Image description
আন্তর্জাতিক মহলেরও তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রয়েছে আসন্ন নির্বাচনের দিকে

নির্বাচনি ট্রেনে পুরো দেশ। যে কোনো সময়ে এ ট্রেনযাত্রার হুইসেল বাজাতে যাচ্ছে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এএমএম নাসির উদ্দিনের নেতৃত্বাধীন কমিশন। এরই আনুষ্ঠানিকতা হিসাবে আজ বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন সিইসি ও চার কমিশনার। এরপরই বিকালে জাতির উদ্দেশে সিইসির ভাষণ রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন বিটিভি ও বাংলাদেশ বেতারে রেকর্ড করা হবে। ওই ভাষণের মধ্য দিতে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের তফসিল ঘোষণা করতে যাচ্ছে ইসি।

নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, ভাষণ রেকর্ড করা হলেও আজ তফসিল ঘোষণার সম্ভাবনা কম। বৃহস্পতিবার তফসিল ঘোষণা করতে যাচ্ছে ইসি। আর ভোটগ্রহণের সম্ভাব্য দিন ১১ ও ১২ ফেব্রুয়ারির যে কোনো একদিন। এ বিষয়ে তিনজন নির্বাচন কমিশনারের কাছে জানতে চাইলে তারা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশে একটি নির্বাচিত সরকার গঠন হতে যাচ্ছে। পাশাপাশি গণভোটের রায়ে নির্ধারিত হতে যাচ্ছে সংবিধানসহ রাষ্ট্রের মৌলিক সংস্কার প্রস্তাবের ভবিষ্যৎ। ইতোমধ্যে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার অন্যান্য সব প্রস্তুতি প্রায় শেষ করে এনেছে ইসি। এরই অংশ হিসাবে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা এবং প্রধান বিচারপতির সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেছেন সিইসি। মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত তফসিল ঘোষণার আগের প্রস্তুতিগুলো যাচাই করতে দফায় দফায় বৈঠক করেন সিইসি ও নির্বাচন কমিশনাররা। এদিন নির্বাচনের প্রধান আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) সংশোধনীর গেজেট জারি হয়। তবে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালা এবং নির্বাচন পরিচালনা বিধিমালার সংশোধনীর গেজেট গতকাল রাত পর্যন্ত জারি হয়নি।

এর আগে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অনিয়ম ও কারচুপির ব্যাপক অভিযোগ ছিল। দেশে একটি ফ্যাসিস্ট সরকার গড়ে ওঠার পেছনে কারচুপির ওই তিনটি নির্বাচনকে দায়ী করে আসছে বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি পর্যবেক্ষকরা। তবে ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন ঘটিয়ে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার নেতৃত্বে দেশে গণ-অভ্যুত্থান ঘটে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশে এই প্রথম কোনো নির্বাচন হতে যাচ্ছে। এই নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপিসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল তাদের প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করেছে। ওই প্রার্থীরা এখন ভোটের মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন। তাদের কর্মতৎরতায় দেশে নির্বাচনি আমেজ বইছে। একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে আছে পুরো দেশ। এমনকি আন্তর্জাতিক মহলেরও তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রয়েছে আসন্ন নির্বাচনের দিকে।

তবে এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নিতে পারছে না। সন্ত্রাসবিরোধী আইনে দলটির কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকায় এবং নির্বাচনে কমিশনে দলটির নিবন্ধন স্থগিত থাকায় ভোটের বাইরে থাকতে হচ্ছে দলটিকে। এমনকি গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধনীর ফলে দলীয় প্রধান শেখ হাসিনাসহ দলটির পলাতক অনেক নেতা ইতোমধ্যে নির্বাচনে অযোগ্য হয়ে গেছেন। তবে জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলীয় জোটের শরিক নিবন্ধিত দলগুলো চাইলে এ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে। ইসি মনে করছে, আওয়ামী লীগ অংশ নিতে না পারলে আসন্ন নির্বাচনে কম-বেশি ৭০ শতাংশ ভোট পড়বে। বিগত তিনটি নির্বাচনে ভোট দিতে না পারা কয়েক কোটি তরুণ ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের জন্য মুখিয়ে আছেন।

তফসিল ঘোষণা করতে ইসির সব প্রস্তুতি শেষ হয়েছে বলে জানান নির্বাচন কমিশনার মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার। গতকাল তিনি যুগান্তরকে বলেন, আমাদের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন। তফসিল ঘোষণা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। তফসিল ঘোষণার জন্য যে প্রস্তুতি প্রয়োজন, সব প্রস্তুতি গ্রহণ করে রেখেছে ইসি। আসন বিন্যাস, আইন অনুযায়ী রিটার্নিং অফিসার, সহকারী রিটার্নিং অফিসার যারা থাকবেন তাদের প্রজ্ঞাপন, বিভিন্ন বিষয়ে ২০টির মতো পরিপত্র জারি হবে। সেখানে মোবাইল কোর্ট, ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ, ইলেকটোরাল ইনকোয়ারি কমিটি নিয়োগ, বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ, মনিটরিং সেল গঠন, আইনশৃঙ্খলার সেল গঠন এগুলোর ফরম্যাটগুলো রেডি রয়েছে। তফসিল ঘোষণার পরপর সেগুলো ধারাবাহিকভাবে জারি করা হবে বলে জানান এই কমিশনার। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালা এবং নির্বাচন পরিচালনা বিধিমালার সংশোধনীর গেজেট দ্রুত জারি হয়ে যাবে। একটি উৎসবমুখর নির্বাচনের জন্য দেশের মানুষ অপেক্ষা করছেন বলে মন্তব্য করেছেন নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য ও ইসির সাবেক অতিরিক্ত সচিব জেসমিন টুলী। তিনি বলেন, আমার মনে হয় নির্বাচন কমিশন ভোটের জন্য প্রস্তুত। রাজনৈতিক দলগুলোও প্রস্তুত। তারা অনেক দিন ধরে নির্বাচন চাইছে। এখন একটি ভালো ভোট হলে তা সবার জন্য সুখকর হবে। তিনি বলেন, নির্বাচনি পরিবেশ অনুকূল থাকলে অনেক চ্যালেঞ্জই সহজ হয়ে যাবে। দলগুলো ও প্রার্থীরা আচরণবিধি অনুসরণ না করলে ইসির চ্যালেঞ্জ বাড়বে। তফসিলের পর পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেয় সেটি দেখার বিষয়।

