Image description

গুমের অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের বিচারের জন্য গত ১ ডিসেম্বর সরকার ‘গুম প্রতিরোধ ও প্রতিকার অধ্যাদেশ-২০২৫ জারি করে। অর্ধমাসের মাথায় এই অধ্যাদেশ সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। সংশোধিত অধ্যাদেশে গুম প্রতিরোধ ও প্রতিকার ট্রাইব্যুনালে মামলা পরিচালনার জন্য পাবলিক প্রসিকিউটর নিয়োগের বিধান যুক্ত করা হচ্ছে। পাশাপাশি গুম হওয়া ব্যক্তি অন্যূন পাঁচ বছর ধরে গুম থাকলে এবং জীবিত ফিরে না এলে সেক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনাল ওই ব্যক্তিকে মৃত অনুমান করবেন এবং স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কারও আবেদনের ভিত্তিতে তাকে মৃত ঘোষণা করতে পারবেন মর্মে বিধান যোগ করা হচ্ছে। আজ বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে এই সংশোধনী পাস করার জন্য উত্থাপন করা হবে বলে সূত্র জানিয়েছে।

এদিকে, অধ্যাদেশের আলোকে সারা দেশের ৮টি বিভাগীয় শহরে ‘গুম প্রতিরোধ ও প্রতিকার ট্রাইব্যুনাল গঠিত হচ্ছে। এরই মধ্যে ট্রাইব্যুনাল গঠনের কাজ চূড়ান্ত করা হয়েছে। ট্রাইব্যুনাল গঠনের বিষয়টি গেজেট আকারে জারি করার জন্য গত সোমবার সরকারি প্রিন্টিং প্রেসে (বিজি প্রেস) পাঠানো হয়েছে। আজকের মধ্যে এই গেজেট জারি হওয়ার কথা রয়েছে।

আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের স্পেশাল কনসালট্যান্ট ব্যারিস্টার তানিম হোসেন শাওন কালবেলাকে বলেন, ‘আইন অনুযায়ী গুম কমিশন মানে এখন মানবাধিকার কমিশন। এই কমিশন গঠন করতে সময় লাগবে। এ কারণে সরকার গুম ট্রাইব্যুনালগুলোকে দ্রুত কার্যকর করতে চায়। সেজন্য আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেন, গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্বজনরা যাতে তাদের জীবিকা নির্বাহের জন্য গুম হওয়া ব্যক্তির সম্পদ ব্যবহার করতে পারেন, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে অর্থ উত্তোলন করতে পারেন, ওয়ারিশন সার্টিফিকেট পেতে পারেন—সেজন্য আইনটি সংশোধন করা হচ্ছে।

মূলত গুমের শিকার ব্যক্তির পরিবার ও স্বজনদের সহযোগিতার জন্য এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে গুমের শিকার হন শত শত মানুষ। বিরোধী মতের বহু মানুষকে তুলে নিয়ে বিচারবহির্ভূতভাবে অজ্ঞাত স্থানে আটক রাখার অভিযোগ ওঠে, সেইসব বন্দিশালার প্রতীকী নাম রাখা হয় ‘আয়নাঘর’। পরে অনেকে তাদের স্বজনদের কাছে ফিরেছেন। আবার আজও অনেকের সন্ধান মেলেনি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে এসব ‘গুমের’ ঘটনা তদন্তে দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর গত বছরের আগস্টে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠন করে সরকার। গত ডিসেম্বরে জমা দেওয়া কমিশনের প্রথম অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে বলা হয়, আওয়ামী লীগের শাসনামলে ‘গুমের নির্দেশদাতা’ হিসেবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া গেছে কমিশনের তদন্তে।

এসব ঘটনায় হাসিনা প্রশাসনের বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারও সম্পৃক্ততা পাওয়ার কথাও প্রতিবেদনে বলা হয়, যাদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল তারিক আহমেদ সিদ্দিক, ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (চাকরিচ্যুত) জিয়াউল আহসান এবং আওয়ামী লীগ শাসনামলে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা পুলিশ কর্মকর্তা মো. মনিরুল ইসলাম ও হারুন অর রশীদ। এসব ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর মধ্যে কার কী ভূমিকা ছিল, তা গত ৪ জুন জমা দেওয়া কমিশনের দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়।

