সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে বৃহস্পতিবার বাংলাদেশের জনপ্রিয় যুবনেতা শরিফ ওসমান হাদির মৃত্যুর পর দেশজুড়ে একাধিক শহরে সহিংস বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে।
গত সপ্তাহে ঢাকায় এক হত্যাচেষ্টা চলাকালে গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর গুরুতর আহত হন হাদি। সেই আঘাতের কারণেই তার মৃত্যু হয়েছে।
কে এই শরিফ ওসমান হাদি?
৩২ বছর বয়সি শরিফ ওসমান হাদি ছিলেন বাংলাদেশের ২০২৪ সালের ছাত্রনেতৃত্বাধীন গণঅভ্যুত্থানের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা। তিনি ‘ইনকিলাব মঞ্চ’-এর মুখপাত্র হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে (সম্ভাব্য সময় ফেব্রুয়ারি ২০২৬) ঢাকা-৮ আসন থেকে সংসদ সদস্য প্রার্থী হওয়ার প্রস্তুতিও নিচ্ছিলেন হাদি।
তিনি ভারতের তীব্র সমালোচক হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। বিশেষ করে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণঅভ্যুত্থানের পর ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর দেশটির বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার নিয়ে তিনি সরব ছিলেন।
কোথায়, কবে ও কিভাবে হাদির মৃত্যু হয়?
সিঙ্গাপুর কর্তৃপক্ষ ও ইনকিলাব মঞ্চ বৃহস্পতিবার (১৮ ডিসেম্বর) তার মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করে।
১২ ডিসেম্বর ঢাকায় হত্যাচেষ্টার শিকার হলে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে নেওয়া হয় হাদিকে। ঢাকার ব্যাটারিচালিত একটি অটোরিকশায় যাত্রাকালে একটি মোটরসাইকেলে আসা দুই হামলাকারী তাকে মাথায় গুলি করে। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়।
চিকিৎসকরা জানান, তার ব্রেইন স্টেম মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরপর ১৫ ডিসেম্বর তাকে সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালের নিউরোসার্জিক্যাল আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়।
সিঙ্গাপুরের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানায়, ‘চিকিৎসকদের সর্বোচ্চ চেষ্টা সত্ত্বেও হাদি তার আঘাতে মারা গেছেন।’
বৃহস্পতিবার গভীর রাতে ইনকিলাব মঞ্চ ফেসবুকে লিখেছে, ‘ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে আল্লাহ মহান বিপ্লবী ওসমান হাদিকে শহিদ হিসেবে কবুল করেছেন।’
শুক্রবার ঢাকার কেন্দ্রীয় শাহবাগ এলাকায় হাদির মরদেহ আসার অপেক্ষায় শোকাহত মানুষের ভিড় জমতে শুরু করে বলে ঢাকা থেকে জানান আল জাজিরার মওদুদ আহমেদ সুজন।
পরে ইনকিলাব মঞ্চ জানায়, তাদের সাবেক মুখপাত্রের মরদেহ বহনকারী গাড়ি শাহবাগের দিকে রওনা হয়েছে।
পরিবারের অনুরোধে মরদেহটি সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে নেওয়া হয়নি। সংগঠনটি জানায়, শনিবার সেখানে জানাজা অনুষ্ঠিত হবে।
গুলির ঘটনায় বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ কী পদক্ষেপ নিয়েছে?
১২ ডিসেম্বর হামলার পরই পুলিশ হামলাকারীদের ধরতে অভিযান শুরু করে। এ অভিযানে কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের পাশাপাশি র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) যুক্ত রয়েছে।
১৩ ডিসেম্বর পুলিশ ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজের স্থিরচিত্র প্রকাশ করে, যেখানে দুই সন্দেহভাজনকে দেখা যায়। তাদের গ্রেফতারে তথ্য দিলে ৫০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়।
সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, দুজনই কালো পোশাক ও চশমা পরিহিত। একজনের গায়ে কালো হুডি, অন্যজনের কালো শার্ট ও হাতে ঘড়ি।
বাংলাদেশের দৈনিক দ্য ডেইলি স্টার জানিয়েছে, এ ঘটনায় সংশ্লিষ্ট সন্দেহে পুলিশ ও বিজিবি এখন পর্যন্ত অন্তত ২০ জনকে গ্রেফতার করেছে। তবে তদন্ত এখনো চলমান।
হাদির মৃত্যুতে রাজনৈতিক নেতাদের প্রতিক্রিয়া
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনুস শোক প্রকাশ করে বলেন, হাদির মৃত্যু ‘জাতির জন্য অপূরণীয় ক্ষতি’।
তিনি টেলিভিশনে দেওয়া বক্তব্যে বলেন, ‘ভয়, সন্ত্রাস বা রক্তপাত দিয়ে দেশের গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা থামানো যাবে না।’
সরকার শুক্রবার জুমার নামাজের পর বিশেষ দোয়া এবং শনিবার অর্ধদিবস রাষ্ট্রীয় শোক পালনের ঘোষণা দেয়।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ফেসবুকে লেখেন, ‘ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ও ঢাকা-৮ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী শরিফ ওসমান হাদির মৃত্যুতে আমরা গভীরভাবে শোকাহত।’

জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এক বিবৃতিতে হাদির মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে তার পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানায়।
বিক্ষোভকারীদের প্রতিক্রিয়া কী?
