ভারতীয় ভূখণ্ড থেকে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সমর্থকরা ‘বাংলাদেশ বিরোধী কর্মকাণ্ড’ চালাচ্ছেন। এ নিয়ে ঢাকা গুরুতর উদ্বেগের কথা জানিয়েছে ভারতকে। এ জন্য রোববার ঢাকায় ভারতের হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মাকে তলব করে বাংলাদেশ। ফলে দুই দেশের কূটনৈতিক উত্তেজনা বাড়ছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, পলাতক শেখ হাসিনা ও তার আওয়ামী লীগ অনুসারীরা বাংলাদেশে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনার নির্দেশ দিচ্ছেন। তারা বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন নিয়ে হুমকি দিচ্ছেন। এসব বিষয়ে হাইকমিশারের মাধ্যমে উদ্বেগের কথা দিল্লিকে জানানো হয়েছে। জবাবে নয়াদিল্লি বলেছে, ঢাকার স্বার্থবিরোধী কোনো কর্মকাণ্ডে ভারতীয় ভূখণ্ড কখনোই ব্যবহার করতে দেয়া হয়নি।
উল্লেখ্য, সম্প্রতি ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক ওসমান হাদিকে ঢাকায় ভয়াবহভাবে গুলি করা হয়েছে। তিনি এখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। বাংলাদেশের সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে এসব কথা লিখেছে আন্তর্জাতিক মিডিয়াগুলো। বিবিসি লিখেছে, ভারতের হাইকমিশনারকে তলব করে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার যেসব দাবি জানিয়েছে, তা প্রত্যাখ্যান করেছে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। রোববার দুপুরে ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মাকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কিছু দাবি তুলে ধরেন। এ সময় বাংলাদেশ সরকার কিছু বিষয়ে ভারতের কাছে উদ্বেগ তুলে ধরে। জবাবে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ১৪ই ডিসেম্বর ২০২৫ তারিখে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রেস নোটে দেয়া বক্তব্য স্পষ্টভাবে প্রত্যাখ্যান করছে ভারত। ভারতের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে একটি শান্তিপূর্ণ পরিবেশে অবাধ, সুষ্ঠু, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের জন্য ভারত সব সময়েই তার অবস্থান জানিয়ে আসছে। সেখানে আরও বলা হয়েছে, বন্ধুপ্রতিম বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কোনো কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য ভারত কখনোই তার ভূখণ্ড ব্যবহার করতে দেয়নি।
আমরা আশা করছি, বাংলাদেশে একটি শান্তিপূর্ণ নির্বাচন আয়োজনের লক্ষ্যে অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলার পরিস্থিতির জন্য প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ গ্রহণ করবে দেশটির অন্তর্বর্তী সরকার। এর আগে রোববার বিকালে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে অবস্থান করে বাংলাদেশে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে উস্কানির সুযোগ দেয়া এবং আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন বানচালের প্রচেষ্টার অভিযোগে ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মাকে তলব করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়, ভারতে অবস্থানরত শেখ হাসিনা তার সমর্থকদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়াতে আহ্বান জানিয়ে নিয়মিত উস্কানিমূলক বক্তব্য দিচ্ছেন। যা বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার জন্য গুরুতর হুমকি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এসময় শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে আদালতে দেয়া দণ্ডের মুখোমুখি করতে দ্রুত তাদের দেশে প্রত্যর্পণেরও আহ্বান জানায় বাংলাদেশ। বাংলাদেশি রাজনৈতিক নেতা শরীফ ওসমান হাদির ওপর সংঘটিত হত্যাচেষ্টায় জড়িত সন্দেহভাজনরা যেন পালিয়ে ভারতে আশ্রয় না নিতে পারে সে বিষয়েও ভারতের সহযোগিতা চাওয়া হয়।
বিবৃতিতে বলা হয়, এসময় ভারতীয় হাইকমিশনার বলেছেন, বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এমন প্রত্যাশা ভারতের রয়েছে এবং এ বিষয়ে সব ধরনের সহযোগিতাও দিতে তার দেশ প্রস্তুত। তুরস্কের বার্তা সংস্থা আনাদোলু লিখেছে, নির্বাচনকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টার অভিযোগের প্রেক্ষাপটে এক বাংলাদেশি রাজনৈতিক কর্মীকে হত্যাচেষ্টার ঘটনার পর রোববার ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনারকে তলব করেছে বাংলাদেশ। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভারত আশ্রয় দিয়ে আগামী ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচনকে দুর্বল করার সুযোগ দিচ্ছেন। এ নিয়ে গভীর উদ্বেগ জানানো হয়েছে। বাংলাদেশের নির্বাচন কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারপ্রধান মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে আগামী ১২ই ফেব্রুয়ারি জাতীয় নির্বাচন হবে। ২০২৪ সালের আগস্টে ব্যাপক গণ-আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনের পতনের পর এই অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, ওই গণ-অভ্যুত্থানে প্রায় ১৪০০ মানুষ নিহত হন। এরপর শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। এরপর থেকে শেখ হাসিনা ও তার দল আওয়ামী লীগ নির্বাচনসংক্রান্ত রোডম্যাপ প্রত্যাখ্যান করে আসছে। তারা এটিকে অবৈধ বলে দাবি করছে এবং প্রতিরোধের ঘোষণা দিয়েছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আরও উদ্বেগ প্রকাশ করে জানায়, বর্তমানে ভারতে অবস্থানরত পলাতক আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মীরা বাংলাদেশের ভেতরে সহিংসতা উস্কে দিচ্ছে এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে নির্বাচন প্রক্রিয়া ব্যাহত করার চেষ্টা করছে- এমন অভিযোগ রয়েছে। বাংলাদেশ সরকার সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক নেতা শরীফ ওসমান হাদিকে হত্যাচেষ্টার ঘটনায় জড়িত সন্দেহভাজনরা যেন ভারতে পালিয়ে যেতে না পারে, সে বিষয়ে ভারতের সহযোগিতা চেয়েছে। পাশাপাশি, যদি তারা ভারতীয় ভূখণ্ডে প্রবেশ করে, তবে তাদের দ্রুত আটক ও প্রত্যর্পণেরও দাবি জানানো হয়েছে। অন্যদিকে ইন্ডিয়া টুডে লিখেছে, রোববার বাংলাদেশ সরকারের অন্তর্বর্তী প্রশাসনের অভিযোগ দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে ভারত। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বাংলাদেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে কোনো কর্মকাণ্ড চালাতে ভারত কখনোই তার ভূখণ্ড ব্যবহার করতে দেয়নি। আগামী বছর বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক টানাপড়েন বাড়ছে।
এই প্রতিক্রিয়া আসে এমন এক সময়ে, যখন কয়েক ঘণ্টা আগে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মাকে তলব করে। বাংলাদেশ অভিযোগ করে, ভারতের মাটি থেকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেয়া উস্কানিমূলক বক্তব্য দেশটির রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি সৃষ্টি করছে। একই সঙ্গে বর্তমানে ভারতে অবস্থানরত শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতাকর্মীর কর্মকাণ্ড নিয়েও উদ্বেগ জানানো হয়। এর জবাবে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার তাদের প্রেস নোটে যে দাবি করেছে, ভারত তা সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করছে। মন্ত্রণালয়টি আবারো জোর দিয়ে বলেছে, বাংলাদেশ বিষয়ে ভারতের দীর্ঘদিনের অবস্থান হলো অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা। টেলিগ্রাফ লিখেছে, শেখ হাসিনার উস্কানিমূলক বক্তব্যকে কেন্দ্র করে কূটনৈতিক টানাপড়েন বাড়ছে।
ঢাকা উদ্বেগ জানিয়ে প্রত্যর্পণ দাবি করেছে। আর নয়াদিল্লি অভিযোগ অস্বীকার করে শান্তিপূর্ণ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের প্রতি সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেছে। বাংলাদেশের অভিযোগ, ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভারত তার ভূখণ্ড থেকে উস্কানিমূলক বক্তব্য দেয়ার সুযোগ দিচ্ছে, যেখানে তিনি তার সমর্থকদের আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন বানচাল করার আহ্বান জানাচ্ছেন। ইয়েনি শাফাক লিখেছে, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা নিয়ে গভীর উদ্বেগ জানাতে ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনারকে রোববার তলব করে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের অভিযোগ, পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সমর্থকেরা ভারতের ভূখণ্ড ব্যবহার করে বাংলাদেশবিরোধী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছেন। রাজনৈতিক কর্মী শরীফ ওসমান হাদির ওপর সাম্প্রতিক হত্যাচেষ্টা এই উদ্বেগকে আরও ঘনীভূত করেছে। ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচন যাতে সহিংসতা ও অস্থিরতায় ব্যাহত না হয়, সে জন্য ভারতের সহযোগিতাও চাওয়া হয়েছে।