Image description
 

অন্যান্য পাকিস্তানি সাংবাদিকরা যা লিখতে বাধ্য হয়েছিলেন, মাসকারেনহাস তা করেননি। তিনি নিজের চোখে দেখা 'বর্বরতম পাশবিক নৃশংসতা’ এবং সেনা ছাউনিতে বসে অফিসারদের 'সারা দিনের শিকার' নিয়ে গর্ব করার কথাও তুলে আনেন।

 

১৯৭১ সালের ১৩ জুন, যুক্তরাজ্যের 'দ্য সানডে টাইমস' পত্রিকায় প্রকাশিত একটি মাত্র প্রতিবেদন বদলে দিয়েছিল দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস। পাকিস্তানি বাহিনীর পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) চালানো নিষ্ঠুর আক্রমণ বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরেছিল এ প্রতিবেদন। প্রতিবেদকের পরিবার তখন পালাতে বাধ্য হয়েছিল, আর এ প্রতিবেদনেই শুরু ইতিহাসের মোড় নেয়া পথচলা।

‘আবদুল বারীর ভাগ্য সেদিন প্রসন্ন ছিল না। পূর্ব বাংলার হাজারো মানুষের মতো তিনিও একটি মারাত্মক ভুল করেছিলেন— পাকিস্তানি টহল দলের দৃষ্টিসীমার মধ্যে দিয়ে দৌড়ানো। ২৪ বছর বয়সী শীর্ণকায় এ মানুষটিকে ঘিরে ফেলেছিল সৈন্যরা। ভয়ে কাঁপছিলেন আবদুল বারী। বুঝতেন পেরেছিলেন, তাকে গুলি করা হবে।‘

এই দৃশ্য দিয়ে শুরু হয় দক্ষিণ এশিয়ার গণমাধ্যমের ইতিহাসে এক অত্যন্ত প্রভাবশালী প্রতিবেদন। লেখক ছিলেন পাকিস্তানি সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাস। 'সানডে টাইমস' এ তার লেখা প্রথমবারের মতো দেখিয়েছে পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ‘ফাইনাল সলিউশন’–এর মতো গণহত্যার ব্যাপকতা।

 

মাসকারেনহাসের প্রতিবেদন বিশ্বমতকে ঘুরিয়ে দিয়েছিল। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী প্রকাশ্যে বলেছিলেন, ‘প্রতিবেদনটি আমাকে এতটাই স্তব্ধ করে দিয়েছিল যে, আমি ইউরোপ ও মস্কোতে ভারতীয় সামরিক হস্তক্ষেপের পথ প্রস্তুত করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি।‘

 

এ প্রতিবেদন প্রকাশের আগে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা বিদেশী সাংবাদিকদের পূর্ব পাকিস্তান থেকে এক প্রকার বেরই করে দিয়েছিল। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে মিডিয়া ব্ল্যাকআউটের কারণে বিশ্ব তখনো গণহত্যার ভয়াবহতা সম্পর্কে ছিল সম্পূর্ণ অন্ধকারে। পাকিস্তানি সেনারা বিদেশী সাংবাদিকদের পূর্ব পাকিস্তানে কয়েক দিনের সফরে নেয়, যাতে তারা দেখাতে পারে ‘মুক্তিদের’ বিরুদ্ধে তাদের বিজয়। আটজন সাংবাদিক সফরে যান, করাচির একজন সুপরিচিত সাংবাদিক হিসেবে সেখানে মাসকারেনহাসও ছিলেন।

অন্যান্য পাকিস্তানি সাংবাদিকরা যা লিখতে বাধ্য হয়েছিলেন, মাসকারেনহাস তা করেননি। তিনি নিজের চোখে দেখা 'বর্বরতম পাশবিক নৃশংসতা’ এবং সেনা ছাউনিতে বসে অফিসারদের 'সারা দিনের শিকার' নিয়ে গর্ব করার কথাও তুলে আনেন।

মাসকারেনহাসের স্ত্রী ইভোন স্মরণ করেন, ‘আমার স্বামীকে এমন বিপর্যস্ত অবস্থায় আগে কখনোই দেখিনি। মানসিক চাপে সম্পূর্ণ হতবাক। সে আমাকে বলেছিল, সে যা দেখেছে তা যদি লিখতে না পারে তবে আর কোনোদিন একটি শব্দও লিখতে পারবে না।‘

anthony

বইয়ের ফ্ল্যাপে অ্যান্থনি মাসকারেনহাস। ছবি- সংগৃহীত

মাসকারেনহাস জানতেন, তিনি যে বীভৎস গণহত্যা দেখে এসেছেন তা পাকিস্তানের কোনো পত্রিকায় প্রকাশ করা সম্পূর্ণ অসম্ভব। এ প্রতিবেদন প্রকাশ পেলে নিশ্চিতভাবেই প্রাণ হারাতে হবে তাকে।

একজন বস্তুনিষ্ঠ প্রতিবেদক হিসেবে সততার সঙ্গে নিজের দায়িত্ব পালন করেছিলেন সেদিন মাসকারেনহাস। অসুস্থ বোনকে দেখতে যাওয়ার নাম করে তিনি নিজের এবং পরিবারের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লন্ডন যান এবং সেখানে 'সানডে টাইমস'-এর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তারা যে হত্যাকাণ্ডকে ‘চূড়ান্ত সমাধান’ বলে বর্ণনা করত, সেই গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ তিনি তুলে ধরেন।

পরিবারের সুরক্ষার জন্য অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে স্ত্রীকে একটি সাংকেতিক বার্তা পাঠিয়ে তিনি নিজে আফগানিস্তান হয়ে দেশ ছাড়েন। লন্ডনে পরিবারের সঙ্গে আবার দেখা হওয়ার পরের দিনই প্রকাশিত হয় ঐতিহাসিক সেই প্রতিবেদন, যার শিরোনাম ছিল কেবল একটি শব্দ— 'গণহত্যা' (জেনোসাইড)।

এই প্রতিবেদন পাকিস্তানের চোখে ছিল চরম বিশ্বাসঘাতকতার নামান্তর। মাসকারেনহাসকে অভিযুক্ত করা হয় 'শত্রু এজেন্ট' হিসেবে। তবে মাসকারেনহাস পাকিস্তানি কর্মকর্তাদের সঙ্গে এতটাই ঘনিষ্ঠ ছিলেন যে, তার অভিজ্ঞতা ও চোখে দেখা ঘটনাগুলোর ব্যাপারে কেউ অবিশ্বাস করেনি। আর পাকিস্তান এখনো মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত গণহত্যার দায় অস্বীকার করে সেটিকে ভারতীয় প্রোপাগান্ডা বলে আখ্যা দেয়।

বাংলাদেশে আজও অ্যান্থনি মাসকারেনহাসকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে সেই প্রতিবেদন এখনো প্রদর্শিত। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক বলেছিলেন, ‘যখন আমাদের দেশ পুরো বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল, তখন এ প্রতিবেদনটিই বিশ্বকে এখানকার পরিস্থিতি সম্পর্কে জানাতে সাহায্য করেছিল।‘

মাসকারেনহাসের পরিবার লন্ডনে নতুন জীবন শুরু করে। ইভোন স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘সেখানে আমাদের জীবন ছিল করাচি থেকে একদমই ভিন্ন। পরিচিত তেমন কেউ ছিল না। আমরা হাসিখুশি থাকারই চেষ্টা করতাম। কিন্তু সিদ্ধান্ত নিয়ে কখনোই আফসোস করিনি।‘

 

বিবিসিতে ২০১১ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদন অবলম্বনে