Image description

চট্টগ্রাম বন্দর বাংলাদেশের অর্থনীতির লাইফলাইন এবং বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রধানতম প্রবেশদ্বার। দেশের আমদানি-রপ্তানির প্রায় ৯০ শতাংশই এই বন্দরের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। তবে এই বন্দরের আধুনিকায়ন এবং পরিচালনার দায়িত্ব বিদেশি অপারেটরের হাতে দেওয়া নিয়ে বর্তমানে দেশজুড়ে এক গভীর বিতর্ক চলছে। একদিকে যেমন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা সক্ষমতা ধরে রাখতে দ্রুত আধুনিকায়ন জরুরি, অন্যদিকে তেমনি জাতীয় সার্বভৌমত্ব হারানোর আশঙ্কা থেকে সৃষ্টি হয়েছে ব্যাপক আন্দোলন ও অস্থিরতা।

এই প্রবন্ধে দেশের অর্থনীতির স্বার্থে চট্টগ্রাম বন্দরের আধুনিকায়নের অপরিহার্যতা, বিদেশি অপারেটরের মাধ্যমে পরিচালনার যৌক্তিকতা এবং এই প্রসঙ্গে সৃষ্ট ‌‘নিয়ন্ত্রণ বনাম পরিচালনা’ বিতর্কের আইনি ও রাজনৈতিক বিশ্লেষণ করব। মূল লক্ষ্য-বিদেশি অপারেটর নিয়োগের সিদ্ধান্তকে জাতীয় স্বার্থ ও অর্থনৈতিক মুক্তির দৃষ্টিকোণ থেকে মূল্যায়ন করা।

বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশের জন্য চট্টগ্রাম বন্দর অর্থনৈতিক আশীর্বাদ হলেও এর সক্ষমতা বৃদ্ধিতে প্রযুক্তি ও দক্ষতার ঘাটতি রয়েছে। আমাদের অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা, আধুনিক সাপোর্টের অভাব এবং দক্ষ জনবলের ঘাটতি বন্দরকে আন্তর্জাতিক মানে নিয়ে যাওয়ার পথে বড় চ্যালেঞ্জ।

এই প্রেক্ষাপটে বিশ্বসেরা প্রতিষ্ঠানকে পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া একটি অপরিহার্য পদক্ষেপ, যা বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করবে।

বন্দর ইজারা দেওয়ার যৌক্তিকতা তুলে ধরে সরকার বারবার যে কারণগুলো বলছে, তা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষারই প্রতিফলন।

সরকারের মূল লক্ষ্য হলো দক্ষতা বৃদ্ধি ও আধুনিকায়ন। সরকার মনে করে, বিশ্বসেরা প্রতিষ্ঠানগুলো (যেমন ডিপি ওয়ার্ল্ড, মায়েরস্ক, পিএসএ) তাদের প্রযুক্তি ও ব্যবস্থাপনা দক্ষতা নিয়ে এলে পণ্যের দ্রুত হ্যান্ডলিং সম্ভব হবে এবং জাহাজের টার্ন-অ্যারাউন্ড টাইম কমে আসবে, যা বন্দরের দক্ষতা বিশ্বমানের বন্দরে উন্নীত করবে।

এছাড়াও, বন্দর সম্প্রসারণ ও নতুন টার্মিনাল নির্মাণে (যেমন বে-টার্মিনাল, লালদিয়া) বিপুল অর্থের প্রয়োজন। এই প্রকল্পগুলোতে বিদেশি অপারেটরদের বিনিয়োগের মাধ্যমে সরকারের তহবিল ব্যবহার না করেই অবকাঠামো নির্মাণ সম্ভব হবে। সবমিলিয়ে, ২০৩০ সালের মধ্যে বন্দরের কনটেইনার হ্যান্ডলিং সক্ষমতা কয়েক গুণ বাড়িয়ে ৭৮ লাখ ৬০ হাজারে উন্নীত করে আঞ্চলিক বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থানকে শক্তিশালী করাই সরকারের পরিকল্পনা।

আন্দোলনকারীদের প্রধান উদ্বেগ হলো জাতীয় সার্বভৌমত্ব হারানোর আশঙ্কা। এই বিষয়ে সরকার ও নীতিনির্ধারকরা বারবার যে আশ্বাস দিয়েছেন, তা হলো-