সেখানে বলা হয়, গুমের বেশিরভাগ ঘটনাই ঘটেছে পুলিশ ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে। গুমের শিকার ব্যক্তি, তার পরিবারের সদস্য ও প্রত্যক্ষদর্শীরা পুলিশ, র্যাব এবং পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) ও কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটকে ‘মূল অপরাধী’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এর বাইরে প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর (ডিজিএফআই), জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা (এনএসআই) অধিদপ্তর ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার ‘সত্যতা’ পাওয়ার কথা বলেছে কমিশন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই বিভিন্ন ‘ব্ল্যাক সাইট’ পরিচালনা করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে, যার মধ্যে সবচেয়ে কুখ্যাত হচ্ছে ‘আয়নাঘর’, যেখানে বন্দিদের সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রেখে চরম নির্যাতন চালানো হতো।

পরে ওই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আওয়ামী লীগের শাসনামলে বিরোধী মতের লোকদের গুমের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধের দুই মামলা করা হয়। দুই মামলাতেই প্রধান আসামি করা হয় জুলাই অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। গুম করে র্যাবের টাস্কফোর্স ইন্টারোগেশনের (টিএফআই) গোপন সেলে বন্দি রেখে নির্যাতনের ঘটনায় শেখ হাসিনা, তার প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল তারিক আহমেদ সিদ্দিকসহ ১৭ জনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হয়। মানবতাবিরোধী অপরাধের মোট পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়েছে সেখানে। আর গুম করে ডিজিএফআইর জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেলে (জেআইসি) বন্দি রেখে নির্যাতনের ঘটনায় আরেক মামলায় শেখ হাসিনা, তারিক সিদ্দিকসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হয়। এ মামলাতেও মানবতাবিরোধী অপরাধের মোট পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়েছে। মামলা দুটিতে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নেওয়ার পর্যায়ে রয়েছে।

এরই মধ্যে গত ১ ডিসেম্বর সরকার গুমের অভিযোগের বিচারের জন্য ‘গুম প্রতিরোধ ও প্রতিকার অধ্যাদেশ-২০২৫’ নামে সুনির্দিষ্ট আইন তৈরি করে। এতে কাউকে গুম করে হত্যার দায়ে সর্বোচ্চ মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। অধ্যাদেশ জারির পর প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানান, এই আইনের ফলে ভবিষ্যতে কোনো সরকার বা কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থা দেশে গুমের রাজত্ব চালাতে পারবে না। কোনো গোপন আটক কেন্দ্র বা ‘আয়নাঘর’ আর তৈরি হবে না। অধ্যাদেশ অনুযায়ী, গুমকে চলমান অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। গোপন আটক কেন্দ্র, যা ‘আয়নাঘর’ নামে পরিচিত, স্থাপন ও ব্যবহারকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ ঘোষণা করা হয়েছে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে গুম-সংক্রান্ত অভিযোগ গ্রহণ ও তদন্ত করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি গুম প্রতিরোধ ও প্রতিকার নিশ্চিত করতে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, যা অভিযোগ গঠনের ১২০ দিনের মধ্যে বিচার সম্পন্ন করতে বাধ্য থাকবে।

অধ্যাদেশে ভুক্তভোগী, তথ্যদাতা ও সাক্ষীর নিরাপত্তা, ক্ষতিপূরণ এবং আইনগত সহায়তা নিশ্চিতে স্পষ্ট বিধান রাখা হয়েছে। গুম-সংক্রান্ত ঘটনায় কার্যকর পদক্ষেপ ও ভুক্তভোগী পরিবারের পুনর্বাসনের জন্য একটি বিশেষ তহবিল ও কেন্দ্রীয় তথ্যভান্ডার গঠনের ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। প্রেস সচিব তার বক্তব্যে উল্লেখ করেন, আগের সরকারের আমলে বাংলাদেশে গুমের সংখ্যা উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছিল। গঠিত গুম কমিশনে প্রায় ২ হাজার অভিযোগ এসেছে। তবে কমিশনের সদস্যদের হিসাবে প্রকৃত সংখ্যা ৪ হাজারেরও বেশি হতে পারে। দেশে অনেক মানুষ আছেন, যারা নিখোঁজ হওয়ার পর আর ফেরেননি। আবার কেউ কেউ ফিরে এসেছেন। বিএনপির অনেক কর্মী এখনো ফিরে আসেননি। এই বাস্তবতাই আইনটিকে জরুরি করে তুলেছে। তিনি আরও জানান, অধ্যাদেশটি প্রণয়নের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আইনি মানদণ্ড অনুসরণ করা হয়েছে। বাংলাদেশ গত বছরের ২৯ আগস্ট জাতিসংঘের ‘ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন ফর দ্য প্রোটেকশন অব অল পারসনস ফ্রম এনফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স’-এ যোগ দেয়। সেই কনভেনশনের নীতিমালা অনুযায়ীই এই আইনটি তৈরি করা হয়েছে।

