নিত্যপণ্যের বাজার স্থিতিশীল রাখতে সরকার নানা সময়ে জরুরি কিছু উদ্যোগ নেয়। যেমন ব্যবসায়ীরা কোনো পণ্যের দাম অযৌক্তিকভাবে বাড়ালে তাদের চাপে রাখতে সরকারের তরফ থেকে ওই পণ্য আমদানির ঘোষণা আসে। পেঁয়াজ ও ভোজ্যতেলসহ কয়েকটি অতিপ্রয়োজনীয় পণ্যের বেলায় এমনটি ঘটে অহরহ। কোনো কারণ ছাড়াই পেঁয়াজের দাম এক লাফে কেজিপ্রতি ৫০ টাকা বেড়ে যাওয়ার ঘটনা গত এক-দুদিনের ব্যবধানে ঘটেছে। সরকার পেঁয়াজ আমদানি করবে বলে জানান দেওয়ার পর চট্টগ্রামে পেঁয়াজের দাম কেজিপ্রতি ৪০ টাকা কমে যাওয়ার খবর এসেছে। সেই খবরের প্রভাব রাজধানীসহ দেশের অন্য অঞ্চলেও পড়ছে বলে শোনা যাচ্ছে।
সরকার যখন পণ্যের দাম ঠিক করে ব্যবসায়ীদের আমদানির অনুমতি দেয়, তখন স্বভাবতই তার সুবিধা পাওয়ার কথা জনগণ তথা ভোক্তার। কিন্তু বাস্তবে ভোক্তা উপকারভোগী না হয়ে সুবিধা হয় বাজার সিন্ডিকেটের। সরকার খুব হম্বিতম্বি করে পণ্যের দাম নিয়ে কিছু একটা করার চেষ্টা করেও সেটি বাস্তবায়ন করতে না পারার একটা দায়ও আছে। বাজার বিশ্লেষকরা এমনটিই মনে করছেন। তাদের মতে, জনগণের স্বার্থ রক্ষার চেষ্টা থাকলেও সরকার আড়ালে বাজার সিন্ডিকেটের সেই পুরোনো কারবারিদের কাছেই অসহায়।
এখন বাজার পরিস্থিতি কেমন-এই প্রশ্নের জবাব এক কথায় বলা মুশকিল। বাজার অব্যবস্থাপনা ও সিন্ডিকেটের কারণে জবাবটি এমন। যদিও নিত্যপণ্যের উৎপাদন, মজুত ও সরবরাহ স্বাভাবিকই আছে। বাজার ও গুদামে পণ্যের কোনো ঘাটতিও নেই। এরপরও সিন্ডিকেটের কারসাজিতে পণ্যের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। বিশেষ করে বছরের শেষদিকে এসে পেঁয়াজ ও ভোজ্যতেলের দাম নিয়ে নাজেহাল ভোক্তা। অসাধু চক্র নির্দিষ্ট সময়ে এক বা একাধিক পণ্য টার্গেট করছে। পরিকল্পিতভাবে বাড়াচ্ছে দাম। মন্ত্রণালয় পণ্যের দাম নির্ধারণ ও আমদানির অনুমতি দিচ্ছে। কিন্তু যত টাকা দাম বাড়ানো হয়েছিল, পুরোটা না কমিয়ে সামান্য কিছু কমানো হচ্ছে। এতে ভোক্তার উপকার বলতে ‘যেই লাই সেই কদু।’
বাজারে সরকারের তদারকি কেমন-এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে যে তথ্যটি সামনে এলো সেটি হচ্ছে, আড়তদার সিন্ডিকেট পেঁয়াজের দাম নিয়ে কারসাজি করছে। চক্রের সদস্যরা সেপ্টেম্বর থেকেই মূল্যবৃদ্ধি শুরু করে। সর্বশেষ গেল দুই দিনে পেঁয়াজের সংকটের কথা বলে ভরা মৌসুমে কেজিপ্রতি ৪০-৫০ টাকা বাড়িয়ে খুচরা বাজারে সর্বোচ্চ ১৬০ টাকায় বিক্রি করে। বাজার থেকে অবৈধভাবে তুলে নেয় কয়েক হাজার কোটি টাকা। অন্যদিকে তারা মৌসুমেই আমদানি অনুমতির চাপ দিয়ে সরকারকে ঝাঁকি দেয়।
