স্বাস্থ্যসেবার ব্যয় মেটাতে গিয়ে বাংলাদেশের প্রায় অর্ধেক মানুষ আর্থিকভাবে হোঁচট খাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থ্যা ও বিশ্বব্যাংকের হিসাব বলছে, স্বাস্থ্যসেবার ব্যয়ে দেশের ৪৪ শতাংশ পরিবার আর্থিক বিপর্যয়ের মুখে পড়ে, এমনকি অনেকে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যায়। এটি বাংলাদেশের সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার (ইউনিভার্সাল হেলথ কাভারেজ) লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, স্বাস্থ্য খরচ মেটাতে গিয়ে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ অর্থাভাবে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা গ্রহণে বিরত থাকে বা চিকিৎসাসেবাপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকে।
অনেকে সঞ্চয়, ধারদেনা, সম্পদ বিক্রি করে চিকিৎসা ব্যয় মিটিয়ে থাকে, তাদের একটি বড় অংশ আর্থিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়, এমনকি দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যায়।
প্রয়োজনীয় সব ধরনের স্বাস্থ্যসেবা সহনীয় বা সাশ্রয়ী মূল্যে পাওয়া নিশ্চিত করাই হচ্ছে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার লক্ষ্য। অর্থাৎ একটি দেশের সব নাগরিক আর্থিক বোঝা ছাড়াই প্রয়োজন অনুযায়ী মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা পাবে এবং অসুস্থতার কারণে কেউ আরো বেশি দরিদ্র হবে না।
এ লক্ষ্যে ২০১২ সালে একটি স্বাস্থ্য অর্থায়ন কৌশলপত্র তৈরি করা হয়।
শুরুতে এ লক্ষ্য অর্জনে জোর দেওয়া হলেও ২০১৫ সালের পর থেকে তা অনেকটাই থমকে আছে। সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবায় ২০১৫ সালে বাংলাদেশের স্কোর ছিল ১০০-তে ৪৫। এরপর ২০২১ সালে হয় ৫২ এবং সর্বশেষ ২০২৫ সালে এই স্কোর দাঁড়িয়েছে ৫৪-তে। নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০ সালে এই স্কোর হবে ৭৪।
২০১২ সালে চিকিৎসার জন্য রোগীরা গড়ে ৬৪ শতাংশ অর্থ নিজের পকেট থেকে খরচ করত, যা ফিবছর বেড়ে ২০২২ সালে ৬৯ শতাংশে পৌঁছে। বর্তমানে এই ব্যয় ৭০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে বলে জানান অনেক বিশেষজ্ঞ। যদিও কৌশলপত্রে উল্লেখিত লক্ষ্য ছিল ২০৩২ সালের মধ্যে সেটি ৩২ শতাংশে নামিয়ে আনা।
দেশের এমন পরিস্থিতিতে আজ পালিত হচ্ছে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা দিবস। জাতিসংঘের আহ্বানে ২০১৭ সাল থেকে প্রতিবছর ১২ ডিসেম্বর বিশ্বব্যাপী দিবসটি পালিত হয়।
দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য ‘অসাধ্য স্বাস্থ্য ব্যয়ে ক্লান্ত রোগীরা’।
সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার মধ্যে সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ, প্রতিকার, মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য, জরুরি অবস্থায় সুরক্ষা প্রদান, যার মধ্যে টিকাদান, রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা এবং পরিবেশগত ঝুঁকি থেকে সুরক্ষা অন্তর্ভুক্ত।
যেসব রোগে আক্রান্ত ও মৃত্যু বেশি : গ্লোবাল বারডেম অব ডিজিজ-২ অনুসারে, সবচেয়ে বেশি ৩৬ শতাংশ মানুষের মৃত্যু হৃদরোগে। এরপর ফুসফুসের বিভিন্ন সংক্রমণ ও যক্ষ্মায় মৃত্যু ১৯ শতাংশের। ৯ শতাংশ দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসতন্ত্রের রোগ, ৮ শতাংশ কোষের বৃদ্ধিজনিত টিউমার, ৫ শতাংশ ডায়াবেটিস ও কিডনি রোগে, ৫ শতাংশ মাতৃ ও শিশু মৃত্যু, ৪ শতাংশ পরিপাকতন্ত্রের রোগ, ৪ শতাংশ অন্ত্রের প্রদাহ, স্নায়ুজনিত সমস্যায় ২ শতাংশ এবং অন্যান্য রোগে ৮ শতাংশের মৃত্যু হয়।
হৃদরোগে আক্রান্ত ১৮ শতাংশ মানুষ, এরপর ফুসফুসের বিভিন্ন সংক্রমণ ও যক্ষ্মায় মৃত্যু হয় ১৩ শতাংশ, মা ও শিশুর স্বাস্থ্য সমস্যা ১০ শতাংশ। আঘাত ও মানসিক সমস্যা ৭ শতাংশ করে, কোষের বৃদ্ধিজনিত টিউমার সমস্যা, দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসতন্ত্র ও অন্যান্য অসংক্রামক রোগে ভোগে ৫ শতাংশ করে, ডায়াবেটিস, কিডনিজনিত সমস্যা, পরিপাকতন্ত্রের সমস্যায় ভোগে ৪ শতাংশ। এ ছাড়া অন্ত্রের প্রদাহ, স্নায়ুতন্ত্রের সমস্যা, অপঘাত ও ইন্দ্রিয় অন্ত্রের সমস্যা ৩ শতাংশ করে। অন্যান্য রোগে ভোগে ৯ শতাংশ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ বলেন, ‘ইউনিভার্সাল হেলথ কাভারেজ অর্জন আমাদের জন্য মঙ্গল গ্রহে যাওয়ার সমান। কারণ না আছে রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি, না আছে কোনো আইন বা নীতি, না আছে বরাদ্দ।’
তিনি বলেন, প্রাপ্ত বরাদ্দ দিয়ে গুণগত মানের সর্বোচ্চ পরিমাণ সেবা প্রদানের চেষ্টা করা, যা স্বাস্থ্য খাতে অর্থায়নের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। বর্তমান উপকরণভিত্তিক লাইন-আইটেম বাজেট বরাদ্দ ব্যবস্থার কাঠামোগত ত্রুটি দূর করতে পারলে এ ক্ষেত্রে সফলতা আসতে পারে।
স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনের সদস্য ও আইসিডিডিআরবির শিশু ও মাতৃস্বাস্থ্য বিভাগের বিজ্ঞানী আহমেদ এহসানুর রাহমান বলেন, চিকিৎসা করতে গিয়ে আর্থিক সংকটে পড়ে মূলত দরিদ্র জনগোষ্ঠী। কিন্তু এই দরিদ্র মানুষের প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে গত আট থেকে ১০ বছরে সরকারের কোনো প্রোগ্রাম ছিল না। এ জন্য কোনো ফান্ড রাখা হয়নি বা কোনো উদ্যোগ ছিল না।