হাদির মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার পর বৃহস্পতিবার থেকেই ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন এলাকায় সহিংস বিক্ষোভ শুরু হয়, যা শুক্রবারও অব্যাহত ছিল।
বিক্ষোভকারীরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও আইন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টাদের পদত্যাগ দাবি করছেন। তাদের অভিযোগ, হাদির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে কর্তৃপক্ষ। তারা হামলাকারীদের ফিরিয়ে আনার দাবিও জানাচ্ছেন, যাদের অনেকের ধারণা তারা ভারতে পালিয়ে গেছে।
ঢাকা থেকে আল জাজিরার সাংবাদিক তানভীর চৌধুরী জানান, ‘বিক্ষোভে মূলত শিক্ষার্থীরা অংশ নিচ্ছেন, তবে সমাজের নানা স্তরের মানুষ ও কিছু রাজনৈতিক দলের কর্মীরাও রয়েছেন।’
তিনি বলেন, ‘তাদের মূল স্লোগান— ‘ওসমান হাদির হত্যাকারীদের বিচার চাই’। তারা বলছেন, ‘দ্রুত বিচার না হলে আন্দোলন চলবে।’
একদল বিক্ষোভকারী ঢাকার কারওয়ান বাজারে প্রো-ভারতীয় সম্পাদকীয় নীতির অভিযোগ তুলে দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকার প্রধান কার্যালয়ের সামনে জড়ো হয়ে ভবনে ঢুকে পড়ে।
কিছু দূরে আরেকদল বিক্ষোভকারী দ্য ডেইলি স্টার ভবনে ঢুকে আগুন ধরিয়ে দেয়। পত্রিকাটি জানায়, সেখানে ২৮ জন সাংবাদিক ও কর্মী প্রায় চার ঘণ্টা আটকে ছিলেন।
পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে সেনাবাহিনী ও সীমান্তরক্ষী বাহিনী মোতায়েন করা হলেও তাৎক্ষণিকভাবে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করা হয়নি।
স্থানীয় গণমাধ্যম জানিয়েছে, চট্টগ্রামে ভারতের সহকারী হাইকমিশনের দিকেও বিক্ষোভকারীরা পাথর নিক্ষেপ করে।
২০২৪ সালের ছাত্র আন্দোলন কী নিয়ে ছিল?
২০২৪ সালের জুলাইয়ে সরকারি চাকরিতে প্রচলিত কোটা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নামে। এই ব্যবস্থায় ১৯৭১ সালের মুক্তিযোদ্ধাদের বংশধরদের জন্য কোটা সংরক্ষিত ছি।
আন্দোলন দমাতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কঠোর দমন-পীড়নের নির্দেশ দেন। পরে তিনি ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে পালিয়ে যান। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তথ্য অনুযায়ী, ওই দমন-পীড়নে প্রায় ১,৪০০ জন নিহত এবং ২০ হাজারের বেশি মানুষ আহত হন।
চলতি বছরের জুলাইয়ে আল জাজিরার অনুসন্ধানী ইউনিট এমন রেকর্ডিং প্রকাশ করে, যেখানে শেখ হাসিনাকে পুলিশকে ‘মারণাস্ত্র’ ব্যবহারের নির্দেশ দিতে শোনা যায়।
গত মাসে ঢাকার ট্রাইব্যুনাল শেখ হাসিনাকে মানবতাবিরোধী অপরাধে অনুপস্থিতিতে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ড দেয়। ভারত এখনো তাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে সম্মত হয়নি।
কেন ভারতের বিরুদ্ধে ক্ষোভ বেড়েছে?
শুক্রবার ঢাকা থেকে তানভীর চৌধুরী আল জাজিরাকে জানান, বিক্ষোভকারীদের মধ্যে তীব্র ভারতবিরোধী মনোভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তাদের অভিযোগ, নির্বাচন সামনে এলেই ভারত বাংলাদেশের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে এবং ভারতে আশ্রয় নেওয়া শেখ হাসিনা সেখান থেকে উসকানিমূলক বক্তব্য দিচ্ছেন।
হাদির মৃত্যুর পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেই দাবি করছেন, হামলাকারীরা ভারতে পালিয়ে গেছে। কিছু যুবনেতাও প্রকাশ্যে এই দাবি করছেন।

জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতা সারজিস আলম বলেন, ‘হাদি ভাইয়ের হত্যাকারীদের ভারত ফেরত না দেওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশের ভারতীয় হাইকমিশন বন্ধ থাকবে। এখন নয় তো কখনো নয়। আমরা যুদ্ধে আছি।’
ঢাকার বিমানবন্দর এলাকার বাসিন্দা ও বিএনপি-সংশ্লিষ্ট এক স্বেচ্ছাসেবক সংগঠনের কর্মী নাদিম হাওলাদার আল জাজিরাকে বলেন, হাদিকে ‘ভিন্নমত দমন করতে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা তার হত্যার প্রতিবাদে এবং ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছি।’
নাদিম হাওলাদার অভিযোগ করেন, ১৯৭১ সালের পর থেকে ভারত বাংলাদেশের ওপর অতিরিক্ত প্রভাব বিস্তার করেছে এবং গত ১৭ বছর ধরে শেখ হাসিনার শাসনকে সমর্থন দিয়েছে, যার সময় রাজনৈতিক দমন-পীড়ন ও হত্যাকান্ড ঘটেছে।
তিনি আরও দাবি করেন, হামলাকারীরা ভারতে পালিয়ে গেছে এবং ‘শেখ হাসিনা ও হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ীদের ফেরত না দেওয়া পর্যন্ত’ আন্দোলন চলবে।