কনকনে ঠাণ্ডার এক সকাল। ঘন কুয়াশা আর হিমেল হাওয়ায় নগরী নিস্তব্ধ। হিমশীতল এই দিনে ঘুম আরও একটু গভীর হবার অপেক্ষায়। কারও কারও ঘুম তখন ভাঙছে। যারা জেগেছেন, তারা পেলেন গা শিউরে ওঠা এক দুঃসংবাদ। সব চিকিৎসার প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে চিরতরে চলে গেলেন বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া।
মুহূর্তেই শোকের ছায়া নেমে আসে সারাদেশে। রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ভিড় জমান অসংখ্য নেতাকর্মী ও সমর্থক। এর আগে থেকেই সেখানে উপস্থিত ছিলেন খালেদা জিয়ার পুত্র ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
মায়ের মৃত্যুতে তিনি বড্ড একা হয়ে পড়লেন। নিশ্চয়ই এই দিনটি তিনি তার সারাজীবনে চাননি। দেশে ফেরার মাত্র পাঁচদিনের মাথায় হৃদয়বিদারক এই খবর দুমড়েমুচড়ে দিচ্ছে তারেক রহমানকে। হয়তো আমৃত্যুই তাকে পোড়াবে।
শেষবারের মতো মায়ের কাছে হাসপাতালে যাওয়ার খবর লন্ডনে বসে যখন তারেক রহমান পেলেন, তখন তার ভীষণ মন খারাপের কথা জানা যাচ্ছিল। সেখানকার নেতাকর্মীদের সঙ্গে দেখা করছিলেন না তিনি। কিছুটা সময় কাটাচ্ছিলেন একান্তে। নিশ্চয়ই মাকে নিয়েই ভাবছিলেন।
তার স্মৃতির মানসপটে হয়তো ভেসে উঠছিল দেশের গণতন্ত্র রক্ষায় মায়ের অবিচল লড়াই। দীর্ঘ সময় ধরে দূরে থাকায় মায়ের সেবা করতে না পারার আক্ষেপ।
অথচ বাবা জিয়াউর রহমানকে হারিয়ে মা যখন রাজপথে এলেন, তখন তার পাশেই থেকেছেন তারেক রহমান। সে সময় তারেকের বয়স ছিল খুবই অল্প। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতির গতিপথ বদলে গেলে সেই আঘাত জিয়া পরিবারেও লাগে। ভীষণভাবে লাগে।
এই আঘাত তারেক রহমানকে দেশ ছাড়া করে। তাকে সইতে হয় শারীরিক-মানসিক নির্যাতন। একই ভাগ্য নেমে এসেছিল ছোট ভাই আরাফাত রহমান কোকোর ক্ষেত্রেও। কোকো তা কাটিয়ে উঠতে পারেননি। ২০১৫ সালের ২৪ জানুয়ারি মালয়েশিয়ায় মৃত্যুবরণ করেন খালেদা জিয়ার ছোটপুত্র। ভাইকে শেষ দেখার সুযোগ হয়নি তারেক রহমানের। আর মা খালেদা জিয়া এতটাই ভেঙে পড়েছিলেন যে তাকে ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয়া হয়।
এর তিন বছরের মাথায় কারাগারে যান খালেদা জিয়া। এই যাত্রায় জিয়া পরিবার ও বিএনপি নেতাকর্মীরা ভেঙে পড়ে। পরবর্তী অধ্যায়ে খালেদা জিয়ার নানা অসুস্থতার খবর পায় দেশবাসী।
গণঅভ্যুত্থানের পর মুক্তি পেয়ে যুক্তরাজ্যে গিয়ে চিকিৎসা নিলে দলের নেতাকর্মীরা আশা করছিলেন, তাদের নেত্রী সহসাই তাদের ছেড়ে যাবেন না। ভোট দেবেন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। প্রকাশ্যে না এলেও আড়ালে থেকে দিক-নির্দেশনা দেবেন।
