ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ট্রেনে উঠছে দেশ। আজ ঘোষণা হবে ভোটের তফসিল। একইদিনে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে সাধারণ নির্বাচন ও জুলাই সনদ নিয়ে গণভোট। নির্বাচন নিয়ে নানা শঙ্কা ও সংশয়ের মধ্যেই প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দীন রেডিও ও টেলিভিশনে তফসিলের ঘোষণা দেবেন। তফসিল সংক্রান্ত সেই ভাষণটি গতকালই ধারণ করেছে বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতার। এই ভাষণেই জানানো হবে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির কতো তারিখে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ। ইসি সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে ১২ই ফেব্রুয়ারি বা তার আগের দিন ভোটের তারিখ হতে পারে। গতকাল সিইসি’র ভাষণ রেকর্ডের পর বিকাল পৌনে পাঁচটায় নির্বাচন ভবনে আনুষ্ঠানিকভাবে ইসি’র সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ তফসিলের বিষয়ে কথা বলেন। বলেন, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টায় সিইসি জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন। জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগের দিন অন্তর্বর্তী সরকারের দুই উপদেষ্টা মাহফুজ আলম ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া পদত্যাগ করেছেন। এই দুই উপদেষ্টা নির্বাচনে অংশ নেবেন এমন আলোচনা আছে। তবে তারা কোন দল থেকে নির্বাচন করবেন তা স্পষ্ট হয়নি।
এদিকে এএমএম নাসির উদ্দিনের নেতৃত্বে নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানেল মাছউদ, তাহমিদা আহমদ, মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার, আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ ও নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ গতকাল প্রেসিডেন্ট মো. সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে বঙ্গভবনে যান। সাক্ষাতের পর নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানেল মাছউদ গণমাধ্যমকে বলেন, রাষ্ট্রপতিকে নির্বাচনের প্রস্ততির সার্বিক বিষয়ে অবহিত করা হয়েছে।
এদিকে বাগেরহাটের সংসদীয় আসন চারটি থেকে কমিয়ে তিনটি করে নির্বাচন কমিশন যে গেজেট জারি করেছিল, তা ‘অবৈধ’ ঘোষণা করেছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। তবে আদালতের ওই রায় তফসিলে খুব বেশি প্রভাব ফেলবে না বলেই মনে করছেন আব্দুর রহমানেল মাছউদ। এ নির্বাচন কমিশনার বলেন, প্রভাব ফেলার তো কথা না। আমাদের মতো আমরা (তফসিল) ঘোষণা দেবো। যদি ওইটা (বাগেরহাটের আসন) না দিতে হয়, না দেবো- অসুবিধা নেই। আমরা বসবো অর্ডার নিয়ে; দেখি কী হয়। আমাদের মতো আমরা ঘোষণা দেবো। বাগেরহাটের সংসদীয় আসন চারটি ও গাজীপুর পাঁচটি আসন থাকবে বলে রায় দিয়েছেন আপিল বিভাগ।
এর আগে বাগেরহাটে সংসদীয় আসন চারটি থেকে কমিয়ে তিনটি করা- সংক্রান্ত ইসির গেজেটের বৈধতা নিয়ে করা এক রিটের চূড়ান্ত শুনানি শেষে গেল ১০ই নভেম্বর হাইকোর্ট রায় ঘোষণা করে। রায়ে বাগেরহাটে চারটি সংসদীয় আসন এবং গাজীপুরের পাঁচটি আসন পুনর্বহাল করে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গেজেট প্রকাশ করতে নির্বাচন কমিশনকে নির্দেশ দেয়া হয়।
