রাজধানী ঢাকায় বসে বগুড়ার মাদ্রাসায় সুপার (সুপারিনটেনডেন্ট) নিয়োগ। ব্যাক ডেটে (প্রকৃত তারিখের বদলে আগের তারিখ উল্লেখ)Ñঅফিস আদেশ, সাজানো নিয়োগ বোর্ড, ভুয়া প্রার্থী আর পরীক্ষা ছাড়াই হয়েছে ফল। পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয়েছে দর কষাকষি করে ঘুষের লেনদেনে। সব মিলিয়ে একটি সুপার নিয়োগকে বেচাকেনার বাজারে পরিণত করেছেন মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা। কালবেলার অনুসন্ধানে উঠে এসেছে ডিজি প্রতিনিধি বগুড়ার ফাইল স্বাক্ষর করেছেন ঢাকায়। শুধু তাই নয়, অনুসন্ধান চলছে জানতে পেরে সেই ঘুষের টাকার আংশিক ফেরত দিয়ে বাতিল করেছেন নিয়োগ। হুমকি দিয়ে সুপারের কাছ থেকে নিয়েছেন ‘ঘুষ নেননি’ মর্মে লিখিত স্বীকারোক্তি।
কালবেলার অনুসন্ধানে নিয়োগ ঘিরে জালিয়াতির বিস্তর এমন আয়োজনের আরও বেশকিছু চমকপ্রদ তথ্য উঠে এসেছে। গত অক্টোবরে বগুড়ার গাবতলীর জয়ভোগা দাখিল মাদ্রাসায় সুপার পদে দেওয়া হয় এই নিয়োগ, যা সম্পন্ন হয়েছে রকেট গতিতে, মাত্র পাঁচ দিনে। এই নিয়োগে মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের (ডিজি) প্রতিনিধি ছিলেন সহকারী পরিচালক ড. ইসমাইল হোসেন। যার পরতে পরতে হয়েছে অনিয়ম-জালিয়াতি। জালিয়াতির এই ছকের সংশ্লিষ্ট সব তথ্যপ্রমাণ এবং ঘুষের টাকা নেওয়া ও পরে তার আংশিক ফেরত দেওয়ার প্রমাণ মিলেছে।
নথিপত্র বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সহকারী পরিচালক ইসমাইল হোসেন বগুড়ায় না গিয়ে ঢাকায় বসেই পাতানো নিয়োগ ‘পরীক্ষার’ ফল শিটে স্বাক্ষর করে নেন ৮ লাখ টাকা। তার নির্দেশে জালিয়াতিতে সহায়তা করে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নেন ৩ লাখ, আরও ৪ লাখ টাকা লেনদেন হয় বিভিন্ন স্তরে। এসব লেনদেনের তথ্যপ্রমাণ দেখে নিজেই ঘুষের টাকা নেওয়ার কথা কালবেলার কাছে স্বীকার করেছেন ইসমাইল। সব তথ্যপ্রমাণ কালবেলার হাতে আসার খবর জানতে পেরে সুচতুর ওই কর্মকর্তা ঘুষের টাকা ফেরত দেন, যার প্রমাণও কালবেলার হাতে এসেছে। কালবেলার অনুসন্ধান চলাকালীন ঘুষের সেই টাকা ফেরত এবং নিয়োগ সংক্রান্ত সব কাগজপত্রসহ জরুরিভাবে অধিদপ্তরে ডেকে আনেন সদ্য নিয়োগ দেওয়া সুপারকে। নিয়োগ সংক্রান্ত সব কাগজপত্র ইসমাইল লাল কালিতে কেটে নিয়োগ বাতিল করেন। সুপারকে হুমকি দিয়ে এই নিয়োগে কোনো ঘুষ লেনদেন হয়নি—এই মর্মে লিখিত নেন। এ বিষয়ে ভবিষ্যতে আর কোনো কথা না বলতেও সুপারকে হুমকি দেন।
এসব অভিযোগ নিয়ে মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরে গেলে অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন ড. ইসমাইল। কথা বলতে বলতে একপর্যায়ে টাকা নেওয়ার বিষয়টি কালবেলার কাছে স্বীকার করে বলেন, ‘আমি সেই টাকা ফেরত দিয়ে নিয়োগটি বাতিল করে দেব।’ এর দুদিন পর গত ২ ডিসেম্বর সুপারকে ঢাকায় ডেকে এনে এককভাবে সেই নিয়োগ বাতিল করে দেন ইসমাইল।
