেই বার্তাই দেওয়া—যে আমরা ভয় পাই না, আমরা দেশ ও মানুষের জন্য লড়ি। তারেক রহমান, এই তরুণ প্রজন্ম—এই নতুন জেনারেশন—আপনার মনোযোগ পাওয়ার যোগ্য। তারা আগের মতো অনুসারী না। তারা সাহসী, রাজনৈতিকভাবে সচেতন, আর আবেগপ্রবণ। তারা ফাঁকা স্লোগান বা পুরোনো ধাঁচের নেতৃত্বে আগ্রহী নয়। তারা চায় সরাসরি যোগাযোগ, দিকনির্দেশনা, আর তারা চায় আপনি তাদের পাশে থাকুন—তাদের উপর নয়। আমরা যারা এখনো বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের আদর্শকে ভালোবাসি, তারা আজ কষ্টে আছি। কারণ আমাদের বিশ্বাস নষ্ট হয়ে যায়নি, কিন্তু আমরা নিজেদের একা মনে করছি। 

 

বিএনপির সিনিয়র নেতৃত্ব দলের সঙ্গে সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা দূরত্ব তৈরি করে ফেলেছে। আমরা দেখছি দলের ভেতরে মারামারি, বিভ্রান্তি, আর সবচেয়ে ভয়ংকর—সব কিছু অস্বীকার করার সংস্কৃতি। নেতারা বলছেন, দলে কোনো সংস্কারের প্রয়োজন নেই। তারা সোশ্যাল মিডিয়ায় তরুণদের কণ্ঠ উপেক্ষা করছেন। তারা সব দোষ চাপাচ্ছেন মিডিয়ার বিচার, আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র আর অন্যান্য দলের ওপর—কিন্তু নিজের মুখের সামনে আয়নায় তাকাতে নারাজ।বিএনপির অনেক সিনিয়র নেতা এখন এমন একটা সংস্কৃতি তৈরি করেছেন, যেখানে মনে হয় তারা যেন কিছুই করতে পারেন না, কোনো দায়িত্ব তাদের নেই—সবকিছু আপনি এসে ঠিক করে দেবেন এই আশায় বসে আছেন। “তারেক দেশে এসে সব ঠিক করে দেবে”—এই ধরনের ভাবনা শুধু সরল নয়, এটি বিপজ্জনক—আপনার জন্য, দলের জন্য, এবং দেশের জন্য। আমরা ইতোমধ্যেই সেই পুরোনো ধাঁচের রাজনীতির চিহ্ন দেখছি, যেখানে একজন নেতা সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠেন, আর পুরো দল স্থবির হয়ে পড়ে। অতীতেও অনেক নেতাকে এমনভাবে ঘিরে ধরা হয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ “আওয়ামী লীগ খারাপ কিন্তু শেখ হাসিনা ভালো” অথবা “শেখ হাসিনা একাই কি করবেন আর কত দিক সামলাবেন”? বিএনপি নেতারা এখন একই সংস্কৃতির মত কথা বলছে। তারা পুরো বোঝাটা আপনার ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে। এই মডেল একবার ব্যর্থ হয়েছে। বিএনপির আবার এই ভুল করা উচিত নয়।

 

