Image description

একদিকে ব্যবসার স্থবির পরিবেশ, অন্যদিকে ছোট-বড় ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ। অনেক ব্যবসায়ীর সময় কেটেছে কোর্ট-কাচারিতে। পাশাপাশি উচ্চ সুদের হার, উচ্চ মূল্যস্ফীতি নতুন বিনিয়োগ থেকে ব্যবসায়ীদের দূরে রেখেছে। সব মিলিয়ে ২০২৫ সাল ছিল বেসরকারি খাতের জন্য হতাশার বছর।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে মাত্র ৬ দশমিক ২৩ শতাংশে (অক্টোবর ২০২৫), যা এ খাতে আস্থার সংকটের একটি সরাসরি অর্থনৈতিক সূচক। এ সংকট স্পষ্ট হয়ে উঠছে বিনিয়োগ ও ব্যবসা সম্প্রসারণ না করার সিদ্ধান্তে। ২০২৫ সালের জুলাই থেকে নভেম্বর সময়ে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির ঋণপত্র নিষ্পত্তি কমেছে ১৬ দশমিক ৭৭ শতাংশ, যা শিল্পায়নের ভবিষ্যৎ গতি নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। একই সঙ্গে জুনে শেষ হওয়া অর্থবছরে নতুন বিদেশী বিনিয়োগ (ইকুইটি ক্যাপিটাল) প্রবৃদ্ধি কমেছে ১৬ দশমিক ৯০ শতাংশ।

খাতসংশ্লিষ্ট প্রতিনিধি ও বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, চলতি বছর অন্যতম সমস্যা ছিল দুর্বল ঋণ প্রবৃদ্ধি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি ও বাজারের অস্থিরতার কারণে বেসরকারি খাতে ঋণ দেয়া কমে গেছে। রয়েছে বিনিয়োগে মন্দাও। দেশে নতুন বিনিয়োগ হয়নি, বিশেষ করে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে, যা অর্থনীতির দীর্ঘমেয়াদি প্রবৃদ্ধির জন্য উদ্বেগের কারণ। উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ায় সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। পাশাপাশি বেড়েছে ব্যবসা পরিচালনার খরচ। রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং অন্তর্বর্তী সরকারের বিভিন্ন নীতিগত সিদ্ধান্ত বেসরকারি খাতে নেতিবাচক প্রভাব রেখেছে।

সব মিলিয়ে ২০২৫ নিয়ে হতাশ বেসরকারি খাতের প্রতিনিধিরা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে বেসরকারি খাতের দূরত্ব ছিল। নীতিনির্ধারণের সঙ্গে মাঠপর্যায়ের ব্যবসা পরিস্থিতির যে ফারাক, তা আরো প্রকট হয়েছে। এখন কিছুটা উন্নতি হলেও বছরের অধিকাংশ সময় আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি খারাপ ছিল। অনেক ব্যাংকের অবস্থা নাজুক। এখন ভালো হলেও শুরুর দিকে ফরেন এক্সচেঞ্জ রিজার্ভের অবস্থা সুবিধাজনক ছিল না। বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগের আগে এসব পরিস্থিতি বিবেচনা করেন। দেশী ও বিদেশী দুই ধরনের বিনিয়োগকারীরা অপেক্ষায় আছেন স্থিতিশীল, নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকারের। বিনিয়োগকারীর বড় চাহিদা থাকে জ্বালানি নিশ্চয়তার। জ্বালানির প্রাপ্যতা নিশ্চিত না হওয়ায় বিনিয়োগকারীরা এগিয়ে আসেননি। আবার মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমলেও এখনো তা উচ্চপর্যায়েই রয়েছে।

মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এমসিসিআই) সভাপতি কামরান তানভিরুর রহমান গতকাল বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এটা একটা অন্তর্বর্তী সরকার। এ সরকার নির্বাচন দিয়ে চলে গেলে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় যে সরকার আসবে, আমরা আশা করছি তারা নিশ্চয়ই আমাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করবে। বর্তমান সরকার যদি আমাদের সংকট নিরসনের পথটা আলোচনার মাধ্যমে কিছুটা এগিয়ে রাখত তাহলে খুব ভালো হতো।’

তিনি আরো বলেন, ‘অর্থনীতিতে সহায়ক পরিবেশ তৈরি হতে আস্থার প্রয়োজন হয়। নতুন সরকার এলেই আস্থা ফিরে আসবে এমনটা নয়। সরকার আসবে, তারপর বেসরকারি খাতের কথা শুনতে হবে। দিন শেষে আমাদের কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে। আর সেটা সরকার একা বাড়াতে পারবে না। কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে বেসরকারি খাতের মাধ্যমে।’

বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের জন্য ২০২৫ সাল খুবই খারাপ বছর ছিল বলে মনে করেন শাহ্‌জালাল ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোসলেহ উদ্দীন আহমেদ। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘কোনো উদ্যোক্তা ২০২৫ সালে নতুন কারখানা খুলেছেন বলে শুনিনি। বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের ঘরে নেমে গেছে। এ প্রবৃদ্ধিতেও ঋণের অনাদায়ী সুদ ও সুদহার বৃদ্ধির প্রভাব রয়েছে। শিল্পের কাঁচামাল ও মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি অনেক কমেছে। পাঁচ মাস ধরে রফতানি খাতের প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক। এ পরিস্থিতিকে কোনোভাবেই বেসরকারি খাতের জন্য অনুকূল বলা যাবে না।’

মোসলেহ উদ্দীন আহমেদ আরো বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের দোহাই দিয়ে ঋণের সুদহার বাড়ানো হয়েছে। এত উচ্চসুদ দিয়ে এ দেশে ব্যবসা করা খুবই কঠিন। এখন সিএসএমই খাতের উদ্যোক্তারাও ঋণের জন্য ১৪-১৫ শতাংশ সুদ পরিশোধ করছেন। এ সুদের বাইরে সার্ভিস চার্জসহ আরো নানা ধরনের চার্জও রয়েছে। বিদ্যমান অবস্থা নতুন বছরও অব্যাহত থাকলে অর্থনীতির পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে।’

শিল্পোদ্যোক্তাদের দাবি, বর্তমান নীতিগত অস্পষ্টতা, জ্বালানি ও ব্যাংক খাতের দুর্বলতা এবং সিদ্ধান্তগ্রহণে ধারাবাহিকতার অভাব বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের আস্থাকে ক্ষয় করছে। কাঠামোগত সংস্কারের অভাবে বিনিয়োগের বাস্তব গতি ফেরানো যাচ্ছে না।

বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএমএ) সভাপতি আমিরুল হক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সরকারের উচিত বেসরকারি খাতের জন্য প্রভু নয় বন্ধু হওয়া।’ তার কথায়, ‘বর্তমানে সরকারের আচরণ বন্ধুত্বের সম্পর্কের পরিপন্থী।’ তার মতে, বেসরকারি খাত সবসময় আলোচনার মাধ্যমে সমাধান খুঁজে সামনের দিকে আগায়, কিন্তু বর্তমানে সেই আলোচনার সুযোগ বা পরিবেশ সংকীর্ণ হয়ে পড়েছে।

আমিরুল হক আরো বলেন, ‘বর্তমান সরকারের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের একধরনের দূরত্ব তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি আছে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, যা বর্তমানে উন্নয়নের সবচেয়ে বড় বাধা। ব্যবসায়ীরা বর্তমানে ১৫ শতাংশ সুদে ব্যবসা করতে হিমশিম খাচ্ছেন, অথচ কস্ট অব ডুয়িং বিজনেস কমানোর কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেই। এনবিআর ও বাংলাদেশ ব্যাংক কিছুটা কাজ করার চেষ্টা করলেও সামগ্রিকভাবে বেসরকারি খাত অবহেলিত বোধ করছে।’

রফতানিনির্ভর বাংলাদেশের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় শ্রমঘন খাত পোশাক শিল্প। এ পণ্য রফতানি খাতেও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বিচ্ছিন্নতার প্রভাব দৃশ্যমান বলে জানিয়েছেন শিল্পসংশ্লিষ্টরা। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসের মধ্যে পাঁচ মাসেই পোশাক রফতানি প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক ছিল, যা উৎপাদন সীমাবদ্ধতা ও বিনিয়োগ স্থবিরতার সম্মিলিত ফল। এ পরিস্থিতি নিয়ে নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাব দিলেও তাতে সাড়া পাওয়া যায়নি বলে প্রকাশ্যেই জানিয়েছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। তাদের দাবি, কোনো সমস্যা নিয়েই সরকারের সঙ্গে ফলপ্রসূ আলোচনা করা যায়নি।

বাংলাদেশের বাজারে দীর্ঘদিন ধরেই অনেক বহুজাতিক কোম্পানি ব্যবসা করছে। ব্যবসায়িক ও আর্থিক দিক দিয়ে এ কোম্পানিগুলোর অনেকের পারফরম্যান্স স্থানীয় কোম্পানির চেয়ে এগিয়ে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে অর্থনৈতিক স্থবিরতা, বিনিয়োগ খরা ও ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর ব্যবসা ও মুনাফার ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।

দেশের পুঁজিবাজারে বর্তমানে ১৩টি বহুজাতিক কোম্পানি তালিকাভুক্ত রয়েছে। কোম্পানিগুলোর প্রকাশিত প্রান্তিক আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্যানুসারে, চলতি বছর ছয়টির মুনাফা আগের তুলনায় কমে গেছে। এ সময়ে লোকসান গুনেছে দুই কোম্পানি। বাটা সু কোম্পানি (বাংলাদেশ) লিমিটেডের ২০২৫ সালের জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে আয় সামান্য বাড়লেও নিট মুনাফা কমেছে প্রায় ৪৮ শতাংশ। ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ কোম্পানি লিমিটেডের (বিএটিবিসি) এ সময়ে নিট আয় ১৭ শতাংশ ও নিট মুনাফা প্রায় ৪৬ শতাংশ কমেছে।