এদিকে গতকাল বঙ্গভবন থেকে নির্বাচন ভবনে ফিরে নির্বাচন কমিশন সচিব সাংবাদিকদের বলেন, একইদিনে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট হবে। ব্যালটের রং, ভোট গণনা পদ্ধতি এবং রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন সম্পর্কে রাষ্ট্রপতিকে অবহিত করেছেন সিইসি। নির্বাচন কমিশনের সার্বিক প্রস্তুতিতে রাষ্ট্রপতি সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
সংসদ নির্বাচনে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ ও জমার শেষ দিন; বাছাই, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ সময় ও ভোটের তারিখ নির্ধারণ করা হবে তফসিলে। আর গণভোটের জন্য শুধু ভোটের তারিখটি উল্লেখ করা হবে। ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে পোস্টাল ভোটিং যুক্ত হয়েছে। গণভোটেও ভোট দিতে পারবেন নিবন্ধিত প্রবাসী বাংলাদেশিরা।
এদিকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন একইসঙ্গে সংবিধান সংশোধনে গণভোট আয়োজনে অন্তর্বর্তী সরকারের নির্দেশ বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে একই দিন অনুষ্ঠিত হবে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট। সেক্ষেত্রে পোলিং বুথের সংখ্যা ও ভোট দেয়ার সময় বাড়তে পারে বলে জানিয়েছে ইসি। সে অনুযায়ী ইসি’র প্রস্তুতিও রয়েছে।
ভোট প্রদানের সময় বাড়বে জানিয়ে নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেন, আমাদের যেহেতু দু’টি নির্বাচন একসঙ্গে অনুষ্ঠান করতে হচ্ছে- জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং গণভোট; এটার সময় ম্যানেজমেন্ট নিয়ে। আপনারা জানেন- আমরা একটা মক ভোটিং করেছিলাম। সেটার অভিজ্ঞতা এবং মাঠ পর্যায়ে যারা ইতিপূর্বে ভোট অনুষ্ঠান করেছেন তাদের অভিজ্ঞতা আলোচনা ও বিবেচনায় নিয়ে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। তিনি বলেন, আমরা ভোটের সময় এক ঘণ্টা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি- সকালে আধাঘণ্টা এবং বিকালে আধাঘণ্টা। অর্থাৎ এখন ভোট শুরু হবে সকাল সাড়ে ৭টায় এবং চলবে বিকাল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত।
ইসি’র সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ বলেন, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোটকে সামনে রেখে ভোটকেন্দ্র ও ভোটকক্ষের সংখ্যা অপরিবর্তিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। তবে প্রতিটি কেন্দ্রের প্রতিটি কক্ষে দু’টি করে ভোট দেয়ার জায়গা বা গোপন কক্ষের (স্ট্যাম্পিং সেন্টার) ব্যবস্থা থাকবে। গোপন কক্ষ বা ভোটিং বুথের সংখ্যা বাড়ানোর ফলে সামান্য পরিমাণে বাজেট বাড়তে পারে বলেও জানান তিনি।
এবার দেশে ভোটার সংখ্যা ১২ কোটি ৭৬ লাখ ৯৫ হাজার ১৮৩ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ৬ কোটি ৪৮ লাখ ১৪ হাজার ৯০৭ জন ও মহিলা ভোটার ৬ কোটি ২৮ লাখ ৭৯ হাজার ৪২ জন এবং তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার ১ হাজার ২৩৪ জন। চলতি বছরের ৩১শে অক্টোবর পর্যন্ত যাদের বয়স ১৮ হয়েছে তাদের নিয়েই চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রস্তুত করেছে নির্বাচন আয়োজনকারী সংস্থাটি।
উপদেষ্টা মাহফুজ-আসিফের পদত্যাগ
তথ্য ও সমপ্রচার উপদেষ্টা মো. মাহফুজ আলম এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া পদত্যাগ করেছেন।