রাজনীতিতে একটা কথা আছে—যদি আপনি জনগণের চেয়ে এগিয়ে না থাকেন, তাহলে একসময় পিছিয়ে পড়বেন। আপনাকে এই ভুলটা করতে দেওয়া যাবে না। অনেক সিনিয়র নেতা এখনো ধরে রেখেছেন তাদের তথাকথিত ‘সেফ সিট’—যেমন তারা মনে করেন, এই এলাকার এমপি হওয়া তাদের অধিকার। তারা কোনো সংস্কার চান না, কারণ তারা ভয় পান—নতুন প্রজন্ম উঠে এলে তাদের পুরোনো ক্ষমতা হারিয়ে যাবে। এই আচরণ দেখায় যে তারা পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুত না, বরং নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করতে চান। এতে করে জনগণ—বিশেষ করে তরুণরা—ভাবছে বিএনপি পুরোনো ক্ষমতার কাঠামো রক্ষা করতে চায়, ভবিষ্যতের নেতৃত্ব তৈরিতে আগ্রহী নয়। এই মানসিকতা এখনকার সময়ের সঙ্গে মেলে না।এখন সময় নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ঘোষণার। দলের নেতৃত্ব গঠনে দক্ষতা ও মেধাকে প্রাধান্য দিতে হবে, শুধু আনুগত্য নয়। তরুণদের নেতৃত্বে এগিয়ে আসার সুযোগ দিতে হবে। সমালোচনার মুখে ধৈর্য ধরতে হবে, প্রতিশোধ নয়। এমনকি যাদের সঙ্গে মতের অমিল আছে, তাদের সঙ্গেও জোট গড়ে তুলতে হবে। বিএনপি'র এই ভয়ে চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই যে, পুরোনো নেতারা দল ছাড়বেন বা দল ভাঙবেন বা অন্য দলে যোগ দিবেন । বরং তাদের বিদায় হতে পারে বিএনপির আত্মাকে ফিরে পাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় মূল্য। 

 

এখন বিএনপির বিরুদ্ধে নানা রাজনৈতিক গোষ্ঠী— বাম, ডান, মধ্যপন্থী—একত্র হয়েছে। আর পুরোনো শত্রু আওয়ামী লীগ তো আছেই। তারা আদর্শে এক না হলেও একজোট হয়েছে বিএনপিকে কোণঠাসা করতে এবং আওয়ামী লীগের পরবর্তী রাজনীতিকে দখল করতে। যদি এখনই বিএনপি সাহসিকতার সঙ্গে নিজের সংস্কার না করে, তবে দল আরও একঘরে হয়ে পড়বে। এই একঘর হওয়া শুধু প্রতিষ্ঠানে সীমাবদ্ধ থাকবে না—তা হবে আবেগগত এবং প্রজন্মগত। তরুণরা মুখ ফিরিয়ে নেবে। মাঠের কর্মীরা নিরুৎসাহিত হবে। আন্তর্জাতিক মহল বিশ্বাস হারাবে যে বিএনপির সামনে কোনো বাস্তব পথ আছে।আমরা বুঝি, বিএনপির বিরুদ্ধে এখন একটা পরিকল্পিত প্রচারণা চলছে—সংবাদমাধ্যমে, সোশ্যাল মিডিয়ায়, সব জায়গায়। অনেক কথাই বিকৃত করে বলা হচ্ছে। কিন্তু চুপ করে থাকলে বা সব কিছু অস্বীকার করলে কোনো লাভ হবে না। বিএনপিকে মাটির বাস্তবতা যেমন বুঝতে হবে, তেমনি অনলাইনে মানুষের মন কীভাবে তৈরি হচ্ছে সেটাও বুঝতে হবে। আজকের দিনে মানুষ ফেসবুক, টিকটক, টুইটার আর ইউটিউব দেখে মতামত গঠন করে। শুধু মাঠের নেতাকর্মীদের উপর ভরসা করে এখন আর চলা যাবে না। এই দুই দিক—মাঠ আর অনলাইন—দুটোকেই একসাথে গুরুত্ব দিতে হবে।

 