সাজানো নিয়োগ বোর্ডে রকেট গতিতে নিয়োগ: বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ, সুপার ও সহকারী সুপার পদে গত ৬ অক্টোবর নিয়োগ বন্ধ ঘোষণা করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এর পরদিন ৭ অক্টোবর খাতা-কলমে ইসমাইলকে ডিজি প্রতিনিধি মনোনয়ন দেখানো হয়। কিন্তু অফিস আদেশে প্রকৃত স্বাক্ষর হয় ১২ অক্টোবর তারিখের। মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষকেও ১২ অক্টোবর ডিজি প্রতিনিধির চিঠি দেওয়া হয়। অথচ চিঠি পাওয়ার এক দিন আগেই ১১ অক্টোবর তারিখে দেখানো হয়েছে সুপার পদে ভুয়া নিয়োগ বোর্ড। সুপার পদে নিয়োগের জন্য পাঁচ প্রার্থী আবেদন করেন বলে দেখানো হয়। যাদের মধ্যে তিনজনই আবার বর্তমানে অন্য মাদ্রাসার সুপার। আরেকজন মহসিন আলী, যার ইনডেক্স (আর২০২৪০৭৮)। অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, তিনি বগুড়ার আদমদীঘির এক মাদ্রাসার জীববিজ্ঞানের সহকারী শিক্ষক। অথচ সুপার পদে আবেদনের যোগ্যতা হিসেবে বলা হয়েছে, সহকারী মৌলভি হিসেবে ৯ বছর ও সহকারী সুপার পদে তিন বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে, যা তার নেই। অর্থাৎ অন্যের ইনডেক্স ব্যবহার করে ভুয়া একজনকে প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করানো হয়। এই নিয়োগে প্রার্থী মূলত ছিলেন একজন, যিনি ওই মাদ্রাসার বর্তমান সহকারী সুপার শাসম উদ্দীন। তাকেই সুপার পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এতে স্পষ্ট বোঝা যায় যে এটি ছিল একটি সাজানো নিয়োগ বোর্ড। ডিজি প্রতিনিধির অনুপস্থিতিতে পুরো নিয়োগের বিষয়টি দেখভাল করেন নিয়োগ কমিটির সদস্য ও গাবতলী উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা তারিকুল আলম। গত ১১ অক্টোবর সেই নিয়োগ ‘পরীক্ষা’, ১২ অক্টোবর নিয়োগপত্র প্রদান এবং ১৩ অক্টোবর যোগদান ও নিয়োগ অনুমোদন—সবই সম্পন্ন হয়েছে যেন রকেট গতিতে।
ফল শিটে ভয়াবহ জালিয়াতি: পুরো প্রক্রিয়াই জালিয়াতিতে পরিপূর্ণ এই নিয়োগে সবচেয়ে বড় জালিয়াতি হয়েছে কথিত পরীক্ষার ফল তৈরিতে। অধিদপ্তরের নিয়োগ নির্দেশনা অনুযায়ী, সুপার পদে ৫০ নম্বরের পরীক্ষা হওয়ার কথা। তার মধ্যে লিখিত ৩০, মৌখিক ৮ এবং সনদে ১২। কিন্তু জয়ভোগা মাদ্রাসার এই নিয়োগের ফল শিটে নম্বরের নির্ধারিত অনুপাত পাল্টে লিখিত ৩০, মৌখিক ১২ ও সনদে ৮ দেখানো হয়েছে। ভুয়া প্রার্থী মহসিন আলীকে ফলাফলে দ্বিতীয় হিসেবে দেখানো হয়েছে। আরেক প্রার্থী আব্দুল হালিম লিখিত পরীক্ষায় পাস না করলেও নেওয়া হয়েছে মৌখিক পরীক্ষা। নিয়ম অনুযায়ী, লিখিত ৩০ নম্বরের মধ্যে ১২ পেলে উত্তীর্ণ ধরা হয়। কিন্তু তিনি পেয়েছেন ১০, অর্থাৎ করেছেন ফেল। তারপরও মৌখিক পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে তার। শুধু তাই নয়, সনদের ক্ষেত্রেও মনগড়া নম্বর দেওয়া হয়েছে। পাঁচজনের মধ্যে তিনজনকে ৬, একজনকে ৭ এবং আরেকজনকে ৫ নম্বর দেওয়া হয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী, প্রথম বিভাগের জন্য ৩, দ্বিতীয় বিভাগের জন্য ২ এবং তৃতীয় বিভাগের জন্য ১ নম্বর দেওয়া হয়।