বিদেশি অপারেটররা কেবল টার্মিনাল পরিচালনার দায়িত্ব পাবে। বন্দরের মালিকানা, ভূমি, এবং কৌশলগত নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণরূপে বাংলাদেশ সরকার বা বন্দর কর্তৃপক্ষের হাতেই থাকবে। নৌপরিবহন উপদেষ্টা স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন, বিদেশি অপারেটররা কেবল টার্মিনাল পরিচালনা করবে; কোনো কৌশলগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা অপারেটরের থাকবে না। এমনকি বন্দরের মাশুল (ট্যারিফ) এবং সার্ভিস চার্জের হারও সরকারই নির্ধারণ করবে, বিদেশি অপারেটররা নিজেদের ইচ্ছামতো তা বাড়াতে পারবে না।

এই বিশ্লেষণ থেকে স্পষ্ট যে, সরকার কেবল বন্দর পরিচালনার দায়িত্ব ইজারা দিচ্ছে, বন্দরের সার্বভৌমত্ব ইজারা দেওয়া হয়নি।

চুক্তির পদ্ধতি নিয়ে সরকার জানিয়েছে, তারা প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রের পরিবর্তে জিটুজি বা পিপিপি প্রক্রিয়ায় এপি-মুলার মায়েরস্ক, পিএসএ ইন্টারন্যাশনাল এবং ডিপি ওয়ার্ল্ড-এর মতো বিশ্বসেরা প্রতিষ্ঠানগুলো বাছাই করার দিকে মনোযোগ দিয়েছে।

বিশ্বের বহু দেশ দক্ষ কোম্পানিকে ইজারা দিয়ে সফলতা পেয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে উন্নত এবং এশিয়ার বাণিজ্যকেন্দ্রগুলোতে এই মডেল অত্যন্ত সফল প্রমাণিত হয়েছে, যা বাংলাদেশের জন্য একটি শক্তিশালী নজির।

সিঙ্গাপুর বন্দর (PSA International) এবং চীনের সাংহাই বন্দরের মতো বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় বন্দরগুলো দক্ষতা, প্রযুক্তিগত স্বয়ংক্রিয়তা এবং দ্রুততম টার্ন-অ্যারাউন্ড টাইমের জন্য পরিচিত। এই বন্দরগুলো প্রমাণ করেছে যে, বিশ্বমানের পরিচালনা ব্যবস্থা একটি দেশের অর্থনীতিকে কীভাবে গতিশীল করতে পারে। যদিও এই বন্দরগুলোর অনেকগুলো রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন, তবুও তাদের পরিচালন সংস্থাগুলো (যেমন সিঙ্গাপুরের PSA) বিশ্বের অন্যান্য দেশের বন্দরে (যেমন ভারতে) তাদের পরিচালনার দক্ষতা সরবরাহ করে। বাংলাদেশেরও সেই একই আন্তর্জাতিক মানের দক্ষতা অর্জন জরুরি, যা বিদেশি অপারেটরের মাধ্যমে সহজেই আনা সম্ভব।

ইউরোপের বৃহৎ বন্দর, যেমন নেদারল্যান্ডসের রোটেরডাম বা জার্মানির হ্যামবার্গ, বহু বছর ধরে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (PPP) মডেল ব্যবহার করে আসছে। সরকার এখানে বন্দরের মূল অবকাঠামো (নিয়ন্ত্রণ) বজায় রাখে, কিন্তু বেসরকারি বা আন্তর্জাতিক অপারেটরদের মাধ্যমে অত্যাধুনিক টার্মিনালগুলো পরিচালনা করা হয়। এই মডেল নিশ্চিত করেছে যে বন্দরের নিয়ন্ত্রণ রাষ্ট্রের হাতে থাকলেও, পরিচালনায় সর্বোচ্চ দক্ষতা ও প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে।

ভারতের জেএনপিটি (মুম্বাই) এবং ফিলিপাইনের ম্যানিলা বন্দরের মতো টার্মিনালগুলোতে বিদেশি অপারেটররা আসার ফলে সফলভাবে দক্ষতা বৃদ্ধি ও আধুনিকায়ন সম্ভব হয়েছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, বিদেশি অপারেটরদের অভিজ্ঞতা ও প্রযুক্তি আমদানি করে বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানো এই মুহূর্তে সবচেয়ে সাশ্রয়ী ও দ্রুত পথ।