সত্য কথা হচ্ছে—এটা তেতো হলেও মানতে হবে। শুধু বাইরের আক্রমণে নয়, বিএনপির নিজের ভেতরের জেদ ও কঠোর অবস্থানের কারণেও দলের ভাবমূর্তি অনেকটাই নষ্ট হয়েছে।  অতীতে যেসব ভুল হয়েছে—যেমন বিতর্কিত জোটে যাওয়া, ভুল কৌশল আর দুর্নীতির অভিযোগ—এসবের কারণে শহরের শিক্ষিত সমাজ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির একাংশের মধ্যে বিএনপির প্রতি আস্থা এখনো কম। এখন অনেকেই ভাবছে, বিএনপি আসলে কোনো পরিবর্তন চায় না, শুধু ক্ষমতায় যেতে চায়, আর বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে চলে গেছে। এই ধারণা সব সময় ঠিক না—তবু এটা মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। কারণ বিএনপির পক্ষ থেকে এসবের বিরুদ্ধে জোরালো কোনো বক্তব্য আসছে না। নতুন কোনো বার্তা নেই, সংস্কারের কোনো প্রতীক নেই, আর দলের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে তরুণদের কোনো সরাসরি যোগাযোগ চোখে পড়ে না।এই ফাঁকে অন্য দলগুলো কিন্তু মাঠ দখল করে নিচ্ছে। যাদের অনেকেই এক সময় আওয়ামী লীগ সরকারের ছাত্র সংগঠনের অংশ ছিল, তারা তখন কখনোই রাষ্ট্রের অন্যায় বা দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলেনি। বরং অনেকেই তখনকার সরকারকেই সমর্থন করেছিল। তারা কারচুপির ভোটে অংশগ্রহণ করে আঙ্গুলে ভোটের চিহ্ন দিয়ে তারা ফেসবুকে ছবি পোস্ট করেছিল। তারাই বলতো উন্নয়ন আগে নির্বাচন পরে।  অথচ এখন তারাই নৈতিকতার কথা বলছে—আর বিএনপি চুপচাপ বসে আছে, দূরে সরে গেছে। 

 

কেউ কেউ এখন ড. ইউনূসের ব্যক্তিত্ব আর জনপ্রিয়তাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। বাস্তবতা হলো, এখন পর্যন্ত এই সরকার যে সাফল্য পেয়েছে, তার কৃতিত্ব একমাত্র ড. ইউনূসেরই। যদি কেউ চান ড. ইউনূস দীর্ঘমেয়াদে নেতৃত্বে থাকুন, তাহলে তাদের উচিত হবে—ড. ইউনূস নিজে যেন সব উপদেষ্টা আবার নির্বাচন করেন । কারণ নিউ এজের বিশিষ্ট সম্পাদক জনাব নুরুল কবিরের সাথে সাক্ষাৎকারে তিনি নিজেই বলেছেন বেশিরভাগ উপদেষ্টা তার নিজের না, তাকে ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেক্ষেত্রে তিনি যেন পুরো উপদেষ্টা পরিষদ নতুন করে গঠন করেন। না হলে তাঁর নাম ব্যবহার করে গ্রহণযোগ্যতা অর্জনের ভান করা, আর পাশে দলীয় আমলা ও সুবিধাবাদী ও ক্ষমতালোভী সুশীল সমাজদের কে হাতে রেখে কাজ চালানো—এটা রাজনৈতিক ভণ্ডামি ছাড়া আর কিছু নয়।আর বিএনপিরও একটি বিষয় বোঝা দরকার—তাদের উচিত না এমন কিছু গোষ্ঠীর মন জয় করতে চেষ্টা করা, যারা কখনোই বিএনপিকে সমর্থন করবে না। যতই চেষ্টা করা হোক, কিছু আন্তর্জাতিক থিংক ট্যাংক বা ভারতপন্থী বুদ্ধিজীবী ও মিডিয়া কখনো বিএনপির পাশে দাঁড়াবে না। ইতিহাসই বলে, তারা সব সময় এক পক্ষকেই বিশ্বাস করে। তাই বিএনপির এখন সব মনোযোগ জনগণের দিকে দিতে হবে—বিশেষ করে তরুণদের দিকে। নতুন করে সেখানেই বিশ্বাস গড়ে তুলতে হবে।

 

