তফসিল ঘোষণার পর জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনার সামগ্রিক দায়িত্বে থাকে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। পাশাপাশি নির্বাচনকেন্দ্রিক বিভিন্ন প্রস্তুতি ও ভোটগ্রহণ সম্পন্ন করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, জনপ্রশাসন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের। আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনায় নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিবসহ মুখ্য ভূমিকা পালনকারী এসব দপ্তরের নেতৃত্বে থাকা কর্মকর্তাদের প্রত্যেকেই বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) প্রশাসন ক্যাডারের ১৯৮২ ব্যাচের সদস্য। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে বিভিন্ন সময়ে এ ব্যাচের অনেক কর্মকর্তা এবং তাদের অধীনস্থ দপ্তরের কার্যক্রম নিয়ে বিতর্ক উঠেছে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে চুক্তির ভিত্তিতে নিয়োজিত জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোখলেস উর রহমানকে বদলি করা হয়। তিনি ছিলেন ৮২ ব্যাচের কর্মকর্তা। তিনি দায়িত্ব পালনকালে জনপ্রশাসনে নিয়োগ, পদোন্নতি ও বদলি নিয়ে নানা বিতর্ক উঠেছিল। জনপ্রশাসনসংশ্লিষ্ট অনেকে বলেছেন, প্রায় এক দশক আগে এ ব্যাচের কর্মকর্তারা অবসরে যাওয়া শুরু করলেও অন্তর্বর্তী সরকারের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে সখ্যের কারণে তারা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছেন।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, বিসিএস ৮২ ব্যাচের নিয়োগ শুরু হয় ১৯৮৩ সালের শেষের দিকে। দুই ধাপে পুরো নিয়োগ শেষ হয় ১৯৮৪-তে। এ ব্যাচে মোট কর্মকর্তা ছিলেন ১৯১ জন। তারা সচিব পদে নিয়োগ পাওয়া শুরু করেন ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর। ধীরে ধীরে প্রশাসনে তাদের আধিপত্য বিস্তৃত হয়। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের টানা চার মেয়াদেই তারা নিজেদের এ প্রভাব ধরে রাখেন।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গত বছর আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পরও প্রশাসন ক্যাডারের নিয়মিত ৮২ ব্যাচের প্রভাব বজায় রয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। বর্তমানে এ ব্যাচের ড. শেখ আব্দুর রশীদ মন্ত্রিপরিষদ সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়া, নির্বাচন কমিশনে আখতার আহমেদ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নাসিমুল গনি ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে মো. এহছানুল হক সিনিয়র সচিব হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। তারাও প্রশাসনের ৮২ ব্যাচের কর্মকর্তা। আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এসব দপ্তর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় থাকবে।
ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের প্রচার-প্রচারণার বিষয়ে এরই মধ্যে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে। নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পরও বিভিন্ন দলের প্রার্থীর দলীয় পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুন যত্রতত্র দেখা যাচ্ছে। বিষয়টি দেখভালের দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। তবে নির্বাচন কমিশন এ বিষয়ে সক্রিয় ভূমিকায় নেই বলে সম্প্রতি ইসিতে অভিযোগও জানিয়েছে একটি রাজনৈতিক দল।
নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন প্রশাসনের ৮২ ব্যাচের কর্মকর্তা আখতার আহমেদ। আসন্ন নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা প্রসঙ্গে তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘প্রজাতন্ত্রের একজন কর্মচারী হিসেবে আমি আমার দায়িত্বটাকেই বড় করে দেখি। আমার সামনে যে দায়িত্ব আছে, আমি সেটা পালন করছি। নির্বাচন কমিশন থেকে আমি যেটা বলতে পারব সেটা হচ্ছে নির্বাচন ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত। আমার এরিয়ায় আচরণবিধি পালনের বিষয়টি পড়ে। সেক্ষেত্রে রিটার্নিং অফিসার যারা আছেন তারা বিষয়টি নিশ্চিত করার চেষ্টা করছেন।’
নির্বাচনের আগে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সাধারণ মানুষ ও রাজনৈতিক দলগুলোর উদ্বেগ রয়েছে জানিয়ে এ বিষয়ে তার মতামত জানতে চাইলে আখতার আহমেদ বলেন, ‘আইন-শৃঙ্খলার ব্যাপারটা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলতে পারবে। সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ এবং নিরাপত্তার বিষয়টা ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের।’
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হয় ১১ ডিসেম্বর। পরদিনই ঢাকা-৮ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করার ঘোষণা দেয়া ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান হাদি নির্বাচনী প্রচারণায় নেমে গুলিবিদ্ধ হন এবং পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সিঙ্গাপুরে মারা যান। পাশাপাশি কাছাকাছি সময়ে দেশের বিভিন্ন জেলায় আরো কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা জনমনে উদ্বেগ তৈরি করেছে। আক্রমণের শিকার হয়েছে দেশের অন্যতম দুটি সংবাদপত্রের কার্যালয়। এমন পরিস্থিতিতে দেশের সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়ে অন্তর্বর্তী সরকার। প্রশ্ন ওঠে আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে আয়োজনে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ নিয়ে।