বার্জার পেইন্টসের আয় চলতি বছরের এপ্রিল-সেপ্টেম্বর সময়ে সামান্য বাড়লেও নিট মুনাফা কমেছে ৪ শতাংশ। চলতি বছরের জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর সময়ে গ্রামীণফোনের আয় ১ শতাংশ এবং নিট মুনাফা প্রায় ২১ শতাংশ কমেছে। হাইডেলবার্গ ম্যাটেরিয়ালসের বিক্রি প্রায় ২ শতাংশ ও নিট মুনাফা প্রায় ৪৪ শতাংশ কমেছে। চলতি বছরের জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর সময়ে আরএকে সিরামিকস ও সিঙ্গার বাংলাদেশের আয় বাড়লেও এ সময়ে কোম্পানি দুটিকে লোকসান গুনতে হয়েছে। তাছাড়া এ সময়ে আয় ও নিট মুনাফা কমেছে লিন্ডে বাংলাদেশের।

তালিকাভুক্ত বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর মধ্যে চলতি বছরের জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর সময়ে ইউনিলিভার কনজিউমার কেয়ার, লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশ ও রেকিট বেনকিজার বাংলাদেশের আয় ও নিট মুনাফা দুটোই বেড়েছে। অন্যদিকে এ সময়ে রবি আজিয়াটার আয় কিছুটা কমলেও নিট মুনাফা বেড়েছে। তাছাড়া এ বছরের এপ্রিল-সেপ্টেম্বর সময়ে ম্যারিকো বাংলাদেশের আয় ও নিট মুনাফা বেড়েছে।

ইউনিলিভার কনজিউমার কেয়ার লিমিটেডের চেয়ারম্যান মাসুদ খান একই সঙ্গে সিঙ্গার বাংলাদেশ, ম্যারিকো বাংলাদেশ ও বিএটিবিসির পর্ষদেরও স্বতন্ত্র পরিচালক। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সার্বিকভাবে বহুজাতিক ও স্থানীয় কোম্পানি সবারই ব্যবসা আগের তুলনায় কমে গেছে। উচ্চ সুদহার ও ন্যূনতম করের কারণে ব্যবসার খরচ অনেক বেড়েছে। এটি সব কোম্পানির মুনাফার ওপর প্রভাব ফেলেছে। এ সময়ে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি শ্লথ ছিল। মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমলেও তা এখনো ৮ শতাংশের ওপরেই রয়ে গেছে। অন্যদিকে ভোক্তাদের আয় কিন্তু সেভাবে বাড়েনি। এ কারণে অনেক ভোক্তা খরচ বাঁচাতে খাদ্যপণ্যের ভোগও কমাতে বাধ্য হয়েছেন। অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষেত্রে যেটা হয়, সবার মধ্যে একটা আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি থাকে যে শেষ পর্যন্ত কী হবে। বিনিয়োগ তো প্রায় শূন্যের কোটায় নেমে গেছে। বর্তমানে ভেলোসিটি অব মানিও (অর্থের হাতবদল) কিন্তু নিম্নমুখী। সব মিলিয়ে পুরো বছরজুড়ে হতাশার একটি চিহ্ন বিরাজমান ছিল।’

বিশ্লেষকদের মতে, সরকারের সঙ্গে বেসরকারি খাতের এ দূরত্ব এখন কেবল আস্থার নয়, বরং একটি প্রাতিষ্ঠানিক সমস্যায় রূপ নিচ্ছে। এমন অবস্থায় নতুন সরকার এলেও স্বল্পমেয়াদে এ ব্যবধান ঘুচবে এমন প্রত্যাশা বাস্তবসম্মত নয়। প্রয়োজন হবে নীতিগত স্বচ্ছতা, জ্বালানি ও আর্থিক খাতে কার্যকর সংস্কার এবং সিদ্ধান্তগ্রহণে ধারাবাহিকতা। নইলে বেসরকারি খাতের স্থবিরতা দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানের ওপর আরো গভীর চাপ তৈরি করতে পারে।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার কী করতে পারত আর কী করতে পারেনি তা মূল্যায়ন করতে হলে বেশকিছু বিষয় বিবেচনায় রাখতে হবে। সরকার যখন দায়িত্ব নিয়েছে তখন রাষ্ট্রীয় অনেক প্রতিষ্ঠান কার্যকর ছিল না, যা অতীতে কখনো দেখা যায়নি। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির এখনো কাঙ্ক্ষিত উন্নতি হয়নি, যা ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ রকম একটি পরিস্থিতিতে সরকারের পক্ষে অনেক কিছু করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। এক্ষেত্রে এত বিষয়ের দিকে নজর দেয়ার পরিবর্তে যদি গুরুত্বপূর্ণ ও মাঠপর্যায়ে দৃশ্যমান হবে এমন কিছু বিষয় নির্বাচিত করে সেগুলোর সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার দিকে সরকার নজর দিত তাহলে সেটি বেশি কার্যকর হতো।’