তারেক রহমান কথা বলুন। মন খুলে বলুন। ছাত্রনেতাদের সঙ্গে কথা বলুন। তরুণদের সঙ্গে কথা বলুন। যারা অন্য দলে থেকেও গণতন্ত্র চায়, তাদের সঙ্গেও কথা বলুন। শুধু প্রেস বিজ্ঞপ্তি বা চ্যানেলের মাধ্যমে নয়, মন থেকে, আন্তরিকভাবে কথা বলুন। যাঁরা জুলাই মাসের আন্দোলনে সামনে ছিলেন, তাঁদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করুন। ছাত্রনেতাদের পাশে বসে তাঁদের হতাশা, স্বপ্ন আর একটি নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন কীভাবে দেখতে চান—তা মন দিয়ে শুনুন। যারা হয়তো আপনার সঙ্গে সব বিষয়ে একমত নয়, কিন্তু একটি ন্যায্য ও অংশগ্রহণমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থা চায়, তাদের প্রতিও হাত বাড়িয়ে দিন। আন্তরিক সংলাপ, সহানুভূতি আর শিখতে চাওয়ার মানসিকতা দেখিয়ে আপনি আবার আস্থা গড়ে তুলতে পারেন। এই সময়ের নেতৃত্ব মানে হচ্ছে—বিভিন্ন মতের মানুষকে একত্র করা এবং এমন একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা, যেখানে তরুণদের কণ্ঠ শুধু শোনা নয়, দলের ভবিষ্যতের অংশ হিসেবে গ্রহণ করা হয়।

 

আপনার এই নীরবতা অনেক ভুল বোঝাবুঝি তৈরি করছে। এখনকার যুগে, মানুষ মুহূর্তেই মতামত গড়ে ফেলে, আর ভুল তথ্য সত্যের চেয়ে অনেক দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এই ডিজিটাল ও আবেগের জায়গা থেকে বিএনপির অনুপস্থিতি এখন অনেক বড় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজকের দিনে সোশ্যাল মিডিয়াই হয়ে উঠেছে জনমতের প্রধান যুদ্ধক্ষেত্র। আর সেই জায়গায় বিএনপি হয় ভুলভাবে উপস্থাপিত হচ্ছে, নয়তো একেবারেই অনুপস্থিত।ভুল তথ্য, খণ্ডিত উদ্ধৃতি, আর বিভ্রান্তিকর আলোচনা এখন অনেক মানুষের কাছে বিএনপি সম্পর্কে নেতিবাচক একটা ধারণা তৈরি করে দিচ্ছে। এটা শুধু প্রচার সমস্যাই নয়, এটা একটি বড় 'উপস্থাপনার সংকট'। যদি এখনই খোলামেলা, নিয়মিত যোগাযোগ না করা হয়—যেমন ফেসবুক লাইভে কথা বলা, সরাসরি প্রশ্নোত্তর অনুষ্ঠান, টাউন হল সভা বা জনপ্রিয় অনলাইন ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে যুক্ত হওয়া—তাহলে এই ফাঁকা জায়গা অন্যরা দখল করে নেবে, যারা শুধু বিএনপিকে ছোট করতেই চায়।আপনি যদি মনে করেন, দেশের ভবিষ্যতে আপনার ভূমিকা আছে—তাহলে আর দেরি না করে আপনাকে তাড়াতাড়ি দেশে আসতে হবে। শুধু অনলাইনে থাকা বা দূর থেকে পরিকল্পনা করলেই হবে না। আপনাকে বাস্তবে, মাঠে নামতে হবে। তরুণরা হয়তো অতীতের ভুল ভুলে যেতে পারে। কিন্তু যদি আপনি না থাকেন, চুপ থাকেন—তারা সেটা ক্ষমা করবে না। তারা চায় একজন সাহসী, সক্রিয় নেতা। 

 

তারেক রহমান, এখনই সময়। সামনে এসে দাঁড়ান। এর আগেই হয়তো সুযোগটা হারিয়ে যাবে। ইতিহাস সবসময় দ্বিতীয় সুযোগ দেয় না। যদি এখন ভুল করি, তাহলে আবার সেই পুরনো ভুলের পথেই হাঁটবো। যেমনটা হয়েছিল ১৯৯৫ আর ২০০৬ সালে—যখন বিভ্রান্তি, দ্বন্দ্ব আর অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের কারণে দল বড় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। আজও সেই ভুলের ছায়া দেখা যাচ্ছে। এবং তার ফলাফল এখনো দলের ভাবমূর্তি আর শক্তির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। তাই এখনই সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়—না হলে ভবিষ্যৎ আর অতীতের মাঝে পার্থক্য থাকবে না।

লেখক: মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন শিকদার

শিক্ষক ও গবেষক, রাষ্ট্র ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়