গতকাল বিকাল পাঁচটায় প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে তারা পদত্যাগপত্র জমা দেন। প্রধান উপদেষ্টা তাদের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেছেন। এই দুই উপদেষ্টার পদত্যাগ নির্বাচন কমিশন তফসিল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে কার্যকর হবে। গতকাল প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে বিষয়টি জানানো হয়েছে। এর আগে সন্ধ্যায় এ বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। তিনি জানান, অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে থাকা মাহফুজ আলম ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
বিজ্ঞপ্তিতে প্রেস উইং জানায়, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে সম্মুখসারিতে থেকে নেতৃত্ব দেয়া এই দুই ছাত্রনেতার পদত্যাগপত্র গ্রহণের পর প্রধান উপদেষ্টা তাদের ভবিষ্যৎ জীবনের মঙ্গল কামনা করেন। তিনি বলেন, অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিয়ে তোমরা যেভাবে জাতিকে ফ্যাসিবাদী শাসন থেকে মুক্তির পথে অবদান রেখেছো তা জাতি মনে রাখবে। আমি বিশ্বাস করি ভবিষ্যতেও গণতান্ত্রিক উত্তরণ ও বিকাশে তোমরা একইভাবে সক্রিয় ভূমিকা রাখবে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আজ একটি ঐতিহাসিক দিন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সবসময় তোমাদের অবদান স্মরণ করবে। আমি তোমাদের সুন্দর ও শুভ ভবিষ্যৎ কামনা করি। এত অল্প সময়ে তোমরা জাতিকে যা দিয়েছো তা জাতি কখনো ভুলবে না। তিনি বলেন, এটি একটি রূপান্তর মাত্র। আমি আশা করি, আগামীতে বৃহত্তর পরিমণ্ডলে তোমরা আরও বড় অবদান রাখবে।
নিজেদের কর্মের মাধ্যমে দেশের মঙ্গলে নিয়োজিত থাকার আহ্বান জানিয়ে দুই ছাত্রনেতার উদ্দেশ্যে ড. ইউনূস বলেন, সরকারে থেকে যে অভিজ্ঞতা তোমরা অর্জন করেছ, তা ভবিষ্যৎ জীবনে অবশ্যই কাজে লাগাতে হবে।
পদত্যাগ করা দুই উপদেষ্টা ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি হিসেবে উপদেষ্টা পরিষদে যোগ দিয়েছিলেন। ছাত্রপ্রতিনিধি হিসেবে সরকারে থাকা অভ্যুত্থানের আরেক পরিচিত মুখ নাহিদ ইসলাম এর আগে উপদেষ্টার পদ ছাড়েন। তার নেতৃত্বে গঠিত হয় নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি। মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলন ঘোষণা করায় অনেকে ধারণা করেছিলেন আসিফ মাহমুদ বুধবার পদত্যাগের ঘোষণা দেবেন। তবে সংবাদ সম্মেলনে তিনি তার অধীন মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন কার্যক্রম তুলে ধরে জানান, পদত্যাগের বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে জানানো হবে।
মাহফুজ আলম ও আসিফ মাহমুদ আসছে নির্বাচনে প্রার্থী হবেন এমন আলোচনা আগে থেকেই ছিল। তবে তারা কোনো দলের হয়ে নির্বাচন করবেন নাকি স্বতন্ত্র প্রার্থী হবেন তা এখনো পরিষ্কার নয়। ঢাকা-১০ আসনে নির্বাচনে লড়ার আগ্রহ দেখিয়ে সেখানে ভোটার হয়েছেন আসিফ। এই আসনে শুরুতে বিএনপি প্রার্থী না দিলেও পরে প্রার্থী দিয়েছে। আলোচনা ছিল আসিফ বিএনপি থেকে প্রার্থী হতে পারেন। আবার এনসিপি থেকেও প্রার্থী হওয়ার আলোচনা ছিল। এনসিপি দলীয় প্রার্থীর একটি তালিক প্রকাশ করলেও ঢাকা-১০ আসনে কোনো প্রার্থী দেয়নি। লক্ষ্মীপুর-১ আসনে মাহফুজ আলম লড়তে পারেন এমন আলোচনা থাকলেও তিনি নিজে এখনো নির্বাচনের বিষয়ে কোনো কথা বলেননি।