‘অধ্যাদেশের সংশোধনী’

অধ্যাদেশের ধারা ১৩-এর উপধারা ৬-এর পরিবর্তন করা হচ্ছে। নতুন এই উপধারায় বলা হয়েছে, ‘ট্রাইব্যুনালে অভিযোগকারীর পক্ষে মামলা পরিচালনার জন্য কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে সরকার প্রয়োজনীয় সংখ্যক পাবলিক প্রসিকিউটর নিয়োগ করবে: তবে শর্ত থাকে যে, অভিযোগকারী বা ভুক্তভোগী ব্যক্তিগত উদ্যোগেও ট্রাইব্যুনালে আইনজীবী নিয়োগ করতে পারবেন; আরও শর্ত থাকে যে, যে ক্ষেত্রে কমিশন গঠিত হয় নাই, সে ক্ষেত্রে কমিশন গঠনপূর্বক এই বিষয়ে কমিশন কর্তৃক সুপারিশ না করা পর্যন্ত সরকার কমিশনের সুপারিশ ব্যতিরেকে পাবলিক প্রসিকিউটর নিয়োগ করতে পারবে বা ট্রাইব্যুনাল যেই জেলায় বা বিভাগে অবস্থিত সেই জেলা বা সেই বিভাগের বিভাগীয় সদর দপ্তরের জেলা/মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর বা অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটরকে ট্রাইব্যুনালের পাবলিক প্রসিকিউটরের অতিরিক্ত দায়িত্ব প্রদান করতে পারবে।’

এ ছাড়া অধ্যাদেশের ২৩ ধারার ৩, ৪ ও ৫ উপধারার সংশোধন করা হচ্ছে। সংশোধিত উপধারাগুলোতে বলা হচ্ছে, গুম হওয়া ব্যক্তির স্ত্রী বা তার ওপর নির্ভরশীল পরিবারের কোনো সদস্য কর্তৃক এই ধারার অধীন কার্যধারা শুরু করার ক্ষেত্রে কমিশনের অনুমতি গ্রহণ আবশ্যক হবে না: তবে শর্ত থাকে যে, ট্রাইব্যুনাল প্রয়োজন মনে করলে বিষয়টি যাচাই করার উদ্দেশ্যে কমিশনের প্রতিবেদন চাইতে পারবেন। সাক্ষ্য আইন ১৮৭২-এর ১০৮ ধারায় যা কিছু থাকুক না কেন, যে ক্ষেত্রে গুম হওয়া ব্যক্তি অন্যূন ৫ (পাঁচ) বছর ধরে গুম থাকলে এবং জীবিত ফিরে না আসে, সে ক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনাল ওই ব্যক্তিকে মৃত অনুমান করবেন এবং স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কারও আবেদনের ভিত্তিতে তাকে মৃত ঘোষণা করতে পারবেন। এই ধারার অধীন আবেদনপত্র, প্রত্যয়ন ও গুম সনদের ধরন ও পদ্ধতি প্রবিধান দ্বারা নির্ধারণ করা যাবে: তবে শর্ত থাকে যে, অনুরূপ প্রবিধান প্রণয়ন না হওয়া পর্যন্ত উক্ত বিষয়সমূহ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক নির্ধারিত হবে। ব্যাখ্যা—এই ধারার উদ্দেশ্য পূরণকল্পে ‘গুম হওয়া ব্যক্তি’ অর্থ সেই ব্যক্তি, যিনি গুম কমিশনের অনুসন্ধান কার্যক্রমে, অথবা অত্র অধ্যাদেশ বা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের অধীন দায়েরকৃত কোনো মামলায় গৃহীত তদন্ত প্রতিবেদনে বা প্রদত্ত রায়ে গুম হয়েছেন মর্মে সাব্যস্ত হয়েছেন এবং ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক এই ধারার অধীন আদেশ প্রদানের পূর্ব পর্যন্ত জীবিত ফিরে আসেনি এমন ব্যক্তিকে বোঝাবে।