যদিও কৃষি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা জানান, দেশে পেঁয়াজের সংকট নেই। মৌসুমের নতুন পেঁয়াজ বাজারে আসছে। এমন সময় আমদানির অনুমতি দিলে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনও (বিটিটিসি) জানায়, দেশে পেঁয়াজের কোনো সংকট নেই। কারসাজির মাধ্যমেই পেঁয়াজের দাম বাড়ানো হয়েছে। বিটিটিসি আরও জানায়, গত অর্থবছরে দেশে ৪৪ লাখ ৪৮ হাজার টন পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে। সংরক্ষণ সমস্যাসহ নানা কারণে বাজারে আসতে পেরেছে ৩৩ লাখ টনের মতো পেঁয়াজ। এছাড়া একই সময়ে মোট ৪ লাখ ৮৩ হাজার টন পেঁয়াজ আমদানিও হয়েছে। তবে এতকিছুর পরও অদৃশ্য শক্তির কাছে নত হয়ে শনিবার রাতে বাজার সহনীয় রাখতে সীমিত আকারে পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দেয় সরকার। কৃষি মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, প্রতিদিন ৫০টি করে আইপি (আমদানি অনুমতি) ইস্যু করা হবে। প্রতিটি আইপিতে সর্বোচ্চ ৩০ টন পেঁয়াজ আমদানির অনুমোদন থাকবে। পেঁয়াজের বাজার সহনীয় রাখতে পুনরাদেশ না দেওয়া পর্যন্ত এ কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।
এতকিছুর পরও বাজারে কমছে না পেঁয়াজের দাম। সোমবার (৮ নভেম্বর) প্রতিকেজি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১৪০-১৫০ টাকা দরে। যা দুই দিন আগে বিক্রি হয়েছে আরও বেশি ১৪০-১৬০ টাকা। চার দিন আগে প্রতিকেজি পেঁয়াজের সর্বোচ্চ দাম ছিল ১১০ টাকা। অক্টোবরের শেষদিকে ছিল ৭০ টাকা কেজি। এর আগের মাসে সেপ্টেম্বরে কেজিপ্রতি বিক্রি হয় ৬০-৬৫ টাকায়। তবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সরেজমিন উইং সূত্র জানায়, প্রকৃতপক্ষে বাজারে সরবরাহের কোনো ঘাটতি নেই। আমদানির অনুমতি দিতে সরকারকে বাধ্য করতেই সিন্ডিকেটচক্র কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়িয়েছে। মার্কেট প্রসেসে এক লাখ টনেরও বেশি পুরোনো পেঁয়াজ আছে।
অন্যদিকে গত ১০ নভেম্বর লিটারে ৯ টাকা বাড়ানোর অনুমতি চেয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয় বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন। ২৪ নভেম্বর তারা আবারও দাম সমন্বয়ের সুপারিশ করে। অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে দুবার অনুমতি চাওয়া হলেও মন্ত্রণালয় সাড়া দেয়নি। এ পর্যায়ে ব্যবসায়ী সংগঠন একরকম অনুমতি ছাড়াই প্রতিলিটারে ৯ টাকা বাড়িয়ে খুচরা পর্যায়ে বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৯৮ টাকায় বিক্রির সিদ্ধান্ত নেয়। বাজারে ছাড়া হয় তেল। ফলে ক্রেতাকে বাড়তি দামেই তেল কিনতে হয়। এরপর নড়েচড়ে বসে কর্তৃপক্ষ। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, কোম্পানিগুলো খেয়ালখুশিমতো বাড়তি দামে সয়াবিন তেল বিক্রি করছে। ব্যবসায়ীদের শোকজ করা হয়। মূল্যবৃদ্ধি রোধে মন্ত্রণালয়ে দফায় দফায় সভাও হয়। সর্বশেষ রোববার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সভা করে লিটারে ৬ টাকা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়। অর্থাৎ ব্যবসায়ীরা লিটারে অযৌক্তিকভাবে ৯ টাকা বাড়ালেও সরকার কিছু কমিয়ে ৬ টাকার বৈধতা দেয়। এতে ক্রেতার পকেট কাটলেও স্বার্থরক্ষা হয় সেই সিন্ডিকেটের।
