রাজধানীর মোহাম্মদপুরের শাহজাহান রোডে লায়লা ফিরোজ ও তার মেয়ে নাফিসা লাওয়াল বিনতে আজিজকে হত্যার ঘটনায় ঘাতক গৃহকর্মী আয়েশাকে আসামি করে মামলা হয়েছে। সোমবার দিবাগত রাতে নিহত লায়লা ফিরোজের স্বামী আ জ ম আজিজুল ইসলাম বাদী হয়ে মোহাম্মদপুর থানায় মামলা দায়ের করেন। তবে এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত অভিযুক্ত গৃহকর্মীকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। মামলার এজাহারে আজিজুল ইসলাম বলেন, আমি পেশায় একজন শিক্ষক। বর্তমানে শাহজাহান রোডের বাসা নং-৩২/২/এ (৭/বি) ফ্ল্যাটে থাকি। গত চারদিন আগে আসামি আয়েশা আমার বাসায় খণ্ডকালীন গৃহকর্মী হিসেবে কাজ শুরু করে।
সোমবার ৮ই ডিসেম্বর সকাল অনুমান ৭টার সময় আমি আমার কর্মস্থল উত্তরায় চলে যাই। আমি আমার কর্মস্থলে থাকা অবস্থায় আমার স্ত্রীর মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হই। পরে আমি নিরুপায় হয়ে বেলা অনুমান ১১টার সময় বাসায় এসে দেখতে পাই, আমার স্ত্রীর গলাসহ শরীরের বিভিন্ন জায়গায় কাটা রক্তাক্ত জখম হয়ে মৃত অবস্থায় পড়ে আছে এবং আমার মেয়ের গলার ডানদিকে কাটা গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় মেইন গেটের দিকে পড়ে আছে। আমার মেয়ের ওই অবস্থা দেখে তাকে উদ্ধার করে পরিচ্ছন্নতাকর্মী মো. আশিকের মাধ্যমে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। আমার মেয়েকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত বলে ঘোষণা করেন।
এজাহারে তিনি আরও বলেন, আমি আবার সিসিটিভি ফুটেজ পর্যালোচনায় দেখতে পাই, উল্লিখিত আসামি সকাল ৭টা ৫১ মিনিটে কাজ করার জন্য বাসায় আসে এবং সকাল ৯টা ৩৫ মিনিটের সময় আমার মেয়ের একটি মোবাইল, একটি ল্যাপটপ, স্বর্ণালংকার ও নগদ অর্থসহ অন্যান্য মূল্যবান সামগ্রী নিয়ে যায়। সিসিটিভি ফুটেজ পর্যালোচনা করে আমি নিশ্চিত হই যে, অজ্ঞাত কারণে সকাল ৭টা ৫১ থেকে ৯টা ৩৫ মিনিটের মধ্যে যেকোনো সময় আমার স্ত্রী ও মেয়েকে ছুরি অথবা অন্য কোনো ধারালো অস্ত্র দিয়ে গুরুতর জখম করে হত্যা করেছে। তেজগাঁও বিভাগের মোহাম্মদপুর জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, মোহাম্মদপুরের শাহজাহান রোডে মা ও তার মেয়েকে হত্যার ঘটনায় কথিত গৃহকর্মী আয়েশাকে আসামি করে নিহত নাফিসার বাবা আজম আজিজুল ইসলাম বাদী হয়ে মোহাম্মদপুর থানায় একটি মামলা (মামলা নং-২৯) দায়ের করেছেন।