ইসি সূত্রে জানা গেছে, আসন্ন নির্বাচনে ভোটার সংখ্যা ১২ কোটি ৭৬ লাখ ৯৫ হাজার ১৮৩ জন। দেশে ভোটকেন্দ্র ৪২ হাজার ৭৬৬টি ও ভোটকক্ষ দুই লাখ ৪৫ হাজার ১৯৫টি। জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়ায় এবার একই ভোটকক্ষে দুটি করে ভোট দেওয়ার স্থান নির্মাণ করা হচ্ছে। যেসব ভোটকক্ষে দুটি গোপন স্থান নির্মাণের অবকাঠামো সুবিধা নেই সেসব কেন্দ্রে বাড়তি ভোটকেন্দ্র করা হবে। এই হিসাবে নির্বাচনে ভোটকক্ষের সংখ্যা আরও বাড়বে।

নির্বাচনে অন্যান্য প্রস্তুতির মধ্যে এ কমিশন নতুন রাজনৈতিক দল ও পর্যবেক্ষক নিবন্ধন, আইন সংস্কার, সীমানা পুনর্নির্ধারণ, রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন অংশীজনদের সঙ্গে সংলাপ, ভোটার তালিকা হালনাগাদ ও প্রবাসীদের সুবিধার্থে আইটি সাপোর্টেড পোস্টাল ব্যালট পদ্ধতি চালু করেছে ইসি। সীমানা নির্ধারণ নিয়ে আদালতে ৩০টির বেশি রিট থাকলেও নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা নিয়ে জটিলতা দেখছে না কমিশন।

নির্বাচনে অংশ নিতে পারছে না আ.লীগ : জানা গেছে, আসন্ন সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না আওয়ামী লীগ। সন্ত্রাসমূলক কার্যক্রমের দায়ে সরকার দলটির কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে রেখেছে। সরকারের ওই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দলটির নিবন্ধন স্থগিত করেছে ইসি। ওই স্থগিতের আদেশ দুটি প্রত্যাহার না হওয়ায় দলটির কেউ আসন্ন নির্বাচনে দলীয় প্রতীকে প্রার্থী হতে পারবেন না।

আরও জানা গেছে, প্রবাসীদের জন্য পোস্টাল ব্যালট মঙ্গলবার চূড়ান্ত করা হয়েছে। এতে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রতীক ‘নৌকা’ রাখা হয়নি। জাতীয় পার্টির প্রতীক লাঙ্গলসহ নিবন্ধিত অন্য সব দলের প্রতীক রয়েছে এ পোস্টাল ব্যালটে। ইসির এ সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নিতে না পারার বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়েছে।

নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানেল মাছউদের বক্তব্যে আওয়ামী লীগের অংশ নিতে না পারার বিষয়টি আরও নিশ্চিত হওয়া যায়। গতকাল তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘পোস্টাল ব্যালটে স্থগিত হওয়া দলের প্রতীক থাকছে না।’ নিবন্ধিত সব রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে কিনা-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা বলব যে আইনে যাদের কথা বলা আছে, সেই সব দল অংশ নিতে পারবে। আমরা কাউকে নির্বাচনে অংশ নিতে নিষেধ করিনি।

নির্বাচনে চ্যালেঞ্জ আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ : তফসিল ঘোষণার পর লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির কাজ ইসি শুরু করবে বলে জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানেল মাছউদ। তিনি বলেন, চ্যালেঞ্জ হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ। প্রত্যেক কাজের জন্য, দেশের স্থিতিশীলতার জন্য, দেশের নাগরিকদের নিরাপত্তার জন্য, দেশের উন্নয়নের জন্য আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ দরকার। আসন্ন নির্বাচনে নিরাপত্তা বড় চ্যালেঞ্জ হবে বলে মনে করছি। তিনি আরও বলেন, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির বিষয়টি তফসিল ঘোষণার পর থেকে আমাদের কবজায় আসবে। এখন পার্টি যদি মারামারি করে আমার তো কোনো দায়িত্ব নেই।

উপদেষ্টারা পদে থেকে নির্বাচন করতে পারবেন না : নির্বাচন কমিশনার মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার জানান, উপদেষ্টারা পদে থেকে নির্বাচন করতে পারবেন না। গতকাল সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি ‘না’ সূচক উত্তর দেন। তিনি বলেন, ওই পদে থেকে কোনো ব্যক্তি নির্বাচনি প্রচারণা চালাতে পারবেন না। কোনো ব্যক্তি সরকারি পদে রয়েছেন, তিনি তো প্রচারণার বাইরে নির্বাচন করবেন না। সুতরাং এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, স্বপদে বহাল থেকে কেউ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না।