বেগম খালেদা জিয়ার হেলথ আপডেট বেশি একটা দিতে চাই না—কারণ অনেক মেডিকেল কনফিডেন্সিয়াল তথ্য পাবলিকলি লিখতে হয়, যা ছাড়া এই জটিল ব্যাপারটা ক্লিয়ার করা যায় না! কিন্তু আমি জানি না বেগম জিয়া বা তাঁর পরিবার ব্যাপারটা কে কীভাবে দেখেন! পশ্চিমা সমাজে এই ধরনের মেডিকেল ইনফরমেশনের প্রাইভেসি একটা সিরিয়াস ইস্যু এবং এটার ব্রিচ ভয়াবহ একটা ব্রিচ অব ট্রাস্ট! কিন্তু তারপরও এই পশ্চিমা দেশের পলিটিশিয়ান, পাবলিক অফিসিয়ালদের হেলথ ইনফরমেশন পাবলিকলি শেয়ার করাটাই প্রায় একটা বাধ্যতামূলক ব্যাপার! এটাই এক্সপেক্টেশন এবং সবাই এটাই চায় যে, একজন পলিটিক্যাল লিডার তার স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সবকিছু দেশের মানুষ জানুক। আর বাংলাদেশের মানুষ পশ্চিমা সমাজের মতো প্রটেক্টেড হেলথ ইনফরমেশন নিয়ে এতটা কনসার্নড না; ওদের ধারণা অনেকটা বিপরীত—যত বেশি লোক জানলো, তত বেশি মানুষ দোয়া করবে! এই ডিসক্লোজার দিয়ে বেগম জিয়ার অনুমতি ছাড়াই তাঁর কিছু হেলথ ইনফরমেশন শেয়ার করি, দেশের বৃহত্তর স্বার্থে।
১. খালেদা জিয়া ক্লিনিক্যালি ডেড না! এটা একটা পলিটিক্যালি মোটিভেটেড বাকোয়াজ ও বানোয়াট কথা! আর ক্লিনিক্যালি ডেড বলে কোনো টার্ম মেডিকেল লিটারেচার বা টেক্সটবুকে নাই! ডেড ইজ ডেড! ব্রেইন ডেড বলে একটা টার্ম আছে সিভিয়ার ব্রেইন ইনজুরি বা ব্রেইন হেমারেজ রুগীদের জন্য, যা খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য না!
২. আমি একজন ক্রিটিক্যাল কেয়ার স্পেশালিস্ট, যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়ে এ বিষয়ে প্রফেসর। ওনার মতো রোগীই আমি ডিল করি আমার দৈনিক কর্মজীবনে। আমি এই ফিল্ডে কাজ করছি ২৪ বছর ধরে।
৩. আমি আমার চব্বিশ বছরের বিজি প্রফেশনাল লাইফে খালেদা জিয়ার মতো বেঁচে থাকার ক্ষমতা আর ফাইট করার ক্ষমতা—আর কারো মধ্যে দেখি নাই! এই দেশের বা আমেরিকার বেস্ট হাসপাতালের যেকোনো রোগী ওনার মতো সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলে অনেক আগেই মারা যেতেন। আবারও বলছি—এই জটিল রোগী বাঁচে না আমেরিকার আইসিইউতেও! ক্রিটিকাল কেয়ার মেডিসিনে কিছু ল (Law) আছে, রুল অব থাম্ব (Rule of thumb) আছে। একটা মেডিকেল উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে বলি—ধরুন কোনো রোগীর বা কারও হার্টের ভাল্ভের মধ্যে কঠিন জীবন-সংহারী ফাঙ্গাস ইনফেকশন হলো। আমাদের রুল অব থাম্ব হচ্ছে—ইমার্জেন্সি ওপেন হার্ট সার্জারি করে ওই হার্ট ভাল্ভটা চেঞ্জ করতে না পারলে রোগী বাঁচবে না। রোগীর যদি সার্জারি করার মতো অবস্থা না থাকে, তাহলে আশা নেই—মৃত্যুর জন্য রেডি হোন। বেগম জিয়া আমার জানা মতে অন্তত দুবার মেডিসিনের এই ধরনের রুলকে ভুল প্রমাণিত করেছেন! ওনার আনক্যানি ফাইটিং পাওয়ার টেক্সটবুককে ভুল প্রমাণ করছে, বারবার!
৪. খালেদা জিয়া এখন লাইফ সাপোর্টে আছেন, ভেন্টিলেটর আছে (লাইফ সাপোর্ট নিয়ে আমার আগের লেখাটার লিংক কমেন্টে দিলাম)। ব্লাড প্রেশার ধরে রাখার জন্য সাপোর্টিভ মেডিসিন লাগছে, ডায়ালাইসিস লাগছে। রক্ত দিতে হচ্ছে—প্রায় ত্রিশ ব্যাগের ওপর রক্ত লেগেছে ওনার এ পর্যন্ত। কিন্তু ওনার সিডেশন (Sedation) কমিয়ে দিলে উনি জেগে উঠবেন, মানুষ চিনতে পারবেন। কিন্তু আস্তে আস্তে উনি যদিও একের পর এক ব্যাটল উইন করছেন, ওনার বডি ইজ লুজিং দ্য আল্টিমেট ওয়ার।
৫. একটি কথা না বললেই নয়—ওনার ব্যক্তিগত চিকিৎসা সমন্বয়ক অধ্যাপক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন বেগম জিয়ার জন্য একটা ড্রিম মেডিকেল টিম দাঁড় করিয়েছেন। দেশি-বিদেশি ডাক্তার, দরকারি সব স্পেশালিটির ডাক্তারকে একসাথে জড়ো করেছেন। আমি আবার বলছি—এর চেয়ে ভালো কোনো টিম হতে পারতো না, কোনো সিচুয়েশনেই! প্রত্যেকটা সমস্যার সুপার-স্পেশালাইজড যাকে দরকার, তাকে পৃথিবীর যে কোণায় পেয়েছেন নিয়ে এসেছেন মেডিকেল বোর্ডে। যেমন ধরুন শুধু হার্ট সার্জন হলে হবে না, এওর্টিক ভাল্ভ রুট-এর স্পেশালাইজড হার্ট সার্জন লাগবে—উনি ঠিকই এওর্টিক রুট সার্জন নিয়ে এসেছেন (একজনের জায়গায় চারজনকে), পৃথিবীর টপ সেন্টারগুলো থেকে! এবং এই টিম এরসদস্যরা ওনাদের সব শক্তি, মেধা আর সিনসিয়ারিটি দিয়ে দিন রাত পাগলের মতো খেটে যাচ্ছেন বেগম জিয়াকে সুস্থ করে তোলার জন্য! ওদের কাছে জাতি আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবে!
৬. এবার সবচেয়ে কঠিন কথাটা বলি। আমার ১৬ বছরের পড়াশোনা আর ২৪ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে একটা কথা কনফিডেন্স নিয়েই বলতে পারি—মেডিকেল পার্সপেক্টিভে খালেদা জিয়া আর সুস্থ হওয়ার অবস্থায় নেই। এ যাত্রা ওনার সুস্থ হয়ে ওঠার মেডিকেল প্রোবাবিলিটি শূন্য। এটার মূল ইমিডিয়েট কারণ অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স। আমাদের দেশে অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার করে—প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে দীর্ঘদিন ধরে একাধিক অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করে—প্যান-রেজিস্ট্যান্স অ্যান্টিবায়োটিকের একটা মহামারির মতো অবস্থা হয়েছে। দেশে এখন কিছু ব্যাকটেরিয়া আছে যা সব অ্যাভেইলেবল অ্যান্টিবায়োটিকের বিপরীতে রেজিস্ট্যান্ট। এই ধরনের ব্যাকটেরিয়া খালেদা জিয়ার মতো জটিল রোগীকে অ্যাটাক করলে এই যুদ্ধে ফাইট করার মতো কোনো অস্ত্র আর হাতে থাকে না।
৭. স্পর্ধা করেই বলি—চিকিৎসক হিসেবে, চিকিৎসা বিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে—এবার বেগম জিয়াকে একটু রেহাই দেই আমরা। ওনার যতদিন আয়ু আছে—দিন, সপ্তাহ, মাস, জানি না, আল্লাহই শুধু জানেন—সেই বাকি কয়টা দিন ওনাকে একটু কমফোর্ট দেই। আর টেস্টিং না, আর প্রসিডিউর না, আর এন্ডোস্কোপি না, আর ইআরসিপি না, আর রক্ত টানাটানি না! ওনাকে এবার একটু রেস্ট দেই।
Soldier, rest! thy warfare o’er,
Dream of fighting fields no more:
Sleep the sleep that knows not breaking,
Morn of toil, nor night of waking.
— The Soldier's Rest, by Sir Walter Scoবাaa
লেখক: রুমি আহমেদ
ব্লগার, শিক্ষাবিদ, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক; অধ্যাপক, ডেল মেডিকেল স্কুল,
ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস অস্টিন।