মোহাম্মদপুরের শাহজাহান সড়কের বাসায় মা ও মেয়েকে হত্যায় প্রধান সন্দেহভাজন চার দিন আগে কাজ নেওয়া গৃহকর্মী আয়েশা। হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সোমবার রাতে দায়ের হওয়া মামলায় বাদী জানিয়েছেন, বাসা থেকে মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, স্বর্ণালংকার, অর্থ ও অন্যান্য মূল্যবান সামগ্রী খোয়া গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, বাসা থেকে পালানোর সময় গৃহকর্মী তার কাঁধের ব্যাগে জিনিসপত্র নিয়ে গেছে। তবে এ জিনিসপত্রের জন্যই কি মা-মেয়েকে উপর্যুপরি কুপিয়ে হত্যা?
প্রাথমিকভাবে মূল্যবান জিনিসপত্রের জন্য হত্যাকে মোটিভ ধরে তদন্ত করছে পুলিশ। তারা জানিয়েছেন, বাসা থেকে অন্যান্য জিনিসের সঙ্গে যে ফোনটি খোয়া গেছে, সেটির শেষ অবস্থান শনাক্ত হয়েছে মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গৃহকর্মী নিজেকে আয়েশা নামে পরিচয় দিয়েছিল। বাসার ঠিকানা বলেছিল জেনেভা ক্যাম্প; কিন্তু তাকে বাসায় কাজে রাখার সময় জাতীয় পরিচয়পত্র বা বিস্তারিত কোনো তথ্য রাখা হয়নি। গৃহকর্মীর অবস্থান শনাক্তে ডিজিটাল ফুটপ্রিন্ট পাওয়া না গেলেও অ্যানালগ পদ্ধতিতে তার পরিচয় শনাক্ত ও অবস্থান নিশ্চিত করে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
গত সোমবার সকালে হত্যার শিকার হন মা লায়লা ও মেয়ে নাফিসা। স্ত্রী ও মেয়েকে হত্যার ঘটনায় গৃহকর্মী আয়েশাকে আসামি করে মোহাম্মদপুর থানায় মামলা করেছেন আ জ ম আজিজুল ইসলাম। মামলায় তিনি বাসার সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজের একটি বর্ণনা দিয়েছেন। এতে বলা হয়েছে, আসামি সকাল ৭টা ৫১ মিনিটে কাজ করার জন্য বাসায় আসে। সকাল ৯টা ৩৫ মিনিটে আসামি তার (বাদী) মেয়ের স্কুল ড্রেস পরে বাসা থেকে পালিয়ে যায়। যাওয়ার সময় একটি মোবাইল ফোন, একটি ল্যাপটপ, স্বর্ণালংকার, অর্থসহ অন্যান্য মূল্যবান সামগ্রী নিয়ে যায়।
মামলায় বাদী আজিজুল পেশায় একজন শিক্ষক বলে পরিচয় দিয়েছেন। মোহাম্মদপুরে পরিবার নিয়ে থাকেন। ঘটনার চার দিন আগে আয়েশাকে তার বাসায় খণ্ডকালীন গৃহকর্মী হিসেবে রাখেন। সোমবার সকাল ৭টার দিকে তিনি (আজিজুল) কর্মস্থল উত্তরায় চলে যান। কর্মস্থলে থাকাকালে তিনি তার স্ত্রীর মোবাইলে একাধিকবার কল করে যোগাযোগ করতে ব্যর্থ হন। পরে তিনি বেলা ১১টার দিকে বাসায় আসেন। এসে দেখতে পান, মেয়ের গলার নিচে ডান পাশে কাটা। মেয়ে গুরুতর অবস্থায় বাসার প্রধান ফটকে পড়ে আছে। মেয়ের এ অবস্থা দেখে তিনি দ্রুত তাকে উদ্ধার করেন। পরিচ্ছন্নতাকর্মী আশিকের মাধ্যমে মেয়েকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠান। হাসপাতালে নেওয়ার পর তাকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক। আর স্ত্রীর গলাসহ শরীরের বিভিন্ন জায়গায় কাটা। স্ত্রী রক্তাক্ত জখম হয়ে মৃত অবস্থায় পড়ে আছেন রান্নাঘর লাগোয়া করিডোরে।
তদন্তে প্রাধান্য পাচ্ছে যা যা: মা ও মেয়েকে গৃহকর্মী আয়েশা একাই হত্যা করেছে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়েছে পরিবার ও প্রতিবেশীদের। তবে পুলিশ বলছে, বাসা ও আশপাশের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করে অন্য কারও উপস্থিতি পাওয়া যায়নি।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদপুর থানার এসআই সহিদুল ওসমান মাসুম বলেন, ‘উল্লিখিত সময়ে অন্য কাউকে দেখা যায়নি। তবে সবগুলো বিষয় মাথায় রেখেই তদন্ত করছি।’
এ ছাড়া বাসায় কাজ নেওয়ার সময় নিজেকে আয়েশা দাবি করলেও নাম নিয়ে সন্দেহ করছে পুলিশ। তার প্রকৃত নাম-পরিচয় ও অবস্থান শনাক্তের চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছেন মোহাম্মদপুর জোনের সহকারী কমিশনার আবদুল্লাহ আল মামুন।
হত্যার মোটিভ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে মূল্যবান সামগ্রী নেওয়ার জন্য এ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে বলে মনে করছি। তবে আসামি গ্রেপ্তারের আগে তা নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না। আমরা আয়েশাকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা করছি।’
মা-মেয়ের দাফন: এদিকে গতকাল মঙ্গলবার নাটোর শহরের গাড়িখানা কবরস্থানে নিহত লায়লা আফরোজ ও তার মেয়ে নাফিসা লাওয়াল বিনতে আজিজের (১৫) দাফন সম্পন্ন হয়েছে। এর আগে জোহরের নামাজের পর শহরের নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা সরকারি কলেজ মাঠে মা ও মেয়ের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এতে আহতদের স্বজনসহ এলাকার সর্বস্তরের মানুষ অংশ নেয়।
মঙ্গলবার ভোরে ঢাকা থেকে অ্যাম্বুলেন্সে তাদের মরদেহ নাটোর শহরের বড়গাছা এলাকার পৈতৃক বাড়িতে পৌঁছায়। মা-মেয়ের নিথর দেহ একনজর দেখতে ভোর থেকেই আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা ভিড় জমান। স্বজনের আহাজারিতে পুরো এলাকায় শোকের ছায়া নেমে আসে।