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএম নাজের হোসাইন যুগান্তরকে বলেন, দেশে পেঁয়াজের কোনো ঘাটতি নেই। তারপরও অসাধুরা পণ্যটির দাম বাড়িয়ে আমদানির অনুমতি নিয়েছে। সরকার কোনো কার্যকর পদক্ষেপ না নিয়ে উলটো অসাধুদের স্বার্থ দেখেছে। ভোজ্যতেলের ক্ষেত্রেও একই পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। এখন ভোজ্যতেলের দাম বাড়ার কথা নয়। সরকারের পক্ষ থেকেও পরিষ্কারভাবে এ তথ্য ব্যবসায়ীদের দেওয়া হয়েছিল। এরপরও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় লিটারে ৬ টাকা বাড়ানোর অনুমতি দিয়েছে। ব্যবসায়ীদের ৯ টাকার বিপরীতে সরকার ৬ টাকা বাড়িয়ে ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষা করেছে। মাঝখানে পকেট কাটা গেছে ভোক্তার।
পেছনের বছরে কারসাজির চিত্র : ২০২৩ সালের শুরুতে আলুর কেজি ছিল ২০ টাকা। মে মাসে তা বেড়ে হয় ৩৫ টাকা। জুন মাসে বিক্রি হয় ৪৫ টাকা। তখন সরকার আলুর দাম নির্ধারণ করে ৩৫-৩৬ টাকা কেজি। কিন্তু সেই দামও কার্যকর হয়নি। তখন বাজারে আলু বিক্রি হয় ৪৫-৫০ টাকা কেজি। একই বছর মার্চে পেঁয়াজের কেজি ছিল ৩০ টাকা। মে মাসে বেড়ে হয় ৫৫ টাকা। এরপর মূল্য গিয়ে দাঁড়ায় ৯০ টাকায়। তখন সরকার মূল্য নির্ধারণ করে ৬৪-৬৫ টাকা। কিন্তু বাজারে ওই সময়ে বিক্রি হয় প্রতিকেজি ৮০-৮৫ টাকায়। এছাড়া একই বছরের জানুয়ারিতে প্রতিপিস ডিমের দাম ছিল ১০ টাকা। মে মাসে দাম বেড়ে হয় ১১ টাকা। সেপ্টেম্বরে বিক্রি হয় সর্বোচ্চ ১৪ টাকা। পরে সরকার নির্ধারণ করে ১২ টাকা। কিন্তু বাজারে তখন ডিম প্রতিপিস বিক্রি হয় ১৩ টাকায়। পাশাপাশি ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে খোলা চিনির কেজি ছিল ৯০ টাকা। ২০২৩ সালের মে মাসে দাম বেড়ে হয় ১৩৫ টাকা। সেপ্টেম্বর মাসে সরকার চিনির দাম নির্ধারণ করে ১৩০ টাকা কেজি। কিন্তু সেই দামও তখন মানা হয় না। বাজারে তখন বিক্রি হয় ১৩৫ টাকায়।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ড. এমকে মুজেরী বলেন, পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারকে আগে থেকে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করতে হবে। সরকার কী করছে, সেটি ভোক্তা ও ব্যবসায়ীদের জানাতে হবে। অনিয়ম করলে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। তাহলেই ভোক্তা সরকারের উদ্যোগের সুফল পাবে। ভোক্তার সুরক্ষা দিতে হলে বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ তৈরি করতে হবে।