শ্রমিক ছাঁটাইয়ের আশঙ্কার জবাবে বন্দর কর্তৃপক্ষ তথা সরকার আশ্বস্ত করেছে যে, বিদেশি অপারেটর নিয়োগের কারণে কারও চাকরি যাবে না। বরং তারা আন্তর্জাতিক মানের দক্ষতা অর্জন করবে। যেহেতু বন্দর পরিচালনার দায়িত্ব ইজারা দেয়ার মধ্য দিয়ে বন্দরের সার্বভৌমত্ব হুমকিতে পড়ছে না, সেহেতু এটি দেশের স্বার্থ ও লাভের জন্য একটি ভালো পদক্ষেপ। তবে তা কাউকে ফ্রিতে বা নামমাত্র মূল্যে দেওয়া যাবে না-চুক্তি হতে হবে সর্বোচ্চ রাজস্ব ভাগাভাগি নিশ্চিত করে।

তবুও বন্দরের কৌশলগত গুরুত্ব বিবেচনায় দুটি বিষয়ে সরকারকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। প্রথমত, এই ইজারা যেন এমন কোনো দেশ বা কোম্পানিকে না দেওয়া হয়, যাদের সাথে বাংলাদেশের ভৌগোলিক দ্বন্দ্ব বা সার্বভৌমত্বের থ্রেট আছে। শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটায় নিয়ন্ত্রণ হারানোর মতো ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে চুক্তি চূড়ান্ত করতে হবে।

দ্বিতীয়ত, সরকারের প্রতি আহ্বান-বন্দরের নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনার পার্থক্য এবং চুক্তির গুরুত্বপূর্ণ শর্তাবলী দেশের সকল মানুষের কাছে পরিষ্কারভাবে তুলে ধরার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। এতে অসচ্ছতা কেটে যাবে এবং মানুষ দেশের বাণিজ্যিক স্বার্থ অনুধাবন করতে সক্ষম হবেন।

অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে, দেশের সকল রাজনৈতিক দলের জন্য এটি অনুধাবন করা জরুরি যে, দেশের প্রধান অর্থনৈতিক লাইফলাইনকে ক্ষতিকারক রাজনৈতিক কর্মসূচির আওতার বাইরে রাখা আবশ্যক।

চট্টগ্রাম বন্দর-কেন্দ্রিক হাজার হাজার শিল্প-কারখানায় লক্ষ লক্ষ মানুষ কর্মরত। রাজনৈতিক কর্মসূচি বা সহিংসতায় বন্দরগামী সড়কপথ বন্ধ হলে, শুধু শ্রমিক বা ব্যবসায়ীরাই ক্ষতিগ্রস্ত হন না, বরং জাতীয় অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দেশের সকল রাজনৈতিক দলের উচিত বন্দর এবং বন্দর-কেন্দ্রিক বাণিজ্যিক সকল কাজকে ‘হরতাল ও অবরোধমুক্ত জোন’ হিসেবে ঘোষণা করার জন্য একটি রাষ্ট্রীয় তথা রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা। এটি দেশের অর্থনীতির জন্য একটি নৈতিক ও রাজনৈতিক অঙ্গীকার।

উপসংহারে বলা যায়, বন্দরের আধুনিকায়নের পদক্ষেপটি অত্যন্ত যৌক্তিক এবং অর্থনীতির জন্য অপরিহার্য। যেহেতু সরকার নিশ্চিত করেছে যে, বন্দরের সার্বভৌমত্ব দেশের কাছেই নিয়ন্ত্রণ থাকবে এবং শুধু বাণিজ্যিক বা বন্দর পরিচালনার দায়িত্ব ইজারা দেওয়া হবে, সেহেতু এটি দেশের অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত করার জন্য একটি সময়োপযোগী ও ভালো পদক্ষেপ। তবে, সরকারের উচিত হবে একদিকে বন্দরের কৌশলগত গুরুত্ব বিবেচনায় এই ইজারা যেন এমন কোনো দেশ বা কোম্পানিকে না দেওয়া হয়, যাদের সাথে বাংলাদেশের ভৌগোলিক দ্বন্দ্ব বা সার্বভৌমত্বের থ্রেট আছে এবং স্বচ্ছতা, কৌশলগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করে জনসম্মুখে প্রকাশের মাধ্যমে দ্রুত আধুনিকায়নের এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা, যাতে দেশের অর্থনৈতিক লাইফলাইন বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে না পড়ে। 

 এ এইচ এম ফারুক

লেখক : সাংবাদিক, লেখক, গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক