গত ৫ আগস্ট ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানে পতন ঘটে স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার, অবসান ঘটে দীর্ঘ ১৬ বছরের ঘনঘোর এক ফ্যাসিবাদের। জনতার স্রোত গণভবনমুখী হলে প্রাণ ভয়ে দেশ ছাড়েন হাসিনা, সামরিক বিমানে করে পালিয়ে যান ভারতের দিল্লিতে। এরপর থেকে নরেন্দ্র মোদির আতিথ্যে ভারতেই ফেরারি জীবনযাপন করছেন তিনি।
জুলাই অভ্যুত্থানে প্রায় দু' হাজার মানুষ শাহাদাত বরণ করেন, আহত হন অন্তত ৫০ হাজার মানুষ। আহতদের অনেকেই পুলিশের গুলিতে হাত-পা হারান, অনেকে চিরতরে হারিয়ে ফেলেন দৃষ্টিশক্তি। আন্দোলনকারী ছাত্রজনতার পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটে হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে। আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী শাসনের প্রধান দুই স্তম্ভ - মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও শেখ মুজিবুর রহমান - তাদের ওপর এই আক্রোশের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। সারা দেশে মুজিবের যত ভাস্কর্য, ম্যুরাল ও নামফলক আছে সব কিছুর ওপর ক্ষোভ ঝাড়ে সাধারণ মানুষ - ভাঙচুর করা হয় এসব। বিজয় সরণীতে জনগণের ট্যাক্সের শত শত কোটি টাকা খরচ করে বানানো শেখ মুজিবের সুবিশাল ভাস্কর্য দড়ি বেঁধে ফিল্মি কায়দায় টেনে নামায় জনতা। এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের কথিত চেতনার বিরুদ্ধে ঘৃণা জানান দিতে বিভিন্ন এলাকায় আওয়ামী লীগের সাথে সম্পর্কযুক্ত ভাস্কর্য ভাঙচুর করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, ঢাকার কেরানীগঞ্জের কদমতলীতে অবস্থিত নূর ইসলাম কমান্ডারের ভাস্কর্য ভাঙচুর করা হয় - কারণ নূর ইসলাম ছিলেন আওয়ামী লীগ থেকে 'নির্বাচিত' উপজেলা চেয়ারম্যান শাহীন আহমেদের শ্বশুর।
তবে, বরাবরের মতোই পতিত ফ্যাসিস্টের সাংস্কৃতিক উইং শুরু করে প্রোপাগান্ডা ও মিথ্যাচার।জনতার স্বতঃস্ফূর্ত ক্ষোভ থেকে এসব ভাঙচুরের ঘটনা ঘটলেও অভ্যুত্থানের এক মাস পেরুনোর আগেই দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি জাতীয় দৈনিক সহ বিভিন্ন মিডিয়া হাউজ একে 'মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য ভাঙচুর' হিসেবে ফ্রেমিং করতে থাকে। এসব ঘটনাকে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার ওপর আঘাত বলে দাবি করে সেসব ধ্বংসপ্রাপ্ত ভাস্কর্য সংস্কারের জন্য সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে শুরু করে। এসব ঘটনায় অংশ নেয়া আন্দোলনকারী জনতার বিরুদ্ধে মামলা করার দাবিও করে কেউ কেউ।
এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম দেশের একটি শীর্ষস্থানীয় জাতীয় দৈনিককে বলেছেন, "মামলা করার পরিবেশ তখন ছিল না। এখন দেরি হয়ে গেছে। তবে কেউ যদি মামলা করতে চায়, সরকার সহযোগিতা করবে।"
তার এ বক্তব্যে দেখা দিয়েছে নানা প্রতিক্রিয়া। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএর শিক্ষার্থী তাজরিয়ান আলম আয়াজ বলেন, "প্রতিটি ঐতিহাসিক ঘটনারই একটি নিজস্ব তাৎপর্য আছে। ধ্বংসপ্রাপ্ত এসব স্থাপনা বা ভাস্কর্য সংস্কার করে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা জুলাইয়ের বিক্ষুব্ধ জনতার প্রতি অন্যায় হবে - কারণ এসব ধ্বংসাবশেষ মূলত অভ্যুত্থানের চিহ্ন। বরং ধ্বংসপ্রাপ্ত অবস্থাতেই এগুলোকে সংরক্ষণ করা উচিত - যাতে পরবর্তী প্রজন্ম জানতে পারে - কীভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দোহাই দিয়ে জনগণকে দেড় দশক ধরে ফ্যাসিবাদের শেকলে বন্দি রাখা হয়েছিল, আর কীভাবে সেই জোরপূর্বক চাপিয়ে দেওয়া চেতনার বিরুদ্ধে ঘটেছিল গণবিস্ফোরণ।"
ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানের ম্যান্ডেট নিয়ে মসনদে বসা উপদেষ্টারা এই ব্যাপারে জোর গলায় বলতে পারছে না বলে বিরক্তি প্রকাশ করে তিনি বলেন, "পতিত ফ্যাসিস্ট শক্তির সফট পাওয়ার হিসেবে চিহ্নিত কিছু গণমাধ্যম দিনের পর দিন কাজ করেছে। তাদের সেউ ভূমিকা আজও বদলায়নি। ফলে তাদের সামনে পলিটিকাল কারেক্টনেস দেখানো কিংবা ক্ষমাপ্রার্থনার সুরে কথা বলা, এমনকি জুলাইয়ের ছাত্রজনতার বিরুদ্ধে মামলা করার কথা যারা বলছেন - তারা গণঅভ্যুত্থানের সরকারের অংশ হওয়ার নৈতিক ভিত্তি রাখেন না।