দেশের সামগ্রিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি দেখভাল করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব পদে কর্মরত রয়েছেন প্রশাসনের ৮২ ব্যাচের কর্মকর্তা নাসিমুল গনি। নির্বাচনের আগে দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির সার্বিক বিষয় নিয়ে জানতে তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে ফোনে পাওয়া যায়নি।
নির্বাচনের ভোটগ্রহণ ও ফলাফল তৈরির প্রক্রিয়ার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত থাকেন রিটার্নিং ও প্রিজাইডিং কর্মকর্তারা। এবার ৬৪ জেলার জেলা প্রশাসক এবং ঢাকা ও চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। নির্বাচনকালীন এসব কর্মকর্তা নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করলেও তারা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত হন।
সম্প্রতি ডিসি নিয়োগ নিয়ে বিতর্কের মুখে পড়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। মাঠ প্রশাসনে কাজের অভিজ্ঞতা সীমিত এমন তিনজন ইকোনমিক ক্যাডারের কর্মকর্তাকে ডিসি হিসেবে পদায়ন করা হয়। পাশাপাশি বিগত সরকারের আমলে বিতর্কে জড়িয়ে পড়া কর্মকর্তাদেরও কেউ কেউ ডিসি হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। এ কর্মকর্তারা নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্বে রয়েছেন। বর্তমানে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন মো. এহছানুল হক। তিনিও প্রশাসন ক্যাডারের ৮২ ব্যাচের সদস্য। সার্বিক বিষয়ে জানতে জনপ্রশাসন সচিবকে ফোন করা হলে তিনি সাড়া দেননি।
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া বণিক বার্তাকে বলেন, ‘নির্বাচনকালীন নির্বাচন কমিশনই প্রধান কর্তৃত্বশীল সংস্থা। নির্বাচনী দায়িত্বে নিয়োজিত সব কর্মকর্তা-কর্মচারী ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এ সময় কমিশনের নির্দেশনার অধীনেই কাজ করেন। ভোটগ্রহণ ও ফলাফল প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত প্রিজাইডিং অফিসার, সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার ও পোলিং অফিসাররা বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তর থেকে আসেন। রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং অফিসাররা প্রশাসনিকভাবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের আওতাভুক্ত হলেও নির্বাচনের সময় তারা সরাসরি নির্বাচন কমিশনের কাছে জবাবদিহি করেন। তবে তাদের চাকরির মূল্যায়ন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও ক্যাবিনেট ডিভিশনের মাধ্যমে হওয়ায় এসব দপ্তরের সহযোগিতা গুরুত্বপূর্ণ।’
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ও সাবেক নির্বাচন সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার বণিক বার্তাকে বলেন, ‘তফসিল ঘোষণার পর আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির যে অবনতি এবং বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের বিতর্কিত কর্মকাণ্ড দেখা যাচ্ছে, তা যদি নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তবে আসন্ন নির্বাচনে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বেই।’
তিনি আরো বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনের হাতে পর্যাপ্ত ক্ষমতা থাকলেই হলো না, ক্ষমতা প্রয়োগ করতে হবে। কেউ যদি ক্ষমতা প্রয়োগ করতে সাহসিকতা প্রদর্শন না করে এবং ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তা ব্যবহার না করে বা বিরত থাকে, তাহলে সে ক্ষমতার কোনো মূল্য নেই। নির্বাচন কমিশনের সুষ্ঠু নির্বাচন করার খাতিরে সব রকম ক্ষমতা আছে। এখন ব্যবস্থাপনা আর পরিচালনা এ দুটো বিষয়েই ওনাদের ক্ষমতা ব্যবহার করতে হবে।’
১৯৮২ ব্যাচের বিসিএস পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয় ওই বছরের মে মাসে। পরীক্ষা কার্যক্রম চলে ১৯৮৩ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত। ফল ঘোষণার পর ১৯৮৩ সালের অক্টোবর থেকে ১৯৮৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত নির্বাচিত প্রার্থীদের নিয়োগ দেয়া হয়। এ নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তারাই পরিচিত হন প্রশাসনের ৮২ ব্যাচ নামে। একই বছরের ডিসেম্বরে পাবলিক সার্ভিস কমিশন আরেকটি বিশেষ (অনিয়মিত) পরীক্ষা নেয়ায় পরবর্তী সময়ে আগের এ ব্যাচকে অনেকে ‘১৯৮২ নিয়মিত ব্যাচ’ বলেও উল্লেখ করেন। তাছাড়া ব্রিটিশ ও পাকিস্তান সুপিরিয়র সার্ভিসের ধাঁচে গৃহীত ১ হাজার ৬০০ নম্বরের পরীক্ষার মাধ্যমে নির্বাচিত বাংলাদেশের শেষ ব্যাচ ৮২। তাদের সবাই প্রায় এক দশক আগেই অবসরে গেছেন।
সার্বিক বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. শেখ আব্দুর রশীদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচন কমিশনের কাছে সবকিছু চলে যায় না। নির্বাচন কমিশন কেবল নির্বাচনসংশ্লিষ্ট বিষয়ে যা কিছু ইমপ্যাক্টফুল আছে, সেই বিষয়গুলো দেখাশোনা করেন। আর সরকারের বাকি নিয়মিত কাজগুলো চলতে থাকে। নির্বাচন কমিশন তার কাজ করে যাচ্ছে আর সরকারকে তার রেগুলার কাজগুলো চালিয়ে যেতে হবে। এর মধ্যে শৃঙ্খলা রক্ষা করার কাজটা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দেখে।’
দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে বিভিন্ন মহলের উদ্বেগ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, ‘আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি প্রতিদিন এক রকম থাকে না; এটি সারা জীবন ঐতিহাসিকভাবেই ইমার্জিং সিচুয়েশনের (উদ্ভূত পরিস্থিতি) ওপর নির্ভর করে। একটা ঘটনা ঘটলে তার প্রভাব চারদিকে পড়ে থাকে। তবে আমরা আশা করছি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে এবং সে রকম যেন থাকে, সেটি আমরা আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাচ্ছি।’