কিন্তু গত ২৩ নভেম্বর থেকে এভারকেয়ারে চিকিৎসাধীন খালেদা জিয়াকে নিয়ে শঙ্কা দেখা দেয়। দেশের মানুষের প্রার্থনায় ঠাঁই পান তিনি। এর মধ্যে বিদেশে নেয়া, চিকিৎসক নিয়ে আসাসহ সব ধরনের চেষ্টা চালানো হয়। কিন্তু তার শরীর প্রস্তুত ছিল না উড়াল দেয়ার জন্য। হয়তো সৃষ্টিকর্তাও চেয়েছিলেন, তার বিদায় বাংলাদেশের মাটিতেই হোক। কারণ, খালেদা জিয়ার সারাজীবনের আকাঙ্ক্ষা-প্রতিজ্ঞাই ছিল-‘আমি দেশ ছেড়ে, দেশের মানুষকে ছেড়ে কোথাও যাব না। এই দেশই আমার একমাত্র ঠিকানা। দেশের বাইরে আমার কিছু নেই, কোনো ঠিকানাও নেই।’
তিনি হয়তো অপেক্ষা করছিলেন ছেলে তারেকের জন্য। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের রাজসিক প্রত্যাবর্তন দেখতে।
সব বাধা কাটিয়ে ছেলে এলেন লাল-সবুজের দেশে। কাড়লেন পুরো দেশের নজর। যা ছড়িয়ে পড়ে বিদেশেও। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে তাকে পরিচয় করিয়ে দেয়া হচ্ছে ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে।
ছুটির দিনেও তারেকের ফেরাকে ঘিরে রাজধানী ঢাকা অচল হয়ে পড়েছিল। রাস্তায় রাস্তায় সর্বস্তরের মানুষের উপচেপড়া ভিড় দেখা গেছে। বিমানবন্দর থেকে সংবর্ধনাস্থল ৩০০ ফিটে আসতে প্রায় ৭ কিলোমিটারের পথে সময় লাগে দুই ঘণ্টার বেশি।
কিন্তু পাঁচদিনের মাথায় তারেক আবারও পরিবারের সদস্য হারানোর বেদনায় সিক্ত হলেন। জীবনের কিছুই বুঝে ওঠার আগে ’৮১ সালে পিতাকে হারান তারেক। নির্মম মৃত্যুর সেই দৃশ্য কীভাবে আজও ভুলবে তিনি?
এরপর ভাইকে নিয়ে মায়ের সাথে লড়ে যান দেশ গড়ার লড়াইয়ে। কিন্তু পথিমধ্যে ভাইকেও হারান। এই মৃত্যুও স্বাভাবিক নয়। নির্যাতনের ক্ষতেই তো দুনিয়া ছাড়েন কোকো।
এক দশকের বেশি সময় পর আবার পরিবারের সদস্যের মৃত্যু সংবাদ, এবার এতিম হলেন তারেক রহমান। বাবা বা ভাই হারানোর শোক হয়তো তিনি ভুলতে চেয়েছিলেন ‘আম্মার’ চোখের দিকে তাকিয়ে। কিন্তু সেই চোখও বুজে গেলো চিরতরে। এই মা হারানো কতটা কষ্টের, কতটা বেদনার, তা কেবল একজন মা-হারা সন্তান-ই জানেন।
তবে বিদায়বেলায় তারেককে হয়তো খালেদা জিয়া একটি বার্তা দিয়ে গেলেন। শত প্রতিকূলতার মাঝেও দেশ-দেশের মানুষকে ছেড়ে না যাওয়া, আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে লড়ে যাওয়া। দেশ রক্ষায় ও মানুষের জন্য প্রয়োজনে নিরাপদ জীবনের বদলে কন্টকাকীর্ণ পথ বেছে নেওয়া। একা হয়ে পড়া তারেকের জন্য এ লড়াই নিশ্চয়ই সহজ নয়। কিন্তু পাড়ি যে দিতে হবে দীর্ঘ পথ! সেই পথও যে বন্ধুর, তাও নিশ্চয়ই ‘আম্মা’ তার প্রাণপ্রিয় তারেককে বলে গেছেন।