Image description
চালু হচ্ছে ইউনিক নম্বর

বর্তমানে কোম্পানি করদাতাদের ব্যবসা করতে করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) ও ব্যবসা নিবন্ধন নম্বর (বিআইএন) নিতে হয়। কিন্তু আয়কর ও ভ্যাটে পৃথক নিবন্ধন থাকায় প্রকৃত করদাতার সংখ্যা নিরূপণ করা সম্ভব হচ্ছে না। এ কারণে দুই খাতেই রিটার্ন জমার সংখ্যায় বিস্তর ব্যবধান থেকে যাচ্ছে। এ ব্যবধান কমিয়ে সরকারের আয় বাড়াতে টিআইএন-বিআইএনের পরিবর্তে একক ইউনিক নম্বর চালু করা হবে। ইতোমধ্যে এ বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এজন্য কাস্টমস ও আইটি বিভাগের সমন্বয়ে সম্প্রতি ১৯ সদস্যের একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, এ উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির পাশাপাশি ব্যবসায় কমপ্লায়েন্স বা সার্বিক গুণগত মান আরও বাড়বে। ১২ নভেম্বর আয়কর, কাস্টমস ও আইটি বিভাগের সমন্বয়ে গঠিত এ কমিটি ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে। কমিটি এক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের একাধিক টিআইএন ও বিআইএন চিহ্নিত করার পাশাপাশি সব ধরনের করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর একীভূত করে ইউনিক নাম্বার চালুর কৌশল প্রণয়ন করবে।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের (র‌্যাপিড) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক আবু ইউসুফ বলেন, অর্থনৈতিক শ্বেতপত্র কমিটির সুপারিশেও একটি ইউনিক নম্বর চালু করার কথা বলা হয়েছে। যাতে ব্যবসার লেনদেন সহজেই শনাক্ত করা যায়। তবে এ ধরনের কোনো উদ্যোগ সঠিকভাবে কাজ করবে না, যদি না এনবিআরের পূর্ণাঙ্গ অটোমেশন সম্ভব হয়। ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে রাজস্ব আদায় করে ফাঁকি বন্ধ করা যাবে না। তিনি আরও বলেন, এনবিআরই ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস বসানোর মতো ৫-৬ লাখ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান শনাক্ত করেছিল। কিন্তু বসাতে পেরেছিল ১১ হাজার। ইলেকট্রনিক্যালি আদায় করা গেলে শুধু ভ্যাট আদায় ৩ গুণ বাড়ানো সম্ভব। পাশাপাশি সরকারি সংস্থা যেমন-সিটি করপোরেশন, ওয়াসা ও ডেসকোর মধ্যে আন্তঃযোগাযোগ বৃদ্ধির মাধ্যমে আয়কর আদায় বাড়ানো সম্ভব।

এনবিআরের তথ্যমতে, বর্তমানে প্রায় ৬ লাখ ৪৪ হাজার ভ্যাট নিবন্ধিত ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আছে। এর মধ্যে প্রতি মাসে গড়ে পৌনে ৫ লাখ প্রতিষ্ঠান রিটার্ন দেয়। তিন লাখের বেশি অনলাইনে রিটার্ন জমা পড়ে। ভ্যাট আইন অনুযায়ী, প্রতি মাসের ১৫ তারিখের মধ্যে কেনাবেচার যাবতীয় তথ্য দিয়ে ভ্যাট রিটার্ন দিতে হয়। অন্যদিকে প্রতিবছর ৩৯ হাজার ৬০০ কোম্পানি করদাতা আয়কর রিটার্ন জমা দেয়। যদিও আরজেএসসিতে (যৌথমূলধন কোম্পানি ও ফার্মগুলোর পরিদপ্তর) নিবন্ধিত কোম্পানির সংখ্যা প্রায় ৩ লাখ।

সূত্র জানায়, আইএমএফের পরামর্শে ইউনিক নম্বার চালুর পরিকল্পনা করছে এনবিআর। ইউনিক নম্বার চালু করতে নতুন সফটওয়্যার করার প্রয়োজন আছে কিনা, বিদ্যমান সফটওয়্যার দুটির (আইভাস ও ইনকাম ট্যাক্স) মাধ্যমে একটি ইউনিক নম্বার চালু করা যায় কিনা, রিটার্ন জমার পদ্ধতি কী হবে-তা পর্যালোচনা করতে কমিটিতে এনবিআরের আইটি বিশেষজ্ঞদের রাখা হয়েছে। অন্যদিকে ইউনিক নম্বার দেওয়ার ক্ষেত্রে আইনগত বাধা আছে কিনা, দুই বিভাগে দুই ধরনের মিথ্যা তথ্য দেওয়ার মাধ্যমে কীভাবে রাজস্ব ফাঁকি দেয়া হচ্ছে-সেগুলো পর্যালোচনা করতে আয়কর ও কাস্টমসের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে কমিটি করা হয়েছে।

