সুদানের আবেই অঞ্চলে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের আওতাধীন কাদুগলি লজিস্টিক বেসে সাম্প্রতিক ড্রোন হামলা আবারও স্মরণ করিয়ে দিয়েছে- বিশ্বশান্তি কোনো বিমূর্ত ধারণা নয়, এটি রক্ত, ত্যাগ ও সাহসের বিনিময়ে গড়ে ওঠে। দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় ছয়জন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীর শহীদ হওয়া শুধু একটি সামরিক ঘটনা নয়; এটি বাংলাদেশের জাতীয় মর্যাদা, আন্তর্জাতিক দায়িত্ববোধ এবং মানবিক অঙ্গীকারের এক গভীর বেদনাময় অধ্যায়।
এই নৃশংস হামলায় যারা প্রাণ দিয়েছেন, তারা প্রত্যেকে দেশের নিজ নিজ জেলার সন্তান হলেও, শেষ পর্যন্ত তারা হয়ে উঠেছেন বিশ্বমানবতার প্রতিনিধি। করপোরাল থেকে শুরু করে সহায়ক কর্মচারী-সবার আত্মত্যাগ প্রমাণ করে যে শান্তিরক্ষা কেবল অস্ত্রধারীদের কাজ নয়; এটি একটি সমন্বিত মানবিক মিশন, যেখানে প্রতিটি দায়িত্বই সমান গুরুত্বপূর্ণ। আহত শান্তিরক্ষীদের চিকিৎসা ও দ্রুত পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টা যেমন আশার বার্তা দেয়, তেমনি এই হামলা শান্তিরক্ষীদের নিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে ভাবারও অবকাশ তৈরি করে।
বাংলাদেশ আজ বিশ্বের শীর্ষ শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ হিসেবে পরিচিত। আর্থিক অবদান সীমিত হলেও মানবসম্পদের মাধ্যমে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশের ভূমিকা অনস্বীকার্য। ১৯৮৮ সালে মাত্র ১৫ জন পর্যবেক্ষক দিয়ে যে যাত্রা শুরু হয়েছিল, তা আজ ছয় হাজারের বেশি শান্তিরক্ষীর উপস্থিতিতে বিস্তৃত। গত তিন দশকের বেশি সময়ে বিশ্বের ৪০টিরও বেশি দেশে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা শান্তিরক্ষায় নিয়োজিত থেকেছেন। এই দীর্ঘ অভিযাত্রা কেবল সংখ্যার হিসাব নয়; এটি একটি দেশের নৈতিক অবস্থান ও আন্তর্জাতিক আস্থার প্রতিফলন।
শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের অবস্থান বারবার প্রথম ও দ্বিতীয় স্থানে থাকা কাকতালীয় নয়। এর পেছনে রয়েছে শৃঙ্খলা, পেশাদারত্ব, নিরপেক্ষতা এবং মানবিক আচরণের এক অনন্য মিশ্রণ। যুদ্ধবিধ্বস্ত জনপদের সাধারণ মানুষ- হোক তা আফ্রিকার জঙ্গল, মধ্যপ্রাচ্যের মরুভূমি কিংবা ইউরোপের তুষারাচ্ছন্ন অঞ্চল- বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের দেখেছে ভরসার প্রতীক হিসেবে। অস্ত্রের পাশাপাশি চিকিৎসা, ত্রাণ, পুনর্বাসন ও সামাজিক স্থিতিশীলতায় তাঁদের অবদান স্থানীয় জনগণের মন জয় করেছে।
বিশ্বশান্তির এই পথে বাংলাদেশকে চরম মূল্যও দিতে হয়েছে। এখন পর্যন্ত ১৬৮ জন শান্তিরক্ষী প্রাণ দিয়েছেন, শত শত আহত হয়েছেন। প্রতিটি শহীদের নামের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে একটি পরিবারের আজীবন বেদনা, একটি জনপদের নীরব গর্ব। এই আত্মত্যাগ জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা ইতিহাসে বাংলাদেশের নামকে শুধু বড় করেনি, করেছে গৌরবময়।
বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, শান্তিরক্ষা মিশনে নারী সদস্যদের অংশগ্রহণ ক্রমেই বাড়ছে। শত শত নারী শান্তিরক্ষী ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে প্রমাণ করেছেন—শান্তিরক্ষা লিঙ্গনিরপেক্ষ মানবিক দায়িত্ব। এটি বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর প্রগতিশীল মানসিকতারও প্রতিফলন।
সুদানের ঘটনাটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য একটি সতর্ক সংকেত। শান্তিরক্ষীরা আজ যে ধরনের আধুনিক হুমকির মুখোমুখি—ড্রোন হামলা, সশস্ত্র মিলিশিয়া, অস্থিতিশীল রাষ্ট্রব্যবস্থা—তা মোকাবিলায় জাতিসংঘকেও নতুন করে কৌশল ভাবতে হবে। শান্তিরক্ষীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে বিশ্বশান্তির কথা বলা আত্মপ্রবঞ্চনা ছাড়া কিছু নয়।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী মহান মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষা—সব ক্ষেত্রেই পেশাদারত্ব ও আত্মত্যাগের নজির স্থাপন করেছে। সুদানে শহীদ ছয় শান্তিরক্ষীর রক্ত সেই ধারাবাহিকতারই অংশ। তাদের আত্মদান স্মরণ করিয়ে দেয়—শান্তি কখনো বিনামূল্যে আসে না, আর বাংলাদেশ সেই মূল্য দিতে কখনো পিছপা হয়নি।
আজ প্রয়োজন শুধু শোক নয়, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, নিরাপত্তা জোরদার এবং শান্তিরক্ষীদের সম্মান রক্ষার দৃঢ় অঙ্গীকার। কারণ লাল-সবুজের পতাকা কেবল বাংলাদেশের আকাশেই নয়, উড়ছে বিশ্বশান্তির প্রতিটি ঝুঁকিপূর্ণ প্রান্তরে।