সুপার নিয়োগে কত নম্বরের পরীক্ষা হয়—জানতে চাইলে সহকারী পরিচালক ইসমাইল হোসেন তার দপ্তরে বসে কালবেলাকে বলেন, ‘আমি যতদূর জানি লিখিত ৩৫, মৌখিকে ৯ নম্বর, বাকিগুলো সনদে।’ অবশ্য এর কিছুক্ষণ পরই বলেন, ‘মৌখিকে ১২, সনদে ৮।’
একপর্যায়ে তিনি অনিয়মের কথা স্বীকার করে বলেন, ‘ব্যক্তিগত কারণে ওইদিন আমি বগুড়ায় যেতে পারিনি, তবে শিক্ষা কর্মকর্তাকে সেই দায়িত্ব দিয়েছিলাম। তিনিই এসব নম্বর দিয়েছেন।’
যদিও ইসমাইল হোসেনের এমন ভাষ্য মিথ্যা দাবি করে শিক্ষা কর্মকর্তা মো. তারিকুল আলম মোবাইল ফোনে কালবেলাকে বলেন, ‘নম্বর লিখেছেন ডিজি প্রতিনিধি।’
অবশ্য শিক্ষা কর্মকর্তা তারিকুলের দাবি, এই নিয়োগের সবকিছু বিধি মেনেই হয়েছে। তাহলে নিয়োগ বাতিল হলো কেন—এমন প্রশ্নে চুপ হয়ে যান তিনি। আর ঘুষ লেনদেনের বিষয়ে জানতে চাইলে মোবাইল ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।
ঘুষের দর কষাকষি, ইসমাইলের রেট দাঁড়ায় ৮ লাখে: অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্য বলছে, সুপার পদে নিয়োগ বন্ধ হওয়ার পর জয়ভোগা দাখিল মাদ্রাসায় সুপার নিয়োগটি দ্রুত ব্যাকডেটে সম্পন্ন করতে ডিজি প্রতিনিধির সঙ্গে যোগাযোগ করে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ। ওই অঞ্চলের এক অফিস সহায়কের মাধ্যমে প্রথমে দুই লাখ দিয়ে দরদাম শুরু হয়। প্রথম প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে ‘জ’ অদ্যাক্ষরের এক সহকারী পরিচালক ফের দর হাঁকান। তিনিও ব্যর্থ হন। ডিজি প্রতিনিধি এত ‘কম’ টাকায় এত ‘বড়’ ঝুঁকি নিতে নারাজ—এমন বার্তা আসার পর সর্বশেষ ইসমাইলের সঙ্গে ৮ লাখে নিয়োগে রফা হয়। টাকার বিষয়ে রফা হওয়ার পর ব্যাকডেটে নিয়োগ কীভাবে সম্পন্ন করা যায়, তা নিয়ে ডিজি প্রতিনিধির সঙ্গে কথা হয় তারিকুলের। সেভাবেই নিয়োগ পরীক্ষা ছাড়াই সুপার পদে ভুয়া ফল শিট তৈরি হয়। যাতে স্বাক্ষর করেন মাদ্রাসাটির ম্যানেজিং কমিটির (পরিচালনা পর্ষদ) সভাপতি ডা. মো. সিরাজুল ইসলাম, বিদ্যোৎসাহী সদস্য গোলাম রহমান, নিয়োগ বোর্ডের সদস্য সচিব ও ওই মাদ্রাসার শিক্ষক আকরাম বিন হমিদ, ডিজি প্রতিনিধি ইসমাইল হোসেন ও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা তারিকুল আলম।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নিয়োগ কমিটির সদস্য সচিব আকরাম বিন হামিদ দাবি করেন, ফলাফলে কীভাবে এমনটি হয়েছে তিনি তা জানেন না। তিনি বলেন, ‘ডিজি প্রতিনিধি এখানে এসেছিল, তার নাম ইসমাইল।’ মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা এই ইসমাইলের শারীরিক গঠন বা রং কোনোটি সম্পর্কেই সঠিক জবাব দিতে পারেনি আকরাম বিন হামিদ। এক পর্যায়ে এই নিয়োগ জালিয়াতি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ না করার অনুরোধ জানান।
আর ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি সিরাজুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, ‘আমি ডাক্তার, প্র্যাকটিস করি। নানা ব্যস্ততার কারণে সব কিছু মনে থাকে না। তারা সবকিছু ঠিকঠাক করে নিয়ে এসেছিলেন, আমি শুধু স্বাক্ষর করেছি।’
ঘুষের টাকা ফেরত, অবৈধ নিয়োগ অবৈধভাবে বাতিল: নিয়োগে অভাবনীয় এই জালিয়াতি নিয়ে কালবেলার অনুসন্ধানের খবর জানতে পেরে ঘুষের টাকা লেনদেনের বিষয়টি প্রকাশিত হওয়ার শঙ্কায় ঘুষের টাকা ফেরত দেন ডিজি প্রতিনিধি ইসমাইল হোসেন। সদ্য নিয়োগ পাওয়া সুপারকে গত ২ ডিসেম্বর ঢাকায় ডেকে এনে নিয়োগ কমিটির সিদ্ধান্ত ছাড়াই এককভাবে তার নিয়োগ বাতিল করেন। নিয়োগ বাতিলের পাশাপাশি সুপারকে ভয়ভীতি দেখিয়ে লিখিত নেন যে, তিনি চাকরির জন্য ঘুষ হিসেবে কোনো টাকা দেননি। প্রথমে সুপার রাজি হননি। এরপর তাকে ভয়ভীতি দেখিয়ে লিখিত নেন। এক পর্যায়ে বিষয়টি নিয়ে কালবেলায় যদি প্রতিবেদন প্রকাশ হয়, তাহলে তার বিরুদ্ধে আরও কঠোর শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়। সেই হুমকি দেন ‘শ’ অদ্যাক্ষরের এক উপপরিচালক। এমন পরিস্থিতিতে আতঙ্কিত হয়ে এ বিষয়ে প্রতিবেদন না করতে এই প্রতিবেদকের মোবাইল ফোনে কল করে অনুরোধ জানান ওই সুপার। মাদ্রাসাটিতে সুপার পদে নিয়োগ বাতিলের আদেশের একটি অনুলিপি এসেছে কালবেলার হাতে। সেখানে মূল খাতায় নিয়োগ-সংক্রান্ত রেজুলেশন লাল কালি দিয়ে কাটা হয়েছে। সেটি করতে গিয়ে ২০২৩ সালে অন্য একটি কর্মচারী নিয়োগের রেজুলেশনও কেটে দেন ওই কর্মকর্তা।
এমপিওভুক্ত মাদ্রাসার নিয়োগবিধি অনুযায়ী, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিয়োগ হয় পরিচালনা পর্ষদের মাধ্যমে। অর্থাৎ নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ মাদ্রাসার পরিচালনা কমিটি। নিয়োগ বাতিল করার অধিকার রাখে মাদ্রাসার পরিচালনা কমিটি। ক্ষেত্রবিশেষ তদন্ত সাপেক্ষে কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ বা মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক নিয়োগ বাতিল করতে পারেন। আর সুনির্দিষ্ট অভিযোগ তদন্তে প্রমাণিত হওয়ার পর মাদ্রাসার পরিচালনা কমিটি নিয়োগ বাতিল করে। অথচ ইসমাইল হোসেন নিজেকে রক্ষায় জয়ভোগা দাখিল মাদ্রাসার অবৈধ নিয়োগটি নিজেই লাল কালিতে বাতিলও করেছেন, যা সম্পূর্ণ অবৈধ। এমন পরিস্থিতিতে তার বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষ প্রশাসনিক ব্যবস্থা ছাড়াও ফৌজদারি অপরাধে মামলা করতে পারেন ভুক্তভোগী।
মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরে ‘তদন্ত সিন্ডিকেট’: মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরে ড. ইসমাইল হোসেনসহ অধিদপ্তরের কয়েকজন কর্মকর্তার নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী ‘তদন্ত সিন্ডিকেট’-এর অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছে কালবেলা। টাকার বিনিময়ে যেন চলে তদন্তের খেলা। টাকা পেলে আগে সিদ্ধান্ত, পরে চাহিদামতো তৈরি হয় তদন্ত প্রতিবেদন। আর ঘুরেফিরে এসব তদন্তের দায়িত্ব ভাগাভাগি হয়ে থাকে তিন-চারজনের মধ্যেই। যারা টাকার বিনিময়ে অবৈধ নিয়োগকে বৈধ এবং বৈধ নিয়োগকে অবৈধ দেখিয়ে প্রতিবেদন জমা দেন। এমন একটি ঘটনায় রংপুরের কুতুবপুর সদরা আমিনিয়া সিনিয়র আলিম মাদ্রাসার অধ্যক্ষ নিয়োগ-সংক্রান্ত হাইকোর্টের রায় ও আইন শাখার মতামত অগ্রাহ্য করে ভুয়া তদন্ত প্রতিবেদন দিয়ে অধ্যক্ষের ইনডেক্স কর্তন করা হয়েছে। পটুয়াখালীর মরিচবুনিয়া নেছারিয়া ইসলামিয়া আলিম মাদ্রাসার স্থগিত হওয়া নিয়োগকে বৈধতা দিয়ে দেওয়া হয়েছে তদন্ত প্রতিবেদন। এই দুই মাদ্রাসার তদন্ত প্রতিবেদনের ক্ষেত্রে বড় অঙ্কের আর্থিক লেনদেন হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এই দুই মাদ্রাসার তদন্তকারী কর্মকর্তাও ড. ইসমাইল।
একাধিক ভুক্তভোগীর ভাষ্য, অধিদপ্তরে প্রেষণে আসা ক্যাডার কর্মকর্তাদের মাধ্যমে হয়রানির শিকার হচ্ছেন নন-ক্যাডার কর্মকর্তারা। আইন লঙ্ঘন করে তাদের মূল পদ থেকে অন্যত্র পদায়ন করে ‘নিজেদের লোক’ সব গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় বসিয়েছে ইসমাইল সিন্ডিকেট।
জয়ভোগা মাদ্রাসার সদ্য নিয়োগ পাওয়া সুপার শামস উদ্দীন কালবেলাকে বলেন, ‘আমার নিয়োগ কেন বাতিল করেছে সেটি আমি জানি না। সাদা কাগজে আমার কাছ থেকে লিখিত নিয়েছে, সেখানে কি লেখা সেটিও আমি জানি না। নিয়োগ বোর্ডে কে ছিল, কে ছিল না, সেটা দেখার দায়িত্ব তো আমার না। আমি একজন প্রার্থী হিসেবে অংশ নিয়েছি, নিয়োগ বোর্ড আমাকে নিয়োগ দিয়েছে।’
ঘুষ লেনদেন ও আংশিক ফেরতের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি চুপ হয়ে যান। বারবার জিজ্ঞেস করলেও এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
সার্বিক বিষয়ে মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) হাবিবুর রহমান কালবেলাকে বলেন, ‘যেহেতু আমার অফিসার সেই নিয়োগ বোর্ডে যায়নি, তাই শাস্তি হিসেবে তাকে ডেস্ক থেকে সরিয়ে দিয়েছি। তবে এই নিয়োগে ওই মাদ্রাসার বেশি চাপ ছিল।’
সুপার নিয়োগে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাননি। এমন গুরুতর অপরাধের শাস্তি হিসেবে শুধু ডেস্ক পরিবর্তন কতটুকু যুক্তিসংগত জানতে চাইলে মহাপরিচালক বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে তাকে এটা করা হয়েছে।’