একাধিক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, আয়কর ও কাস্টমসের মধ্যে সমন্বয়ের অভাবে সুযোগসন্ধানীরা রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছে। অধিকাংশ কোম্পানির অডিট রিপোর্টের সঙ্গে ভ্যাট বিভাগে জমা দেওয়া বিক্রির তথ্যে ব্যাপক গরমিল পাওয়া যাচ্ছে। দুই দপ্তরই নিজস্ব দপ্তরে জমা দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে অডিট করায় প্রকৃত কর ফাঁকি উদ্ঘাটন করা যাচ্ছে না। ইউনিট নাম্বার চালু করা গেলে কোম্পানির আয়কর, ভ্যাট ও আমদানি-রপ্তানির রিয়েল টাইম ডাটা পাওয়া যাবে। এতে রাজস্ব ফাঁকি শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা সম্ভব।

এ বিষয়ে এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান যুগান্তরকে বলেন, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি রাজস্ব কৌশলের অংশ হিসাবে ইউনিক নম্বার চালুর পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এটি করা গেলে রাজস্ব আদায় বহুলাংশে বাড়বে। তিনি আরও বলেন, করদাতাদের সেবা নিশ্চিত করতে আরও বড় ধরনের সংস্কার পরিকল্পনা আছে। যেমন-আয়কর ও ভ্যাটের পৃথক দুটি বৃহৎ করদাতা ইউনিট থাকার যৌক্তিকতা নেই। একটি দপ্তর থাকবে। যেখানে হিসাববিদসহ রাজস্ব বিষয়ে বিশেষজ্ঞ প্যানেল থাকবে। এই প্যানেল একই সঙ্গে আয়কর ও ভ্যাট অডিট করবে। এটি করা গেলে বড় করদাতাদের সময় ও অর্থ দুটোরই সাশ্রয় হবে।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ইউনিক নম্বর চালুর বিষয়টি ভালো উদ্যোগ হতে পারে। এর মাধ্যমে করদাতার জীবনযাত্রা সহজেই ট্র্যাক করা যাবে। অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে, একজন ব্যক্তি বছরে ৩ বার বিদেশ ভ্রমণ করেন, তার ২-৩টা দামি গাড়িও আছে-অথচ তিনি আয়কর দেন এক লাখ টাকা। যা তার জীবনযাত্রার সঙ্গে সামঞ্জ্যপূর্ণ নয়। অথচ ভারতে প্রতি কেনাকাটা বা বড় লেনদেনে আধার কার্ড ও প্যান কার্ড (আয়কর নম্বার) দেওয়া বাধ্যতামূলক। বছর শেষে এই দুই নাম্বার পর্যালোচনা করে ব্যক্তির প্রকৃত আয় নির্ধারণ করা হয়। আমাদের দেশেও এ ধরনের সিস্টেম চালু করা যেতে পারে।

পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ড. মাশরুর রিয়াজ বলেন, পৃথিবীর যেসব দেশে উত্তম রাজস্ব কাঠামো আছে, তার সবই প্রত্যক্ষ কর ও পরোক্ষ কর বিভাগের মধ্যে সমন্বয় আছে। শুধু বাংলাদেশেই এই দুই বিভাগের মধ্যে ইন্টিগ্রেশন নেই বললেই চলে। এমনকি এই দুই বিভাগ নিজেরা নিজেদের মধ্যেই তথ্য আদান-প্রদান করে না। টিআইএন ও বিআইএন মার্জ করে একটি ইউনিক নম্বর চালুর মাধ্যমে দুই বিভাগের মধ্যে কার্যকর ইন্টিগ্রেশন সম্ভব। এটি এনবিআরের যুগান্তকারী উদ্যোগ হতে পারে। এটি করা গেলে স্বচ্ছতার পাশাপাশি রাজস্ব আদায় বাড়বে।