তেজগাঁও বিভাগের মোহাম্মদপুর জোনের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার মো. জুয়েল রানা বলেন, আমরা এখন পর্যন্ত যে ধারণা করছি এবং যিনি বাদী অর্থাৎ নিহত লায়লা আফরোজের স্বামী মামলায় উল্লেখ করেছেন যে, একজন গৃহকর্মী তাদের হত্যা করে এর পরে বাসা থেকে মেয়ের স্কুলের ড্রেস পরে বের হয়ে গেছে। আমরা সেই সূত্র ধরেই বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালিয়েছি রাত থেকে ভোর পর্যন্ত। দুঃখজনকভাবে ব্যর্থ হয়েছি। সকালেও আমাদের দুইটা টিম বের হয়েছে অভিযানে। পাশাপাশি আমরা ডিবি, পিবিআই, সিআইডি এবং র্যাবের সহযোগিতা নিচ্ছি। আমরা সেনাবাহিনীর সহযোগিতাও চেয়েছি। আমরা সার্বিকভাবে এখন পর্যন্ত আসামির অনেক কিছুই উদ্ঘাটন করতে পেরেছি। সেটা তদন্তের স্বার্থে বলছি না।
তবে আমাদের অগ্রগতি আছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে আসামিকে আইনের আওতায় আনতে পারবো। তবে একটা সমস্যা হলো মোহাম্মদপুরে অসংখ্য গৃহকর্মী আছে যাদের আসলে নাম-ঠিকানা পরিচয় নেই। কেউ রাখেও না। এ কারণে আমাদের জন্য আসামি ধরা একটু কঠিন হয়। আবার বিশেষ করে জেনেভা ক্যাম্প থেকে প্রচুর পরিমাণে গৃহকর্মী যারা কাজ করে বা বিভিন্ন অঞ্চল থেকে জেনেভা ক্যাম্পে এসে অল্প ভাড়ায় ভাড়া থাকে। তারপরে গৃহকর্মীর কাজ করে এদের অনেকেরই ন্যাশনাল আইডি কার্ড নেই, বার্থ সার্টিফিকেট নেই। অনেকে মোবাইল ফোনও ব্যবহার করে না। ফলে কোনো অপরাধ ঘটলে আমাদের জন্য অপরাধীকে ধরা একটু কঠিন হয়ে যায়। তিনি বলেন, মোহাম্মদপুর অপরাধ প্রবণ এলাকা। সিটি করপোরেশনসহ অন্যান্য কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করছি যে, এই এলাকায় প্রচুর পরিমাণে সিসিটিভি ও পর্যাপ্ত লাইট স্থাপন করাটা জরুরি। আমরা একটা অভিযান তদন্তে সিসিটিভির ফুটেজের অভাবে খুব বেশি এগোতে পারিনি। অপরাধী গৃহকর্মী কোথা থেকে আসলেন কোথায় গেলেন এ বিষয়ে তদন্তে এগোতে পারিনি। আরেকটা বিষয় হলো, মোহাম্মদপুরে তো বেশ কিছু এলাকা আছে খুবই সমৃদ্ধ। কিছু এলাকা আছে বস্তি। সমৃদ্ধ এলাকাতেও সন্ধ্যার পরে লাইট নেই অন্ধকার থাকে ফলে অপরাধীদের জন্য অপরাধ করাটা সহজ হয়ে থাকে।
পোস্টমর্টেম রিপোর্টে কি এসেছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বীভৎস একটা ঘটনা। যিনি মা তার শরীরে ৩০টা আঘাতের চিহ্ন এবং তার মেয়ের শরীরে ৬টা আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত অস্ত্র সেটা পেয়েছি এবং আসামির ফেলে যাওয়া যে বিভিন্ন উপকরণ সেগুলো পরীক্ষা করা হচ্ছে। পিবিআই এবং সিআইডি এসে তারা স্যাম্পল কালেকশন করে নিয়ে গেছে। ফলে আমাদের ব্যাকগ্রাউন্ডের মোটামুটি সব কাজ শেষ এখন শুধু আসামি ধরা বাকি।
উল্লেখ্য, সোমবার কথিত গৃহকর্মী আয়েশা মা লায়লা ফিরোজ (৪৮) ও মেয়ে নাফিসা লাওয়াল বিনতে আজিজ (১৫)কে হত্যা করে পালিয়ে যান। সকাল ৭টা ৫১ মিনিটে তিনি বোরকা পরে লিফটে উঠে ৭ তলায় যান। পরে সকাল ৯টা ৩৫ মিনিটে মুখে মাস্ক লাগিয়ে কাঁধে একটি ব্যাগ ও স্কুল ড্রেস পরে বেরিয়ে যান। নিহত নাফিসা মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুলের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিলেন।